রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:১৩ অপরাহ্ন

ভাত-ডাল-রুটি খেতেও দাম নিয়ে নাভিশ্বাস

ভাত-ডাল-রুটি খেতেও দাম নিয়ে নাভিশ্বাস

স্বদেশ ডেস্ক:

করোনা মহামারীর কারণে এমনিতেই দিশাহারা দেশের সাধারণ মানুষ। ভালো নেই মধ্যবিত্তরাও। বহু মানুষ চাকরি হারিয়ে কঠিন সময় পার করছেন। গত দেড় বছরের বেশি সময়ে ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে বহুজনের। বেসরকারি খাতের অনেক কোম্পানি লোকসানের মুখে থাকায় চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে আছেন কর্মজীবীদের বড় একটি অংশ। অনেকে নিয়মিত বেতন পান না, বন্ধ রয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানও। দৈনিক হিসেবে যারা কাজ করেন, তাদের বেশিরভাগই কর্মহীন। একই সঙ্গে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবী মানুষ তো আরও বেশি কষ্টে আছেন। এর ভেতরেই আন্তর্জাতিক বাজারে দরবৃদ্ধির অজুহাতে দেশে বেড়েই চলেছে নিত্যপণ্যের দাম।

এ সুযোগে কৃত্রিম সংকট, সরবরাহ ঘাটতি তৈরি করে ফায়দা লুটছেন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। বাজার নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধিকে ইস্যু হিসেবে দেখছে খোদ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও। ফলে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। এতে বেড়েই চলেছে তেল, চিনি, আটা ও মসুর ডালের দাম। অন্যদিকে চালের বাজার স্থিতিশীল করতে শুল্কে বড় ধরনের ছাড় দেওয়ার পরও কমেনি দাম।

জানা গেছে, ভোজ্যতেলের দামে অনেক দিন ধরেই চলছে ঊর্ধ্বগতি। সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীতে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে লিটারে ৫ টাকা পর্যন্ত। খোলা সয়াবিনে দাম বেড়েছে তিন থেকে চার টাকা। যদিও বিক্রেতাদের দাবি- আগের দামেই বিক্রি করছেন তারা। এ অবস্থায় বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কঠোর অবস্থান চান ভোক্তারা।

একইভাবে বাজারে বেড়েছে চিনির দর। খোলা চিনি কেজিপ্রতি ৭৭ থেকে ৮০ টাকায় উঠেছে। বাজারভেদে প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৮০ থেকে ৮২ টাকায়। কারওয়ানবাজারের খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, গত তিন দিনে খোলা চিনির দাম কেজিপ্রতি ৭ থেকে ৮ টাকা বেড়েছে। যার দোকানে আগে কেনা চিনি ছিল, তিনি বিক্রি করছেন ৭৭-৭৮ টাকা কেজিতে। যে খুচরা বিক্রেতা নতুন করে কিনেছেন, তিনি বিক্রি করছেন ৮০ টাকা কেজি দরে।

বড় দানার মসুর ডালের দাম কেজিতে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। মালিবাগ বাজারের খোরশেদ বাণিজ্যালয়ের ব্যবসায়ী মো. শাহাবুদ্দিন বলেন, বড় দানার মসুর ডাল এখন ৮০ টাকা কেজি এবং মাঝারি দানার ডাল ৯০ টাকা কেজি বিক্রি করছি। অথচ দুই সপ্তাহ আগেও একই ডাল কেজিতে ১০ টাকা কমে বিক্রি করেছি। কারওয়ানবাজারের ঢাকা জেনারেল স্টোরের ব্যবসায়ী মো. মুজাহিদ বলেন, কেজিতে দাম বেড়ে বড় দানার মসুর ডাল এখন বিক্রি হচ্ছে ৭৬-৭৮ টাকা পর্যন্ত। সপ্তাহ দুয়েক আগেও বিক্রি হয়েছে ৬৬-৬৮ টাকায়। পাইকাররা দাম আরও বাড়াচ্ছেন। কিছু দিন বাদে কারওয়ানবাজারেই হয়তো এ ডাল ৮০ টাকা কেজি বিক্রি হবে।

গত বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) তরফ থেকে উপস্থাপিত প্রেজেনটেশনে দেখা যায়, এক বছর আগের তুলনায় এখন দেশে খোলা ও বোতলজাত ভোজ্যতেলের দাম ৩৮ থেকে ৭০ শতাংশ বেশি। চিনির দাম বেড়েছে ২৬ শতাংশ। সূত্র বলছে, ব্যবসায়ীরা চিনি ও ভোজ্যতেলের দাম আরও বাড়াতে চান। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, গত ৫ আগস্ট সয়াবিন তেলের লিটারপ্রতি দর আরও প্রায় ১৫ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তবে মন্ত্রণালয় থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, শোকের মাস উপলক্ষে আগস্টে দাম বাড়ানো যাবে না। এ জন্য তারা আগামী মাসের অপেক্ষায় রয়েছেন। বিশ্ববাজারে চিনির দামও অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। তাই ব্যবসায়ীরা চিনির দাম বাড়ানোর প্রস্তাবও দেবেন বলে এক শীর্ষ ব্যবসায়ী প্রতিনিধি জানিয়েছেন।

সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) খুচরা বাজারদরের তালিকা পর্যালোচনায় দেখা যায়, চাল-ডাল-তেলের পাশাপাশি সবজি, আটা-ময়দা, মাছ-মাংস, পেঁয়াজ, আদা, রসুনের দামও বেড়েছে। চিনির মতো লবণ কিনতেও ক্রেতাকে বাড়তি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। গত বছর একই সময়ের তুলনায় রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রায় ২০ ধরনের নিত্যপণ্য বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে কেজিপ্রতি ২.৪০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৬২.৯৬ শতাংশ দাম বেড়েছে। সম্প্রতি কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২০ সালে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬.৮৮ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়েছে ৬.৩১ শতাংশ। জীবনযাত্রার এ ব্যয়বৃদ্ধি গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। করোনার কারণে চলতি অর্থবছর শেষে জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে চিনি ও তেলের দাম বৃদ্ধিতে দেশীয় বাজারেও এর কিছুটা প্রভাব পড়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে বাজার স্থিতিশীল রাখতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। গত বুধবার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ, সরবরাহ, আমদানি ও মূল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক এবং স্থিতিশীল রাখতে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে। এ ছাড়া আগামী ৪ সেপ্টেম্বর থেকে টিসিবির মাধ্যমে পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো হচ্ছে। যেহেতু আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে শুল্ক কমিয়ে কিছুটা মূল্য সমন্বয় হতে পারে। এ জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে চিঠি পাঠিয়েছে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীরা যাতে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি করতে না পারে, সে জন্য নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ

আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন, অপরিশোধিত পাম ও অপরিশোধিত চিনির মূল্যে ঊর্ধ্বগতি, পণ্য পরিবহনে ব্যয়বৃদ্ধি, ডলারের ক্রয়মূল্যবৃদ্ধি, অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে প্রতি টনে স্পেসিফিক ডিউটি ৩ হাজার টাকা, আরডি ৩০ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ এবং এটি ৪ শতাংশ আরোপিত আছে।

ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ও উৎপাদন

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, রসুনের বার্ষিক চাহিদা ৬ লাখ ৫০ হাজার টন। দেশে উৎপাদন হয় ৭ লাখ টন। চিনির বার্ষিক চাহিদা ১৭ থেকে ১৮ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত হয় ৬৯ হাজার ৫০০ টন। বাকি চিনি আমদানি করতে হয়। ফলে চিনির বাজার পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। বছরে ১৮ থেকে ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে দুই লাখ ২৫ হাজার টন দেশে উৎপাদিত হয়।

ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান আমাদের সময়কে বলেন, বাজারে প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় চাপে রয়েছেন ভোক্তারা। নিত্যপণ্যের দাম কমাতে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী রয়েছেন, যারা সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। অতিরিক্ত মুনাফার জন্য কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন, নানা অজুহাতে দাম বাড়িয়ে দেন। এদের ঠেকাতে হবে। পাশাপাশি স্বাভাবিক রাখতে হবে বাজারে পণ্য সরবরাহ। আমদানি সুবিধা দিয়ে হলেও সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে। এতে অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর সুযোগ পাবে না।

কনশাস কনজ্যুমারস সোসাইটির (সিসিএস) নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ বলেন, বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করছেন ব্যবসায়ীরা। সিন্ডিকেটকারীদের দৌরাত্ম্য কমেনি। কৃত্রিম সংকট, সরবরাহ ঘাটতি ও আন্তর্জাতিক বাজারদর বৃদ্ধি- এসব অজুহাতে সুযোগ পেলেই দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877