স্বদেশ ডেস্ক:
বাংলাদেশের কাঁধে বোঝা হয়ে বসা রোহিঙ্গারা সন্তান জন্মদানেও অপ্রতিরোধ্য। গেল চার বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি সন্তান জন্মলাভ করেছে। প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গড়ে প্রতিদিন ৯০ জন শিশু বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করছে। শুধু তাই নয়, একাধিক বিয়ে করার প্রবণতা ও বাল্যবিয়ের ঘটনা বাড়ছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে। অধিক সন্তান জন্মদানের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা হলেও তারা তা মানছেন না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে সন্তান জন্ম দিতে থাকলে একদিন ওইসব এলাকায় স্থানীয়রাই সংখ্যালঘু হবে, সংকটে পড়বে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো সরেজমিন ঘুরে যে তথ্য মিলেছে তাতে দেখা যায়, অশিক্ষিত রোহিঙ্গারা ধর্মের দোহাই দিয়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণে অনাগ্রহী। ফলে ক্যাম্পে অবস্থানরত অনিশ্চিত জীবনেও থেমে নেই তাদের বাচ্চা জন্মদান। যার ফলে জন্ম নিচ্ছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নবজাতক। যার পুরো চাপটাই এখন পড়েছে আশ্রয়দাতা বাংলাদেশের ওপর। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দ্রুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করা না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে।
জাতিসংঘ শরাণার্থী সংস্থা-ইউএনএইচসিআর, ইউনিসেফ ও বেসরকারি এনজিও সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিসংখ্যান মতে, প্রতিদিন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যুক্ত হচ্ছে গড়ে ৯০ শিশু। ২০১৭ সালের পর থেকে গত চার বছরে উখিয়া-টেকনাফের ৩৪ শিবিরে জন্ম নিয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা শিশু। ফলে নতুন এবং পুরনোসহ এ দেশে জন্ম নেওয়া শিশুসহ রোহিঙ্গার সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১৪ লাখে পৌঁছেছে।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে পরবর্তী স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে বাংলাদেশে আসে। ওই সময় আসা নারীদের ৩০ হাজারের বেশি ছিল অন্তঃসত্ত্বা। পরে কয়েক মাসের মধ্যেই এসব সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। ইউএনএফপিএর আরেকটি তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৩০ হাজার অন্তঃসত্ত্বা মহিলা বাংলাদেশে এলেও শিবিরগুলোতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পরিচালিত সেবা কেন্দ্রগুলোতে মাত্র ৪ হাজার শিশুর জন্ম হয়। অবশিষ্ট শিশুর জন্ম হয় শিবিরে।
সম্প্রতি উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, রাস্তাঘাটে মানুষের মধ্যে শিশুদের উপস্থিতিই বেশি। বিভিন্ন বয়সী শিশু। বয়সে একটু ছোট শিশুদের গায়ে জামাকাপড়, এমনকি বেশিরভাগ শিশুর পরনে হাফপ্যান্ট পর্যন্ত নেই। বেশ কিছু মেয়েশিশুকেও খালি গায়ে ঘুরতে দেখা যায়। উখিয়ার কুতুপালং ও জামতলা ক্যাম্পে কর্মরত সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ও একাধিক নারী ও পুরুষ রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। জানা যায়, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রোহিঙ্গাদের আগ্রহ নেই। শিশুদের টিকা দেওয়ার ব্যাপারেও তাদের অনাগ্রহ চরম। যে কোনো ধরনের ইনজেকশন দেওয়া থেকে শুরু করে ওষুধ সেবনকে তারা সন্দেহ করে জন্মনিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে। এ ক্ষেত্রে মহিলা ও শিশুদের ঘরের পুরুষ ও মসজিদের মৌলভীদের কঠিন বাধার মুখে পড়তে হয়। তাই অপারগ না হলে রোহিঙ্গা নারীরা চিকিৎসা ও সেবা কেন্দ্রে আসেন না। কুসংস্কার দূর করতে চার বছর ধরে জাতিসংঘ, বাংলাদেশ সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি কর্মকর্তারা চেষ্টা চালিয়েও খুব একটা সফল হতে পারেননি।
ক্যাম্পে অধিকাংশ পুরুষ রোহিঙ্গার একাধিক স্ত্রী রয়েছে। প্রতি স্ত্রীর ঘরে আসছে নতুন শিশু। কারও কারও সন্তান সংখ্যা ৬ থেকে ৭। সন্তান জন্মদানকে আল্লাহ দিয়েছে বলে মনে করেন এরা। সন্তান জন্মদানকে এখনো নিজেদের অর্জন হিসেবেই দেখে রোহিঙ্গারা। উখিয়ার জামতলা ক্যাম্পের ৪০ বছর বয়সী রোহিঙ্গা রহিমা বেগম। পরিবার যত বড় হবে, সেই সঙ্গে বাড়বে আয় উপার্জন এমন ধারণায় এ পর্যন্ত রহিমা ৬ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। রহিমার মতো মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া বেশিরভাগ রোহিঙ্গা নারীর চিত্র একই।
কুতুপালং ১৮নং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা আসমত বলেন, সন্তান হওয়া তো আল্লাহ হাতে। ২০১৭ সালে এ দেশে আসা বেশিরভাগ দম্পতিই এরই মধ্যে হয়েছেন এক সন্তানের বাবা-মা। অনেকেই আছেন হওয়ার অপেক্ষায়। জন্মনিয়ন্ত্রণ তো দূরের কথা, সন্তান জন্মদানকে এখনো নিজেদের অর্জন হিসেবেই দেখেন শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা এ জনগোষ্ঠী। উখিয়া কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মৌলভী নুর হোসেন জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়ে বলেন, যিনি (স্রষ্টা) দেওয়ার তিনি সন্তান দিচ্ছেন। অনেকের উঠান ভরে যাচ্ছে। অনেকে চেয়েও পাচ্ছে না। এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো চিন্তা নেই।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনে কাজ করা নাবিলা নরমি বলেন, অন্তঃসত্ত্বা মায়ের সংখ্যা বেশি হলেও রাস্তাঘাটে তাদের সেভাবে দেখা মেলে না। এমনকি এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ নারী সন্তান প্রসবের জন্যও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আসতে রাজি হন না। ফলে ক্যাম্পের ঘরের ভেতরে সন্তান প্রসবের সংখ্যা বেশি। তিনি বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যাপারে তাদের আগ্রহ কম। কারণ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিকে তারা মহাপাপ হিসেবে মনে করেন। তবে ইদানীং পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। অনেকেই জন্মনিয়ন্ত্রণে আগ্রহী হয়ে উঠছে।
উখিয়ার জামতলা ক্যাম্পের ১১নং ব্লকের মাঝি শফিক। এক সন্তানের জনক। তিনি বলেন, প্রতিবছর রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে সদস্য সংখ্যা যে বেড়েই চলেছে তা সত্য। আশ্রয় শিবিরে অনেক রোহিঙ্গা পরিবারে থাকার সংকুলানও যে হচ্ছে না তাও সত্য। আমরা চেষ্টা করছি বেশি সন্তানের ক্ষতিকর দিক বোঝানোর জন্য। এনজিওগুলোর পক্ষ থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়িসহ বিভিন্ন সামগ্রী দেওয়া হচ্ছে। অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাস কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত আমাদের সময়কে বলেন, রোহিঙ্গারা এক ধরনের অনিশ্চয়তা থেকে অধিক সন্তান জন্মদানে আগ্রহী। এ ছাড়া শিক্ষার অভাবে তাদের মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামিও আছে। তা ছাড়া ক্যাম্পের ধর্মীয় নেতাদের প্রভাব বেশি। তারা জন্মনিয়ন্ত্রণে আগ্রহী নয়। তবে পরিস্থিতি আগের থেকে উন্নতি হচ্ছে। আমরা রোহিঙ্গা নারী পুরুষকে অধিক সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষতিকর দিক তুলে ধরছে। নিয়মিত জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি, কনডম বিতরণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে সন্তান না নেওয়ার জন্য ইনজেকশনও দেওয়া হচ্ছে। অনেকেই নিতে আগ্রহী হয়ে উঠছে।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, অনেক ভয় আশঙ্কার মধ্যে দিনাতিপাত করছি। এখানকার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলে প্রায় সময় চোখে পানি চলে আসে। এই রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে কীভাবে আমরা মুক্তি পাব তা ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছি না। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গারা স্থানীয়দের পাহাড় পর্বত জমি-জায়গা দখল করতে শুরু করছে। অন্যদিকে অপরাধ চক্রের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে জনসংখ্যা। কি যে এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বসবাস করছি তা বুঝে উঠতে পারছি না। প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন টেকনাফ প্রতিনিধি আবদুল্লাহ মনির ও উখিয়া প্রতিনিধি পলাশ বড়ূয়া।