বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২৯ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
বরিশালে মেয়র-প্রশাসন সমঝোতা

বরিশালে মেয়র-প্রশাসন সমঝোতা

স্বদেশ ডেস্ক: নানা ঘটনার পর অবশেষে বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবনে হামলা, সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি মামলাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বৈরিতার অবসান হচ্ছে। গতকাল রবিবার রাত ১১টার দিকে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের বাসভবনে প্রশাসন ও মেয়রপক্ষের মধ্যে এক সমঝোতা বৈঠক হয়। বৈঠকে মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়ার বিষয়ে উভয়পক্ষ একমত হয়েছে বলে জানা গেছে। রাতে সমঝোতা বৈঠকের বিষয়টি আমাদের সময়কে নিশ্চিত করে জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার বলেন, উভয়পক্ষের আন্তরিক আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে ঘটে যাওয়া বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে।
বৈঠক শেষে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি একেএম জাহাঙ্গীর বলেন, বৈঠকে মেয়রের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারসহ বেশকিছু বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ভুল বোঝাবুঝি থেকে ওই ঘটনা হয়েছে বলে উভয়পক্ষ তাদের আলোচনায় দাবি করেন। এ ধরনের ঘটনা আগামীতে যেন না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকার কথাও উল্লেখ করা হয়।
বৈঠকে বিভাগীয় কমিশনার সাইফুল ইসলাম বাদল, বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ, জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার, ডিআইজি এসএম আকতারুজ্জামান, মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন খান ও জেলা পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক
অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি একেএম জাহাঙ্গীরসহ স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তবে ইউএনও মো. মুনিবুর রহমান ও সদর থানার ওসি নুরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন না বলে জানা গেছে।
এর আগে দুপক্ষকে শান্ত করতে কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতার ‘মধ্যস্থতায়’ কিনারা হওয়ার আগেই রবিবার বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং সদর থানার ওসির বিরুদ্ধে আদালতে পাল্টা মামলা করে সিটি করপোরেশন ও এক প্যানেল মেয়র। আদালত মামলা আমলে নিয়ে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন। এর মধ্য দিয়ে ঘটনা এবার আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এ ঘটনায় রাজনীতিকদের সঙ্গে প্রশাসনের মধ্যে যে ‘বৈরিতা’ তৈরি হয়, তাতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করছে বলে মনে করেন কয়েক মন্ত্রী ও পদস্থ আমলা।
এদিকে রবিবার ইউএনও ও পুলিশের দায়ের করা মামলায় মেয়র সাদেক সমর্থক ২১ নেতাকর্মীর জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। এই ঘটনা গত কয়েকদিনের সৃষ্ট উত্তেজনাকর পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে তোলে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও বিষয়টি নিয়ে জোর আলোচনা হয়।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম অবশ্য শান্তির বার্তা শোনান। সচিবালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বরিশালে ক্ষমতাসীন মেয়রের সঙ্গে প্রশাসনের বিরোধ ও পাল্টাপাল্টি মামলার ঘটনাটি ‘ভুল বোঝাবুঝি’ থেকে হয়েছে। তার মতে, এটা অচিরেই মিটে যাবে।
বরিশালে দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম আমাদের সময়কে বলেন, ‘তদন্তের আগেই কাউকে দায়ী না করে বরং তদন্ত শেষে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’ তিনি আরও বলেন, ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। এর বাইরে আমরা কেউ নই।’
বরিশালের ঘটনা সারাদেশে আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী এবং প্রশাসনের ক্যাডারের উচ্চপদস্থ কয়েকজন সচিবের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তা হয়। সেই আলোচনার সূত্র ধরে জানা যায়, উভয়পক্ষই সমাধানের পথ তৈরি করতে চাইছেন। তবে তাদের সমাধানের বার্তা বরিশালে পৌঁছায়নি। কারণ সেখানে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা এখনো উত্তেজিত। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারাও বেশ ক্ষুব্ধ।
স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনের একাধিক কর্তকর্তার সঙ্গে কথা বলে বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে বেশকিছু তথ্য জানা গেছে। মেয়র সাদেক আবদুল্লাহ ও প্রশাসনের মধ্যে দূরত্বের কারণে মামলা ও পাল্টা মামলাসহ উভয়পক্ষের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। পোস্টার ছেঁড়াকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনা অনেক দূর গড়িয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহানগরের এক সিনিয়র নেতা আমাদের সময়কে বলেন, যে কোনো কারণেই হোক পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন মেয়রের ওপর অসন্তুষ্ট ছিল। পুলিশের এক এসপিকে ধমকিয়েছেন মেয়র, এমন কথাও শোনা গেছে। থানা ঘেরাও করেছে তার সমর্থকরা, এমনকি থানা থেকে আসামি ছিনিয়ে আনার চেষ্টাও হয়েছে। জেলা প্রশাসনের কর্মসূচিতে ঢাকা থেকে কোনো মন্ত্রী অতিথি হলেও মেয়রকে সেখানে নিমন্ত্রণ জানানো হতো না বলে জানান ওই নেতা। বিষয়টি মেয়র মেনে নিলেও ভেতরে ভেতরে তিনি অসন্তুষ্ট ছিলেন। এ নিয়ে নীরবে এক ধরনের টানাপড়েন ছিল উভয়পক্ষের মধ্যেই। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত মামলা-হামলা ও আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।
গত বুধবার রাতে বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদ চত্বরে ব্যানার অপসারণকে কেন্দ্র করে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনিবুর রহমানের সরকারি বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর সমর্থক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। ওই ঘটনায় সরকারি কাজে বাধা প্রদান এবং হত্যার উদ্দেশ্যে আঘাত ও গুলিবর্ষণের অভিযোগ এনে মেয়রের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পাল্টা পৃথক দুটি মামলার আবেদন হয়েছে ইউএনও ও পুলিশের বিরুদ্ধেও। বরিশালের সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মুনিবুর রহমানের বিরুদ্ধে রবিবার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন আদালতে এ মামলা করা হয়। বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও মহানগর যুবলীগ নেতা এবং সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র-২ অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম খোকনের করা আবেদনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মুনিবুর রহমান, কোতোয়ালি মডেল থানার ইনচার্জ (ওসি) ও পুলিশের এক উপপরিদর্শকসহ ও আনসার সদস্যদের বিবাদী করা হয়েছে। অপর আবেদনটি করেন সিটি করপোরেশনের রাজস্ব শাখার কর্মকর্তা বাবলু হাওলাদার। আদালতের বিচারক মাসুম বিল্লাহ বিকালে মামলা দুটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) ২৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
আদালতের নাজির কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, রফিকুল ইসলাম খোকনের অভিযোগে সদর ইউএনও মুনিবুর রহমান, কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি নুরুল ইসলাম ও এসআই শাহজালাল মল্লিককে আসামি করা হয়েছে। অভিযোগে পাঁচ আনসার সদস্যকে আসামি করা হলেও তাদের নাম উল্লেখ করা হয়নি। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ৪০ জনকেও আসামি করা হয়। তিনি আরও জানান, বাবুল হাওলাদারের অভিযোগে ইউএনও মুনিবুর রহমানসহ পাঁচ আনসার সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া অজ্ঞাত আরও ৪০ জনকে আসামি করা হয়।
এই দুই অভিযোগে বলা হয়, সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাসসহ নগরীর পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা গত ১৮ আগস্ট সিঅ্যান্ডবি সড়কে উপজেলা পরিষদ কম্পাউন্ডে বিভিন্ন ব্যানার-ফেস্টুন অপসারণ করতে যান। ওই সময় ইউএনওর নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্যরা বাধা দেন ও তাদের লাঞ্ছিত করেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়, একপর্যায়ে সিটি মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে গেলে ইউএনও এবং আনসার সদস্যরা মেয়রকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়েন। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মানববর্ম তৈরি করে মেয়র সাদিক আবদুল্লাহকে রক্ষা করেন; এতে বেশ কয়েকজন কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
বাদীর আইনজীবী বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক অ্যাডভোকেট কাইয়ুম খান কায়সার জানান, আবেদনের শুনানি শেষে বিজ্ঞ বিচারক মামলা দুটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন।
অপরদিকে ইউএনও বাসভবনে হামলা ও পরে পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেপ্তার ২১ নেতাকর্মীর জামিন দেননি আদালত। রবিবার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালত তাদের জামিন নামঞ্জুর করেছেন। বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট কাইয়ুম খান কায়সার জানান, রবিবার সকালে আওয়ামী লীগের ২১ নেতাকর্মীর জামিনের আবেদন জানানো হয়। গত ১৮ আগস্ট রাতে ইউএনও মুনিবুর রহমানের বাসায় হামলার চেষ্টার ঘটনায় দায়ের পৃথক দুটি মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শুনানি শেষে আদালত আবেদন নামঞ্জুর করে তাদের জেলহাজতে রেখে সুচিকিৎসা দেওয়ার নির্দেশ দেন।
এদিকে উভয়পক্ষ আইনি পথে হাঁটলেও বরিশাল নগরীতে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। গ্রেপ্তার আতঙ্কে গা ঢাকা দিয়েছেন মেয়র সমর্থক নেতাকর্মী। গতকাল সারাদিন মেয়র সাদিক আবদুল্লাহও বাসায় অবস্থান করেছেন বলে জানা গেছে।
অপরদিকে চারদিন পরে নগরীর বর্জ্য অপসারণ করা হলেও ব্যাহত করোনার ভ্যাকসিন কার্যক্রম। সিটি করপোরেশন পরিচালিত নগরীর ২৪টি টিকাদান কন্দ্রে গতকাল ভ্যাকসিন দেওয়া হয়নি। গ্রেপ্তার আতঙ্কে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা টিকাদান কেন্দ্রে যাচ্ছেন না বলে জানা গেছে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877