স্বদেশ ডেস্ক:
মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে নতুন জীবনে দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে চায় সবাই। কিন্তু কিছু স্মৃতি আছে যা বয়ে বেড়াতে হয় সারাজীবন। তেমনি বিভীষিকাময় স্মৃতি আরও দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছেন সাভারের মাহবুবা পারভীন। ১৮শ’ স্পিন্টারে ক্ষতবিক্ষত শরীরের ব্যথা বয়ে চলেছেন ১৭টি বছর ধরে। কষ্টের স্মৃতি হাতড়ে বলছিলেন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় রক্তস্রোত থেকে তার বেঁচে ফেরার কথা। মৃত ভেবে মেডিক্যালের মর্গে ৬ ঘণ্টা ফেলে রাখার পর হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে ৭২ ঘণ্টা লড়েছেন। তারপর জীবন পেয়েছেন ঠিকই, তবে তা দুঃস্বপ্নের।
২০০৪ সালের ওই গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানের পাশে যে তিনজন নারীকে রক্তাক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়, পারভীন ছিলেন তাদেরই একজন। আইভি রহমান কদিন পর হাসপাতালে মারা যান। পারভীনের মতো আরও অনেকে প্রাণে বেঁচে গেলেও যাপন করছেন এক যন্ত্রণাময় জীবন। ২১ আগস্টের নারকীয় ওই হামলার ১৭তম বার্ষিকী আগামীকাল শনিবার। এর আগে আমাদের সময়ের সঙ্গে কথা বলেন মাহবুবা পারভীন।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনায় পারভীন বলেন, একের পর এক গ্রেনেড হামলার বিকট শব্দ শুনে সবাই যখন দিগি¦দিক ছোটাছুটি করছিলেন তখন মাটিতে শুয়ে পড়েছিলাম। শরীরের ওপর দিয়ে অসংখ্য মানুষ দৌড়ে গিয়েছিল। কয়েক সেকেন্ড পর এতটুকু অনুভব করতে পারি যে, শরীরে কিছু বিঁধেছে। এ কারণে পুরো দেহ অবশ হয়ে আসছিল। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছিন্নভিন্ন মরদেহ দেখে অচেতন হয়ে পড়েছিলাম। লাশ শনাক্ত করতে এসে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আশীষ কুমার মজুমদার মৃতদের মধ্যে আমাকে জীবিত দেখতে পান। ৭২ ঘণ্টা আইসিইউতে থাকার পর জ্ঞান ফেরে। পরবর্তীতে কলকাতার পিয়ারলেস হাসপাতালে নেওয়া হলে জানানো হয়, আমার শরীরে রয়েছে ১৮শ’ স্পিøন্টার। এগুলো নিয়েই কেটে গেছে ১৭টি বছর।
এখনো বিভীষিকাময় দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থেকে বেঁচে এসেছি। ওই দিন প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনা আপা যখন মঞ্চ থেকে নেমে আসেন ঠিক ওই সময় হঠাৎ করে বিকট শব্দ। তারপর চতুর্দিকে আওয়াজ, কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। দেখি
আশপাশে সবাই পড়ে আছে। বুঝতে পারছি কেউ একজন আমাকে তুলে ফুটপাতে রেখে আসছে। এরপর আর জ্ঞান ছিল না। তবে ওই কয়েক সেকেন্ডের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলে গা শিউরে ওঠে। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। আর এই অনুভূতিটা হয় যখনই শরীরের ভেতরে অসংখ্য স্পিøন্টারের ব্যথা অনুভব করি।
শরীরে অসংখ্য স্পিøøন্টারের ক্ষত দেখিয়ে মাহবুবা পারভীন জানান, গ্রেনেড হামলার পর জীবন ফিরেছে ঠিকই তবে কেড়ে নিয়েছে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ। তীব্র ব্যথা এখনো অবশ করে রাখে সারাক্ষণ। শরীরের বহিরাবরণে থাকা অসংখ্য ক্ষত এখনো জানান দেয় সারা দেহে ছড়িয়ে থাকা স্পিøন্টারের অস্তিত্ব। তবে মাথার থাকা দুটি স্পিøন্টার সবচেয়ে বেশি দুর্বিসহ করে তুলেছে জীবনকে। সারাক্ষণ যেন সুঁইয়ের মতো হুল ফোটায়। সেই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারেন না। ব্যথা এতটাই দিশেহারা করে তোলে যে, মাঝে মধ্যে নিজেই ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে স্পিøন্টার বের করার চেষ্টা করেন। সেই সময় যারা সামনে থাকে তারা বলতে পারবেন- তখন আমি পাগলপ্রায় হয়ে কী রকম চিৎকার, চেঁচামেচি করি। আবোল-তাবোল বকি।
মাহবুবা পারভীন বলেন, নেত্রীর বক্তব্য শেষ হতেই হঠাৎ বিকট শব্দ। পরে জেনেছিলাম সেগুলো ছিল শক্তিশালী গ্রেনেডের বিস্ফোরণ। প্রথম গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হয় আইভি আপার পায়ের কাছে। দেখলাম আইভি আপার দেহ নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। আমরা মানববর্মের মতো আপাকে ঘিরে ধরতে না ধরতেই বিকট শব্দে আরও বেশ কিছু গ্রেনেড বিস্ফোরণ। এরপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর স্বামী অবসরপ্রাপ্ত ফ্লাইট সার্জেন্ট এমএ মাসুদ মারা যাওয়ার পর নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন পারভীন। বড় ছেলে আসিফ পারভেজ স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা থাকেন। ছোট ছেলে রোওশাদ যোবায়ের স্থাপত্য বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য সস্ত্রীক ডেনমার্কে। ভরসা বলতে বোনের ছেলে ছাত্রলীগ কর্মী সীমান্ত। খালাকে তিনিই দেখছেন মায়ের মমতায়।
আক্ষেপ করে পারভীন বলেন, একমাত্র শেখ হাসিনা ছাড়া সাভারে দলের কোনো নেতাকর্মী কখনো আমার খোঁজখবর নেয়নি। এমনকি কোনো দলীয় অনুষ্ঠানেও আমন্ত্রণ জানায় না। দলের নেতাকর্মীদের এমন অবহেলা আর উপেক্ষার কথা বলতে গিয়ে গলা ভারী হয়ে আসে তার। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপা সবসময় আমার খোঁজখবর নেন। তিনি দুই বারে আমাকে ২০ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন এবং মিরপুরে একটি ফ্ল্যাটও দিয়েছেন। প্রতি মাসে আমার হাতখরচের জন্য ঠিকই ব্যাংকে ১০ হাজার টাকা করে পাঠিয়ে দেন। মমতাময়ী নেত্রীকে আল্লাহ আরও নেক হায়াত দিন- এটাই একমাত্র চাওয়া।