শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৮:০৯ অপরাহ্ন

মামলা দুটির বিচারে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে

মামলা দুটির বিচারে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে

এ কে এম শহীদুল হক :

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে একটি নির্মম, জঘন্য ও কলঙ্কজনক ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার পরিবারের অন্তঃসত্ত্বা নারী, শিশু রাসেলসহ ১৮ জনকে ঘাতকরা গুলি করে হত্যা করে। মোশতাক ও জিয়াউর রহমানের সরকার ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে হত্যাকারীদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে রাখে।

একুশ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর ওই বছর নভেম্বর মাসে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ মহান সংসদে বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের পথ সুগম করেন। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা মামলাটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচারের দাবি উঠেছিল। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ কোনো ট্রাইব্যুনাল গঠন না করে সাধারণ আদালতে বিচারের ব্যবস্থা করেন। আসামিদের সাংবিধানিক অধিকার সমুন্নত রেখে তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সব সুযোগ দিয়ে বিজ্ঞ আদালত নিরপেক্ষভাবে বিচারকার্য চালায়। ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে বিচারিক আদালত ১৫ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। পরবর্তীকালে উচ্চ আদালতে সর্বশেষ ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। একজন বিদেশে মৃত্যুবরণ করে। বাকি পাঁচজন বিদেশে পলাতক আছে।

এতবড় একটি ঘটনায় মাত্র ১২ জনের সাজা হয়। এ ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেকেই জড়িত ছিল; ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের মামলার তদন্ত ও বিচারের ক্ষেত্রে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ না থাকায় এবং সাধারণ আদালতে বিচার হওয়ায় আইনের ফাঁকফোকরে এবং সরকারের উদারতায় অনেকে পার পেয়ে যায়।

পুলিশের তদন্তে প্রমাণ হয়, বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে খন্দকার মোশতাক, জেনারেল জিয়াউর রহমান, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর গং জড়িত ছিল। মামলার তদন্তকারী অফিসারের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, আসামি কর্নেল (অব.) ফারুক ও কর্নেল (অব.) রশিদ কার্যবিধি ১৬৪ ধারায় আদালতে যে জবানবন্দি দিয়েছিল, তাতেও বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে খন্দকার মোশতাক ও জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি উল্লেখ আছে। তাছাড়া আত্মস্বীকৃত খুনি ফারুক ও রশিদের বিদেশি টেলিভিশনে সাংবাদিক মাসকারেনহাস-এর কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অকপটে স্বীকার করেছে, তারা ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে গিয়েছিল এবং তাকে তাদের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল। জেনারেল জিয়া তাদের বলেছিলেন, ‘If you want to do, go ahead’. এভাবে জিয়া তাদের বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনায় গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছিলেন। ইউটিউবে সে সাক্ষাৎকারটি এখনো পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার সময় অপারেশনে যারা সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছিল, শুধু তাদের অভিযুক্ত করে তদন্ত ও বিচারকার্য সম্পন্ন করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের কুশীলবদের বিরুদ্ধে এখনো কিছু করা হয়নি। অথচ তারাও বঙ্গবন্ধু হত্যার দায় থেকে অব্যাহতি পেতে পারে না।

গ্রেনেড হামলা

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার লক্ষ্যেই এ গ্রেনেড হামলা করা হয়েছিল। ওই হামলায় আইভি রহমানসহ ২৪ জন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী নিহত হন। তিন শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়। শেখ হাসিনা নিজেও আহত হন। সংসদে বিরোধী দলের নেতা ও একটি ঐতিহ্যবাহী বৃহৎ রাজনৈতিক দল, যার নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই দলের প্রধানসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করার এমন ঘটনা অত্যন্ত জঘন্য ও কলঙ্কজনক।

ঘটনার পরের দিনই পুলিশকে বাদী বানিয়ে মতিঝিল থানায় একটি মামলা রুজু করা হয়। আওয়ামী লীগ অথবা কোনো ভিকটিম বা ভিকটিমের কোনো আত্মীয়স্বজন কেউ মামলা সম্বন্ধে কিছু জানে না। পরের দিন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা মামলা দিতে থানায় গেলে ওই ঘটনার মামলা হয়েছে বলে পুলিশ নতুন করে মামলা নেয়নি।

সিআইডি তদন্তভার গ্রহণ করে প্রকৃত হামলাকারীদের খুঁজে বের করার পরিবর্তে জনৈক ছিঁচকে অপরাধী জজ মিয়াকে নোয়াখালী থেকে গ্রেফতার করে। জজ মিয়া ও তার সহযোগীরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে প্রচার করা হয়। পুলিশ জজ মিয়াকে দিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করারও ব্যবস্থা করে। সিআইডি থেকে জজ মিয়ার পরিবারকে মাসে মাসে টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সিআইডি মগবাজার এলাকার এক আওয়ামী লীগ নেতাকেও এ মামলায় গ্রেফতার করে। পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়, প্রকৃত ঘটনা অন্য খাতে প্রবাহিত করে আসল অপরাধীদের বাঁচানোর জন্যই জজ মিয়া নাটক সাজানো হয়েছিল। বিভিন্ন মিডিয়াকর্মীই জজ মিয়া কাহিনি উদ্ঘাটন করেন। পুলিশের বিএনপিপন্থি কতিপয় অফিসারকে দিয়ে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকার এ নাটকের অবতারণা করেছিল।

তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকার এ ঘটনায় বিচারপতি জয়নুল আবেদীনকে দিয়ে এক সদস্যবিশিষ্ট বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। এ কমিটিও সত্য উদঘাটন করতে আন্তরিক ছিলেন না। কমিটি ভারতের প্রতি দোষারোপের অঙ্গুলি প্রদর্শন করে প্রতিবেদন দাখিল করে। জনগণের আইওয়াশের জন্যই বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফবিআইকে আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছিল।

২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর নতুন করে মামলা তদন্ত শুরু হয়। নতুন তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। তদন্ত শেষে তদন্তকারী কর্মকর্তা মুফতি হান্নান ও বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালামসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। চার্জশিটে কিছুসংখ্যক সরকারি ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার ইঙ্গিত ছিল। কেয়ারটেকার সরকারের সময়ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তার প্রভাবে সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। ওই কর্মকর্তাও ১৫ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায় জড়িত ছিল। পরবর্তীকালে তার বিরুদ্ধেও অভিযোগপত্র দাখিল হয় এবং বিচারে তার সাজা হয়।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। আদালত থেকে বর্ধিত তদন্তের অনুমতি পেয়ে সিআইডি আবার তদন্ত শুরু করে। নতুন তদন্তকারী অফিসারও নিয়োগ হয়। তদন্তকারী অফিসার মুক্ত পরিবেশে তদন্ত করার সুযোগ পায়। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই কর্তৃক বাংলাদেশে মোতায়েনকৃত এ মামলায় গ্রেফতারকৃত পাকিস্তানি জঙ্গি মজিদ ভাট ওরফে ইউসুফ ভাটের আদালতে দেওয়া দীর্ঘ ১৬৪ ধারার জবানবন্দি এবং মুফতি হান্নানের জবানবন্দিতে হামলার পরিকল্পনা, পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ, গ্রেনেডের উৎস ও সরবরাহ এবং অপারেশন সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। আদালতের কাছে প্রদত্ত আসামিদের জবানবন্দি, নিরপেক্ষ ও নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য ও পারিপার্শি^ক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে পুলিশি তদন্তে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়, হাওয়া ভবনের পরিকল্পনায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ও সরকারের অন্যান্য মেশিনারি ব্যবহার করে হুজির নেতা মুফতি হান্নান ও অন্য জঙ্গিদের ভাড়া করে এ গ্রেনেড হামলা করা হয়েছিল।

২০১১ সালের ৩ জুলাই সিআইডি ৩০ জন নতুন আসামি যোগ করে সর্বমোট ৫২ জন আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে। এ ৩০ জনের মধ্যে ছিল তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, জামায়াতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান মুজাহিদ, বিএনপি নেতা কায়কোবাদ, ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের সাবেক ডিজি জেনারেল রহিম ও জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার, পুলিশের তিন সাবেক আইজিসহ বাকিরা।

চার্জশিট গ্রহণ করে আদালত বিচার কাজ শুরু করেন। এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করতে প্রায় ছয় মাস লাগে। আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করতে সাধারণত এক-দুই দিনের বেশি লাগার কথা নয়। কিন্তু আসামি পক্ষের উকিলের নানা আপত্তি ও চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে চার্জ গঠন করতে এতদিন লেগেছিল। আদালত রায় ঘোষণা করেন ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবরে। তদন্ত শেষ করতে সময় লেগেছে প্রায় ৭ বছর এবং বিচার শেষ করতে সময় লেগেছে ৭ বছর ৩ মাস। ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার করলে বিচার কাজে অনেক কম সময় লাগত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও বিতর্কহীন বিচার চেয়েছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ তদন্ত ও বিচার হলেই প্রকৃত অপরাধীরা সাজা পাবে।

ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী যে মামলার ভিকটিম এবং তার দলের ২৪ জন নেতাকর্মী যে ঘটনায় নিহত হয়েছেন এবং তিন শতাধিক আহত হয়েছেন, সে মামলার বিচারকার্য শেষ করতে ৭ বছরের বেশি সময় লেগেছে। আমি লক্ষ করেছি, এ মামলার বিচার বিলম্বিত করতে আসামিপক্ষ নানা কৌশল নিয়েছে। বিলম্বিত করতে সক্ষমও হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিত্ব বা কোনো মন্ত্রী কিংবা কোনো নেতা এ মামলার ব্যাপারে মাথা ঘামাননি। তারা মামলার বিচার কাজ দ্রুত শেষ করার ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া তো দূরের কথা, খবরও তেমন একটা নেননি। কাজেই মামলার তদন্ত ও বিচারকার্য স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ পদ্ধতিতেই হয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হত্যার তদন্ত ও বিচার নিয়ে কেউ কোনো বিতর্ক উপস্থাপন করলে তা কেবল হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই করবেন।

এ কথা জোরেশোরেই বলা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যা ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার বিচার নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হওয়ায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আইনের শাসনের দৃষ্টান্তই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে

এ কে এম শহীদুল হক : সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877