স্বদেশ ডেস্ক:
বয়স মাত্র ২২ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স শেষবর্ষের শিক্ষার্থী। এ বয়সেই কোম্পানি খুলে চটকদার বিজ্ঞাপনে ক্রেতা জুটিয়ে মাত্র সাত মাসে হাতিয়ে নিয়েছেন ১০০ কোটি টাকারও বেশি। এ কাজে শুরুর দিকে ব্যবহার করেছেন ঢাবির সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থীদের। পরে কোম্পানির কার্যক্রম ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশব্যাপী। লক্ষাধিক ক্রেতার অর্ডার নিয়ে এখন আর পণ্য দিচ্ছেন না। এমনকি বন্ধ করে দিয়েছেন অফিসও। কল সেন্টারও বন্ধ, ফোন ধরছেন না কেউ। দেশব্যাপী প্রতারণার জাল বিছানো কোম্পানির নাম ‘আলাদিনের প্রদীপ’। কোম্পানির মালিক মেহেদী হাসান মুন আলাদিনের প্রদীপ হাতে পেলেও আর্তনাদ করছেন টাকা দিয়ে পণ্যের অপেক্ষায় থাকা ক্রেতারা।
এ বিষয়ে জানতে আলাদিনের প্রদীপের সিইও মেহেদী হাসান মুনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ফেসবুকে অভিযোগ ও প্রশ্ন লিখে পাঠালেও উত্তর দেননি। হোয়াটসঅ্যাপে বারবার ফোন করা হলেও কেটে দেন তিনি। এর পর প্রশ্ন লিখে পাঠালেও কোনো উত্তর দেননি। আলাদিনের প্রদীপের ফেসবুক পেজেও প্রশ্ন পাঠিয়ে উত্তর মেলেনি।
গত বছরের আগস্টের শুরুতে রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই অনলাইন শপ হিসেবে যাত্রা শুরু করে আলাদিনের প্রদীপ। চলতি বছর রেজিস্ট্রেশন করে কোম্পানিটি। মাত্র আড়াই লাখ টাকা বিনিয়োগে ছয়জনের উদ্যোগে ব্যবসা শুরু হলেও কিছুদিন না যেতেই বাদ দেওয়া হয় পাঁচজনকে। কোম্পানির সিইও হিসেবে রয়েছেন মেহেদী হাসান মুন। ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করা হতো ঢাবিকে। ঢাবিয়ান বিজনেস কমিউনিটি (ডিবিসি) নামে একটি গ্রুপের মাধ্যমে ক্রেতা জোগাড় করতেন। বিভিন্ন স্বল্পদামি পণ্য যথাসময়ে বিক্রি করে আস্থা অর্জন করে আলাদিনের প্রদীপ। চলতি বছরের শুরু থেকেই চটকদার বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। বিভিন্ন পণ্যে বিশাল ছাড়ও দেওয়া হয়। এর পরই মানুষ হুমড়ি খেয়ে অর্ডার দেওয়া শুরু করে। প্রথম কয়েক দফা ছাড়ের বিজ্ঞাপনে প্রায় লাখখানেক ক্রেতা জোগাড় হয়ে যায়। কোম্পানি ছড়িয়ে যায় দেশব্যাপী।
মূলত এক টাকায় ডেলিভারি, দেশের প্রথম শিক্ষার্থীভিত্তিক ই-কমার্স প্ল্যাটফরম ইত্যাদি নানা চটকদার বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয় সাধারণ মানুষ। গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত তিনটি অফারে অর্ডার পড়ে প্রায় লাখখানেক। সবশেষ জুনের অফারে ৬১ হাজারেরও বেশি ক্রেতা আলাদীনের প্রদীপে নানা পণ্য অর্ডার করেন। সর্বশেষ তিনটি অফারে বেশিরভাগই ছিল মোটরসাইকেল, ফ্রিজ, মোবাইল ফোনসহ দামি পণ্য। এর পরই পাল্টে যেতে থাকে আলাদীনের প্রদীপের চরিত্র। ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রাখা হয়। এমনকি বন্ধ কল সেন্টারও। যারা বেশি বেশি যোগাযোগের চেষ্টা করেন তাদের ফেসবুক গ্রুপ এবং পেজ থেকে ব্লক করে দেওয়া হয়। এমন অভিযোগ অনেকের।
বিশাল প্ল্যাটফরমে ব্যবসা করলেও ঢাকায় কোম্পানিটির কোনো স্থায়ী অফিস নেই। ঠিকানা হিসেবে কেবল লেখা হতো ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়। ওয়েবসাইটে অফিসের যে ঠিকানা বলা হয়েছে সেই অফিস বন্ধ পাওয়া গেছে। এর আগে কোম্পানির সিইও মুন দাবি করেছিলেন চারটি অফিস রয়েছে তাদের, সবক’টিই সিরাজগঞ্জে।
আলাদিনের প্রদীপের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, প্রায় লাখখানেক অর্ডারের বিপরীতে পণ্য সরবরাহ করা হয়নি। এর আনুমানিক মূল্য ১০০ কোটি টাকারও বেশি। অর্ডারগুলো নেওয়ার পর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে অফিস। কোম্পানির সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, মেহেদী হাসান মুন ক্রেতাদের থেকে টাকা নিয়ে অন্য ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন। এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে অন্য উদ্যেক্তাদের একে একে বাদ দেওয়া হয়। কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন বলেন, শুরু থেকে আস্থা অর্জনই ছিল লক্ষ্য। এর পর থেকেই পিরামিড সার্কেলে ব্যবসায় নামতে চান মুন। অর্থাৎ প্রতি সপ্তাহে বিক্রি দ্বিগুণ করা। ব্যবসায়িক পলিসির বিরোধিতা করায় একের পর এক বাদ দেওয়া হয়েছে উদ্যোক্তাদের। তিনি আরও বলেন, চলতি বছরের শুরু থেকেই আলাদিনের প্রদীপ থেকে টাকা সরানো শুরু করেন মুন। গড়ে তোলেন অন্য প্রতিষ্ঠান। সেগুলো তার আত্মীয়দের দিয়ে পরিচালনা করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মুন গত এক-দেড় বছরে চালু করেছেন কয়েকটি কোম্পানি। অর্থ ঢালছেন বিভিন্ন পার্টনারশিপ ব্যবসায়। কিনেছেন জমিও। ড্রিমার্স টেলিকম, মাইন্ডিবিডি আইটি কেয়ার, ভিভো এক্সক্লুসিভ শোরুম, মাল্টিব্র্যান্ড মোবাইল প্লাজাসহ বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার। সিরাজগঞ্জে জমি কেনার পাশাপাশি ঢাকায় শুরু করেছেন ট্রেডিং ব্যবসাও। স্থানীয়রা বলছেন, মুনের বাবা মারা যান প্রায় ২০ বছর আগে। এর পর মা অনেক কষ্টে বড় করেছেন তাকে।
কেবল ঢাবির সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যেই প্রায় আড়াই হাজারের বেশি অর্ডার রয়েছে আলাদিনের প্রদীপে। এর মধ্যে একজন শোয়েবুল ইসলাম। তিনি বলেন, একটি বাইক ও একটি মোবাইল ফোন অর্ডার করেছিলাম। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর পর থেকে ফোন ধরছে না আলাদিনের প্রদীপের কেউ। কোনো মাধ্যমেই যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ রিয়াজুল। চিকিৎসার টাকারও সংকট। প্রায় দেড় লাখ টাকার পণ্য অর্ডার করেছিলেন তিনি। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও সেই পণ্য পাননি। এমনকি টাকা ফেরতের আবেদন করলেও এখন আর ফোন ধরছে না আলাদিনের প্রদীপ।
সবচেয়ে করুণ অবস্থায় রয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এ অনলাইন শপটিতে অর্ডার করা বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ। রাজধানীতে কোনো অফিস না থাকায় তারা কোনোভাবেই কোম্পানিটির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। কাস্টমার কেয়ারে ফোন করলেও রিসিভ করছে না কেউ। এমনই একজন আবদুল মোতালেব, পেশায় স্কুল শিক্ষক। নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা মোতালেব এক শিক্ষার্থীর কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি মোটরসাইকেল অর্ডার করেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘদিনের চেষ্টায়ও সেটি পাননি তিনি।
কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম পরিবারের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকার অর্ডার করেছিলেন। এখন চোখে শর্ষে ফুল দেখছেন, পরিবারের সদস্যরাও কটুকথা বলছেন। কোম্পানিটি নিয়ে অনেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন ফেসবুকে। প্রতারিত হওয়ার বিভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে সেখানেও।