স্বদেশ ডেস্ক:
২০ দলীয় জোট নিয়ে বিএনপির ওপর শরিকদের ক্ষোভ বাড়ছে। বিএনপি ‘একলা চলো নীতি’তে চলার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন শরিকরা। তাদের দাবি, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর সংসদে যাওয়া, বিভিন্ন কর্মসূচি, উপ-নির্বাচনে যাওয়া আবার পরে বর্জনসহ নানা ইস্যুতে শরিকদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই একক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। আড়াই বছরে মাত্র কয়েকটি বৈঠক করেছে।
রাজনৈতিকভাবে শরিকদের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। এ অবস্থায় ২০ দলীয় জোট রাখবে কিনা-বিএনপির কাছে জানতেও চেয়েছেন শরিকদের কেউ কেউ। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মতো আরও কয়েকটি দল জোট ছাড়তে পারে।
তবে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা দাবি করেছেন, ২০ দল ভাঙার পেছনে সরকারের ভূমিকা রয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপিকে দুর্বল করতে বিকল্প আরেকটি জোট গঠনের তৎপরতা চলছে। বিএনপির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে জোট ছাড়ার ঘটনা ওই প্রক্রিয়াই একটি অংশ।
নেতারা আরও বলেন, ২০ দল একটি নির্বাচনী জোট। বড় দল হিসাবে বিভিন্ন কর্মসূচিসহ নানা ইস্যুতে বিএনপির একক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে। সেখানে ক্ষোভ বা হতাশার কিছু নেই। নানা ষড়যন্ত্রের মধ্যেও জোটের ঐক্য অটুট আছে।
জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ২০ দলীয় জোটে কোনো টানাপোড়েন নেই। সরকার জোট ভাঙার চেষ্টা চালাচ্ছে। জোটের শরিকদের সঙ্গে নিয়মিত তাদের যোগাযোগ রয়েছে। আগের চেয়ে জোট আরও বেশি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ।
এ প্রসঙ্গে জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান অনির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে বিএনপি একাধিকবার বলেছে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে চায়। সে ক্ষেত্রে বিদ্যমান ঐক্য তো ভেঙে যাচ্ছে। তারা যদি বিদ্যমান ঐক্য রক্ষা করতে না চায় অথবা না পারে তাহলে আগামী দিনের বৃহত্তর ঐক্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়াটাই খুব স্বাভাবিক। আমরা বৃহত্তর ঐক্যে বিশ্বাস করি। তাই বিএনপি যেন অনুগ্রহপূর্বক বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে সমাধান করে। অর্থাৎ ২০ দলীয় জোট তারা কি রাখতে চায়, নাকি রাখতে চায় না-এর একটি সুস্পস্ট ইশারা দিলে সবার জন্য ভালো।
সৈয়দ ইবরাহিম বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আমরা জোট ত্যাগ করে সরকারি পক্ষে বা আনুকূল্যে যাওয়ার প্রস্তাব কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। তা করেছি ২০ দলীয় জোটে থাকব বলে। কিন্তু সেই ত্যাগ স্বীকারের মূল্যায়ন হলো কি হলো না-তা আমাদের জানা দরকার।
জোটের শরিক দল হিসাবে যথাযথ মূল্যায়ন না করাসহ কয়েকটি অভিযোগ তুলে বুধবার জোট ছাড়ার ঘোষণা দেন ২০ দলের শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।
এ সময় দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা বাহাউদ্দিন জাকারিয়া বলেন, শরিকদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই উপনির্বাচন এককভাবে বর্জন করা, আলমদের গ্রেফতারের প্রতিবাদ না করা, প্রয়াত জমিয়ত মহাসচিব নূর হোসেন কাসেমীর মৃত্যুতে বিএনপির পক্ষ থেকে সমবেদনা না জানানো এবং তার জানাজায় শরিক না হওয়া জোট ত্যাগের কারণ। এর আগে গত কয়েক বছরে আন্দালিভ রহমান পার্থের দল বিজেপি, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ ন্যাপ, এনডিপি, এনপিপি, লেবার পার্টির একাংশ বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ত্যাগ করে।
জোটে থাকা কয়েকটি দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকেই নানা ইস্যুতে শরিকদের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়াকে কেন্দ্র করে জোটের কয়েক শরিক ক্ষুব্ধ হয়। সেটা এখনো অব্যাহত আছে।
জোটের শরিক জাগপাকে কোনো আসন না দেওয়ায় অসন্তুষ্ট হয়ে দলটির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধান পরবর্তী কোনো বৈঠকেই অংশ নেননি। বরং এ ইস্যুতে জাগপা দু’ভাগ হয়েছে। এজন্য বিএনপিকে দুষছেন দলটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত শফিউল আলম প্রধানের মেয়ে তাসমিয়া প্রধান।
জোটের সব ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের দূরত্বে রাখছে অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামী। এ ছাড়াও জাতীয় এক্যফ্রন্ট গঠনকে কেন্দ করে বিএনপির ওপর নাখোশ ছিল ২০ দলের শরিকরা। সে সময় এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদের নেতৃত্বে ‘জাতীয় মুক্তিমঞ্চ’ নামের বিকল্প জোটও গঠন করা হয়। পরে এ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে অলির দূরত্বের সৃষ্টি হয়; যা এখনো পুরোপুরি ঠিক হয়নি।
জোট নেতারা জানান, শরিকদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ নিরসনে এখনো কার্যকর কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না। দীর্ঘদিনের শরিক বিজেপি কেন জোট ছাড়ল, তা গভীরভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন ছিল। চাওয়া-পাওয়া বা ক্ষোভ থেকেই পার্থ জোট ছেড়েছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এমন ক্ষোভ তো অন্য শরিকদের মধ্যেও থাকতে পারে। সেগুলো নিরসন করা সম্ভব না হলে ভবিষ্যতে আরও অনেকেই জোট ছেড়ে চলে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
এখন জোটে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে বিএনপিসহ মাত্র পাঁচটি। বাকি যারা রয়েছেন তাদের বেশির ভাগের দলের কোনো অস্তিত্ব নেই। তারা ওয়ান ম্যান শো রাজনীতি করেন। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলও যদি জোট ছাড়ে তাহলে তো জোটের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের জোট ছাড়া প্রসঙ্গে ২০ দলের সমন্বয়ক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, তারা যে অভিযোগ করেছেন তা ঠিক না। জোটের কার্যক্রম, জোটের সিদ্ধান্ত সবই শরিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে হয়। তবে তাদের অনেকে গ্রেফতার আছেন, মাদ্রাসা খুলতে পারছেন না। জোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে যদি তাদের নেতাদের মুক্ত করতে পারেন, তারা যে বিপদে আছে তা থেকে নেতাকর্মীরা মুক্ত হন তবে বন্ধুপ্রতিম দল হিসেবে আমরা খুশিই হব।
তিনি দাবি করেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বুধবার দুপুরে জোট ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। এ থেকেই বুঝা যায় কেন তারা জোট ছেড়েছেন।
যদিও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের আরেকটি অংশ এখনো ২০ দলীয় জোটে রয়েছে। এই অংশের সিনিয়র একনেতা জানান, কাসেমী অংশ জোট ছেড়ে দেওয়ায় এখন তাদের ওপরও জোট ছাড়ার চাপ সৃষ্টি হতে পারে।