শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৫:১৮ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
কোন পথে মিয়ানমার

কোন পথে মিয়ানমার

ড. তারেক শামসুর রেহমান: গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর প্রায় এক মাস হতে চলল সেখান থেকে যেসব খবরাখবর আসছে তাতে করে দেশটির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তবে মিয়ানমার যে এখনো আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় অন্যতম আলোচিত বিষয় হয়ে আছে, তার বড় প্রমাণ ২২ ফেব্রুয়ারির বিবিসি ইংরেজির প্রধান সংবাদ ছিল মিয়ানমারকে নিয়ে। সেখানে সামরিক জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ শক্তিশালী হচ্ছে এবং তা ছড়িয়ে যাচ্ছে বড় শহরগুলোতে।

পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন দুজন- এর মাঝে একজন ছিলেন ২০ বছরের তরুণী মায়া তাহবেহ খাইং। মায়া এখন মিয়ানমারে ‘প্রতিবাদের প্রতীকে’ পরিণত হয়েছেন। তিনি সামরিক অভ্যুত্থানের প্রতিবাদ করে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালালে মায়া নিহত হন। গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাজধানী নেপিদোতে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যে লোক জমায়েত হয়েছে, তা স্মরণকালের একটি বড় ঘটনা।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ ধরনের সহিংস ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। মিয়ানমারে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তারা এ ঘটনায় ‘গভীরভাবে বিক্ষুব্ধ’। এর আগে জাতিসংঘ ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি করেছিলেন। মিয়ানমারের শীর্ষ জেনারেলদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল অনেক আগেই।

কিন্তু যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানবিরোধী জনমত যেভাবে শক্তিশালী হচ্ছে তা কি দ্বিতীয় আরেকটি জাফরান বিপ্লব বা স্যাফরন রেভ্যুলেশন (২০০৭)-এর জন্ম দেবে? সেই সঙ্গে এ প্রশ্নটিও কোনো কোনো মহল থেকে উচ্চারিত হয়েছে- তা হচ্ছে এই গণবিক্ষোভ কি ১৯৮৭-৮৮ সালের মতো পরিস্থিতির জন্ম দেবে? পার্শ্ববর্তী ভারত ও চীনের ভূমিকাই বা কী হবে এখন? প্রায় ১৪ বছর আগে মিয়ানমারে যে স্যাফরন রেভ্যুলেশন (ঝধভভৎড়হ জবাড়ষঁঃরড়হ) হয়েছিল, আজকের পরিস্থিতির সঙ্গে তা মেলানো যাবে না।

মিয়ানমারের রাজনৈতিক উন্নয়নে স্যাফরন রেভ্যুলেশনের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। অন্যান্য দেশের ‘বালার রেভ্যুলেশন’ সঙ্গে এই বিপ্লবকে মেলানো যায়। ২০০৭ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মিয়ানমারে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ পরিচালিত হয়েছিল তা মিয়ানমারের ইতিহাসে স্যাফরন রেভ্যুলেশন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ওই বিপ্লবের পুরো ভাগে ছিলেন বৌদ্ধধর্মের ভিক্ষুরা, অর্থাৎ বৌদ্ধধর্মের (খেরাভেদা) ধর্মীয় ব্যক্তিরা ও সেই সঙ্গে ছাত্ররা। সামরিক জান্তা জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করলে (পেট্রল/ডিজেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছিল শতকরা প্রায় ১০০ ভাগ, আর সিএনজিচালিত বাসে শতকরা ৫০০ ভাগ বৃদ্ধি), ধর্মীয় নেতারা এর প্রতিবাদে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিলেন।

ধর্মীয় নেতারা শরীরে যে চাদর ব্যবহার করতেন তা ছিল স্যাফরন বা জাফরানি রঙের যা কিনা হলুদ ও লাল রঙের মিশ্রণে নতুন এক রঙ। বৌদ্ধ ভিক্ষু বা ধর্মীয় ব্যক্তিরা এই চাদর সব সময় ব্যবহার করেন। সম্ভবত এ কারণেই সামরিক জান্তাবিরোধী ওই আন্দোলন চিহ্নিত হয়েছিল স্যাফরান রেভ্যুলেশন হিসেবে। ওই ‘রেভ্যুলেশন’ বেশকিছু পরিবর্তন সাধন করেছিল মিয়ানমারে। যেমন ওই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছিল বৌদ্ধধর্মের ভিক্ষুরা অর্থাৎ ধর্মীয় ব্যক্তিরা মিয়ানমারে একটি শক্তি। শান্তিপূর্ণ ও অহিংস পদ্ধতিতে তারা পরিবর্তন আনতে চায়। ওই বিপ্লব সামরিক জান্তাকে সংস্কারে যেতে বাধ্য করেছিল এবং ওই বিপ্লবের রেশ ধরে সামরিক জান্তা শেষ অবধি ২০১৫ সালে নির্বাচন দেয় ও যার মাধ্যমে অং সান সু চি ক্ষমতাসীন হন।

বৌদ্ধ ভিক্ষুদের গায়ের ‘স্যাফরন’ রঙের চাদর একটি বিপ্লবের প্রতীক হয়ে উঠেছিল মিয়ানমারে। অহিংস পদ্ধতিতে যে সরকারকে বাধ্য করানো যায় সংস্কারে যেতে মিয়ানমারের স্যাফরন রেভ্যুলেশন ছিল তার বড় প্রমাণ। কিন্তু ২০২১ সালে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ ঘনীভূত হচ্ছে তার সঙ্গে স্যাফরন রেভ্যুলেশনের মিল খুঁজে পাওয়া হয়তো যাবে না। কেননা এখন অবধি বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তাদের বিখ্যাত জাফরানি রঙের চাদর গায়ে জড়িয়ে বিক্ষোভে অংশ নেননি। ফলে এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না বৌদ্ধধর্মীয় নেতারা সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণকে কতটুকু সমর্থন করছেন।

এটা ঠিক স্যাফরন রেভ্যুলেশন সফল হয়নি। কিন্তু এর একটা আবেদন রেখে গেছে। অর্থাৎ বৌদ্ধরা যে শান্তির কথা, অহিংস নীতির কথা প্রচার করেন শুধু তাই নয়, বরং রাজনৈতিকভাবেও তারা যে বড় একটি শক্তি, মিয়ানমারের প্রেক্ষাপটে তারা তা প্রমাণ করেছিলেন। সেনাবাহিনীর প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, এখানে যে তারা অতীতে এই ভিক্ষুদের তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতেন, বর্তমানে সেনাবাহিনীবিরোধী যে গণআন্দোলন গড়ে উঠছে তার সঙ্গে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা নিজেদের সম্পর্কিত করেননি। সেনাবাহিনীর প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে এখানেই। নেপিদো, মান্দালয়, রেঙ্গুন প্রভৃতি বড় বড় শহরে বিক্ষোভ হচ্ছে। কোথাও কোথাও সরকারি কর্মচারীরা সরকারের হুশিয়ারি উচ্চারণ উপেক্ষা করে গণজমায়েতে যোগ দিয়েছেন। ডাক্তাররা কর্মবিরতিতে গেছেন। তা হলে কি মিয়ানমারে আবারও ক্ষমতার পালাবদলের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে?

পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিই, ১৯৮৭-৮৮ গণবিক্ষোভের সময় জেনারেল উ সান ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন সিভিলিয়ান মংমং। ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বরে জেনারেল সুমং তাকে উৎখাত করেন। এর পর জেনারেলরা নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। ১৯৯০ সালের ২৭ মে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে অং সান সু চির দল বিজয়ী হলেও তাকে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি, বরং বন্দি করা হয়েছিল। এর অনেক পরে ১৯৯৭ সালে সেনাবাহিনী গঠন করেছিল ‘স্টেট পিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল।’ এরাই পরে গঠন করে ‘ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি।’ এই দলটি সেনাবাহিনী সমর্থিত। এই দলটিকে সামনে রেখেই সেনাবাহিনী তাদের স্বার্থ আদায় করে। যদিও সর্বশেষ ািনর্বাচনে (২০২০) দলটি ভালো করেনি। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে জেনারেল মিন অং হ্লাইং এখন এই দলটিকে সামনে রেখে নির্বাচন দিতে পারেন এবং দলটিকে ‘বিজয়ী’ করে নিজের ক্ষমতাকে আরও বাড়াতে পারেন। অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে এখন অং সান সু চির বিচার হবে। তাতে ফৌজদারি অপরাধে তিনি দ-িত হবেন(?) এবং আগামী ািনর্বাচনে তিনি অযোগ্য ঘোষিত হবেন- এ ধরনের একটি ‘গুজব’র জন্ম হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, সেনাবাহিনী এ ধরনের দল গঠন করে। ইন্দোনেশিয়ায় সুহার্তো জমানায় ‘গোলকার’-এর জন্ম দিয়ে সংসদে সেনাসদস্যদের প্রতিনিধিত্ব তিনি নিশ্চিত করেছিলেন। মিয়ানমারের মডেল অনেকটা তেমনি। এর মধ্য দিয়ে অং সান সু চির রাজনৈতিক ‘জীবন’-এর ‘মৃত্যু’ হতে যাচ্ছে!

১৯৪৫-এ জন্ম নেওয়া সু চির বয়স এখন ৭৫। তার পক্ষে আর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা সম্ভব হবে না। ২০২২ সালে যে নির্বাচন হবে, তাতে যদি তিনি অংশ নিতে না পারেন, তা হলে তার কোনো রাজনৈতিক ক্যারিয়ার আর থাকবে না। শুধু তাই নয়, জেনারেল মিন অং হ্লাইং তার দল এনএলডিকেও ভেঙে ফেলতে পারেন। অতীতেও এ রকমটি হয়েছিল। ২০১০ সালের নির্বাচনে এনএলডি অংশ নেয়নি। পরে উপনির্বাচনে (২০১২ এপ্রিল) বিজয়ী হয়ে সু চি পার্লামেন্টে এসেছিলেন (তার দল উপনির্বাচনে ৪৫টি আসনের মধ্যে ৪৩টি আসনে বিজয়ী হয়েছিল)। ২০২১ সালে এসে পরিস্থিতি ভিন্ন। রোহিঙ্গা গণহত্যায় প্রকাশ্যে সেনাবাহিনীকে সমর্থন করায় এবং সেখানে কোনো গণহত্যা হয়নি বলে দাবি করায় আন্তর্জাতিক পরিসরে তার গ্রহণযোগ্যতা এখন আর নেই। কৌশলে সেনাবাহিনী তাকে ব্যবহার করে, এখন তাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।

তাই এটা এখন স্পষ্ট নয়- মিয়ানমার কোন পথে যাচ্ছে? আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘উদ্বেগ’, যে কোনো ‘ব্যবস্থা’ মিয়ানমারকে বাধ্য করবে না ক্ষমতা সিভিলিয়ানদের কাছে ফিরিয়ে দিতে। মিয়ানমারের সেনাশাসকরা এই বিষয়টিকে আদৌ গুরুত্ব দেন না। তারা জানেন ভূরাজনীতির কারণে পার্শ্ববর্তী দুটি বড় দেশ চীন ও ভারত সেনাবিরোধী কোনো অবস্থানে যাবে না। চীন এখন অবধি কোনো বড় ধরনের ‘প্রেসার’ তৈরি করেনি। যাতে করে সেনাবাহিনীর ‘অবস্থান’ দুর্বল হয়। ভারতের অবস্থানও অনেকটা তেমনি। ভারতেরও যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে মিয়ানমারে। মূলত চীন ও ভারত মিয়ানমারের রাজনৈতিক সরকারের চেয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গেই সম্পর্ক রক্ষা করে আসছে। ভারতের ‘বিদ্রোহী’দের দমন (যারা মিয়ানমারের জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে নাশকতা চালায়) এবং মিয়ানমার-থাইল্যান্ড-ভারত মহাসড়কে সংযুক্তির প্রশ্নে সেনাবাহিনীর সমর্থন ভারতের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

ভারতের ‘লুক ইস্ট পলিসি’ ও ‘ইস্ট-ওয়েস্ট ইকোনমিক করিডর’ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের রাজনৈতিক সরকারের চেয়ে সেনাবাহিনীর সমর্থন ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীনেরও স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ রয়েছে। রাখাইনের কুধঁঃঢ়যুঁ গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে ইউনান প্রদেশ পর্যন্ত রেলপথ ব্যবহার ও গভীর সমুদ্র থেকে উত্তোলিত গ্যাস ও তেল এই পথে সরবরাহ- এটা নিশ্চিত করার ব্যাপারে সেনাবাহিনীর সমর্থন চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই পরোক্ষভাবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী চীন ও ভারতের সমর্থন নিশ্চিত করেছে। আর এই সমর্থনই মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে পারে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, মিয়ানমারে সেনাবাহিনী একটি ‘রাজনৈতিক শক্তি’। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে সেনাবাহিনী কোনো ‘রাজনৈতিক ভূমিকা’ পালন করে না। কিন্তু মিয়ানমারের ইতিহাস একটু ভিন্ন ধরনের। মিয়ানমারের ৭৩ বছরের ইতিহাসে দীর্ঘ সময় সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশটি শাসন করেছে। ফলে সেখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদন ব্যবস্থা অনেকটাই সেনাবাহিনীনির্ভর। এ অবস্থায় অং সান সু চি একটি সম্ভাবনা তৈরি করেছিলেন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশে। কিন্তু তিনি নিজে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক রেখে ক্ষমতা পরিচালনা করে গেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের করপোরেট স্বার্থে সু চিকেও তারা সরিয়ে দিল। তাই খুব সহসাই সেখানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হবে, তা মনে করার কারণ নেই। মিয়ানমারের সর্বত্র গণবিক্ষোভ হচ্ছে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এই গণবিক্ষোভ সেখানে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন ডেকে আনতে পারবে বলে মনে হয় না।

 

ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877