রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ১১:১৮ পূর্বাহ্ন

কতটা চাপে পড়বে মিয়ানমার

স্বদেশ ডেস্ক: নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ফের গত ১ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করেছে সেনাবাহিনী। এর পর গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত পাঁচ দিন কেটে গেলেও এ নিয়ে ভূ-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আলোচনা থামছে না। দেশটির অভ্যন্তরীণভাবে ও বিদেশ থেকে ক্রমেই আসছে অভ্যুত্থানবিরোধী চাপ।

মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চিসহ অন্য বন্দিদের মুক্তি দিতে এরই মধ্যে দেশটির সেনাবাহিনীকে আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো মানবাধিকার সংগঠনগুলো। মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে আনুষ্ঠানিক বৈঠকও হয়েছে।

যদিও এই বিবৃতি দেওয়ার আগে তা নিয়ে আপত্তি তুলেছিল মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে পরিচিত চীন। আবার মিয়ানমারের অভ্যুত্থান ব্যর্থ করতে যা করার প্রয়োজন তার সবই করা হবে বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন খোদ জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।

যুক্তরাষ্ট্রে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও কড়া ভাষায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রতি ক্ষমতা ছাড়া ও বন্দিদের মুক্তি দিতে বলেছেন। তার আগে অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশে মিয়ানমার দূতাবাসের সামনে হচ্ছে বিক্ষোভ।

অন্যদিকে অভ্যুত্থানের হতচকিত অবস্থা কাটিয়ে অল্প পরিসরে হলেও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। সেনা সরকারের রাজধানী ছাড়ার আলটিমেটামের মধ্যেও নেপিদোয় থেকে গিয়ে অভ্যুত্থান প্রত্যাখ্যান করে শপথ নিয়েছেন গত ৮ নভেম্বর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) ৭০ এমপি।

তরুণদের পাশাপাশি ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন নার্স, চিকিৎসকরা। নতুন করে কর্মবিরতির পাশাপাশি এবার বিক্ষোভ শুরু করেছেন দেশটির শিক্ষকরা। স্বভাবতই দেশে-বিদেশে অভ্যুত্থানবিরোধী এতো তৎপরতার মধ্যে আসলেই ক্ষমতা দখলকারী মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কতটুকু চাপে পড়বে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন।

বিশেষ করে চীন, রাশিয়া, ভারতের মতো বৃহৎ শক্তি যদি দেশটির সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে না গিয়ে তাদের মৌন অবস্থান বজায় রাখে তা হলে এই চাপে কতটুকু কাজ হবে তা নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে নিরাপত্তা পরিষদে নিন্দা প্রস্তাব আটকে চীন প্রমাণ করে দিয়েছে তারা পরোক্ষভাবে হলেও মিয়ানমারের অভ্যুত্থানের বিষয়ে কিছু বলতে চায় না। ফলে এ নিয়ে বৈশ্বিকভাবেই উদ্বেগ বাড়ছে।

থাইল্যান্ডভিত্তিক মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক দৈনিক দ্য ইরাবতির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অং জো তার লেখা এক মতামত প্রতিবেদনে দাবি করেছেন, যতক্ষণ স্বার্থে আঘাত না লাগে ততক্ষণ মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানকারীদের রক্ষা করবে চীন। ফলে অভ্যুত্থান ব্যর্থ করতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের ওপর যতই নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিক, তা নিয়ে চীনের কোনো মাথাব্যথা নেই। বরং চীন শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভূরাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করতে আগ্রহী। সে স্বার্থে আঘাত না আসা পর্যন্ত সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেবে না বেইজিং।

আবার ২০০১ সালে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৬২ সাল থেকেই মিয়ানমারের সামরিক জান্তারা আন্তর্জাতিক মহল থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। তারা সব সময় মনে করত, মিয়ানমারের ভেতরে থাকা সম্পদ দিয়ে নিজ দেশের সমস্যার সমাধান করা যাবে। ফলে আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি নিয়ে সামরিক জান্তারা খুব একটা মাথা ঘামান না।

একই সঙ্গে মিয়ানমারের ভেতরে রাজনৈতিক শক্তি গড়ে উঠতে দেয়নি সেনাবাহিনী। এ ছাড়া মিয়ানমারের রাজনীতি এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশটির বেসরকারি খাতের অর্থনীতিও সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। সরাসরি সামরিক শাসন চলার সময় দেশটির ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কিন্তু তাতে সামরিক জান্তার অস্ত্র সংগ্রহ থেমে থাকেনি। বরং ওই সময় চীন এবং ইসরায়েলের কাছ থেকে অস্ত্র ক্রয় করে দেশটি। ফলে এবারও অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে বিদেশি শক্তিগুলো যতই নিষেধাজ্ঞা দিক বা চাপ প্রয়োগ করুক তাতে দেশটির সেনাবাহিনী খুব একটা কর্ণপাত করছে বলে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞরা।

তবে কি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী একেবারেই নির্বিঘ্নে এবারও শাসন চালিয়ে যাবে? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন হলেও এবার যে এত সহজে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে না তা ধারণা করা যায়। কারণ গত ছয় বছরে সু চির নেতৃত্বাধীন সরকারের পেছনে যতই সেনাবাহিনীর প্রচ্ছায়া থাকুক, নিয়ন্ত্রিতভাবে হলেও গণতন্ত্রে অভ্যস্ত হতে শুরু করেছিল মিয়ানমারের তরুণ প্রজন্ম। তারা চায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে। তাই তো অভ্যুত্থানের পরপরই ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক মাধ্যমগুলোতে অনেকে এর বিরোধিতা করে পোস্ট দিয়েছেন।

ফলে সেনা সরকার বাধ্য হয়েছে দেশজুড়ে সংবাদ প্রচার ও ইন্টারনেট ব্যবস্থা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে। এরই মধ্যে জনগণ যেন ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ অন্য বিভিন্ন প্লাটফরমে নজিরবিহীন ফিল্টারিং চলছে। কোথাও কোথাও এখনো বন্ধ আছে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক। সেনা সমর্থিত চ্যানেল ছাড়া বন্ধ রাখা হয়েছে সংবাদমাধ্যমগুলোও। তবে এত সাবধানতার পরও কাজ হচ্ছে না। সাহস করে চিকিৎসক, শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীরা কথা বলতে শুরু করেছেন। অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে অন্তত ৭০টি হাসপাতালে ধর্মঘট শুরু করেছেন চিকিৎসক নার্সরা। গতকাল কর্মবিরতির পাশাপাশি বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষকরা। তাদের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন দেশটির কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মীরা।

আবার সু চি সরকার ক্ষমতায় থাকতেই দেশটির সেনাবাহিনী যেভাবে আগ্রাসীভাবে রাখাইন, কাচিন, কারেন অঞ্চলে আরাকান আর্মি, কেএনএলএসহ বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে, তাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব তারা মানবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। ফলে বিদ্রোহীদের হামলা ও সেনাদের পাল্টা হামলা বাড়তে পারে। এমনিতেই মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা গণহত্যাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত। তাই নতুন করে সংঘাত তীব্র হলে তাদের বিরুদ্ধে আগের অভিযোগগুলো আরও চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে। এ ছাড়া সংঘাতের ফলে দেশটি থেকে রোহিঙ্গাদের মতো আরও উদ্বাস্তু যদি অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টা করে তা হলে তা মেনে নেবে না প্রতিবেশীরা।

এ অভ্যুত্থান যে অর্থনৈতিকভাবেও মিয়ানমারকে বিপাকে ফেলতে যাচ্ছে তা স্পস্ট। বিবিসি এক রিপোর্টে বলেছে, বিশ্লেষকরা বলছেন অভ্যুত্থানের ফলে মিয়ানমারের অর্থনীতি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এরই মধ্যে দেশটিতে বিপুল পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি ও সন্দেহের কারণে মিয়ানমারে বিদেশি বিনিয়োগের বেশিরভাগটাই এশিয়াকেন্দ্রিক।

দেখা গেছে, গত বছর দেশটিতে সবচেয়ে বেশি ৩৪ শতাংশ বিনিয়োগ ছিল সিঙ্গাপুরের। এর পরই ২৬ শতাংশ বিনিয়োগ আছে হংকংয়ের। এ ছাড়া অন্যান্য দেশগুলো দেশটিতে এ বছর ৫.৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু অভ্যুত্থানের কারণে এ বিনিয়োগের বেশিরভাগটাই আসবে না ধরে নেওয়া যায়। এতে কোভিড-১৯ মহামারী পরিস্থিতির মধ্যে বিপদে পড়বে অর্থনীতি। ইয়াঙ্গুনভিত্তিক এক ব্যবসায়ী বিবিসিকে বলেন, এখন পর্যন্ত অভ্যুত্থান রক্তপাতহীন হওয়া স্বস্তির ব্যাপার হলেও মানুষ উদ্বেগে আছে। কিন্তু কোনো ধরনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এলে উল্লেখযোগ্য হারে হয়তো আমরা বিদেশি বিনিয়োগ হারাব। যা প্রভাব ফেলবে সামগ্রিক অর্থনীতিতে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877