স্বদেশ ডেস্ক:
বাংলাদেশের জন্মলগ্নের আগে থেকেই বহু রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ঘটনাবলির সাক্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি)। ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শিক্ষকসহ অনেকের কাছেই পরিচিত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ কেন্দ্র হিসেবে। তবে এবার যেন টিএসসির ভবিষ্যত নিয়ে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে। সরকার চায় বর্তমান টিএসসি ভবনটি ভেঙে সেখানে একটি বহুতল কমপ্লেক্স গড়ে তুলতে। যেখানে ছাত্র শিক্ষকদের জন্য থাকবে অত্যাধুনিক হলরুম, লাইব্রেরি, খেলার জায়গা, ক্যাফেটরিয়া, সুইমিংপুল থেকে শুরু করে নানা সুযোগসুবিধা। তবে এতে রাজি নন খোদ বিশ্ববিদ্যালয়েরই অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থী। তারা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা বিংশ শতকে নির্মিত এই স্থাপত্যটি ভেঙে ফেলা হবে ঐতিহ্য ধ্বংসের সামিল। ঐতিহ্য ধ্বংস করে এমন উন্নয়ন তারা চান না বলেও জানিয়েছেন। একই কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সাবেক শিক্ষার্থীও।
জানা গেছে, অচিরেই টিএসসি ভবনটি ভেঙে একটি আধুনিক ভবনে রূপান্তরের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। মূলত ২০২১ সালে ঢাবির শতবর্ষ পূর্তি উদযাপনের আগেই এটি করা হবে। গত ২ সেপ্টেম্বর গণপূর্ত অধিদপ্তর (পিডব্লিউডি) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক), টিএসসি ও শাহবাগ পাবলিক লাইব্রেরিকে আধুনিকীকরণের কাজে এগিয়ে আসে। সেদিন প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢামেকসহ অন্যান্য ভবন আধুনিকায়নের পরিকল্পনা অনেকখানি এগিয়ে গেলেও, টিএসসি নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে টিএসসির আধুনিকায়নের জন্য যথাযথ নকশা প্রস্তুতের নির্দেশ দিয়েছেন বলেও প্রধানমন্ত্রীকে জানান। গত ৩০ সেপ্টেম্বর এক ভার্চুয়াল আলোচনাসভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ১৯৬৪ সালে টিএসসি নির্মিত হয়েছিল। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৮০০, শিক্ষকের সংখ্যা ছিল ২০০ থেকে কিছু বেশি। এটাকে বিবেচনায় রেখে এটুকু জায়গায় টিএসসির ভবন, মিলনায়তন ও ফ্যাসিলিটিজ তৈরি করা হয়েছিল। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ হাজারের বেশি শিক্ষক আর ৪০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী আছেন। কিন্তু টিএসসি আগের মতোই আছে। প্রধানমন্ত্রী সে জন্যই আমাদের এটা পুনর্বিন্যাস করার নির্দেশনা দিলেন।
গ্রিক স্থপতি ও পরিকল্পনাকারী কন্সটান্টিন অ্যাপোস্টলোস ডক্সিয়াডেস ১৯৬০ এর শুরুতে টিএসসির বর্তমান ভবনটির নকশা করেন। পরবর্তীতে টিএসসি ভবনটি পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান সরকারের তথাকথিত উন্নয়নের দশকের অংশ হিসাবে নির্মিত হয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, টিএসসিকে নতুন করে গড়ার লক্ষ্যে এরইমধ্যে কাজ শুরু করেছে সরকারের গণপূর্ত অধিদপ্তর। নকশা প্রস্তুত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে চাহিদাপত্র নিয়েছে তারা। টিএসসির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক সৈয়দ আলী আকবর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরকে টিএসসির নতুন অবয়বে কী কী সুযোগ-সুবিধা থাকতে পারে, তার একটি তালিকাও দিয়েছেন। সম্প্রতি তালিকাটি গণপূর্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাছে জমা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তর। ঢাবির নির্বাহী প্রকৌশলী (সিভিল) মো. আব্দুল মান্নান বলেন, সরকারের গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা যখন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন, তখন তারা আমাদের জানিয়েছিলেন এটি একটি সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকের প্রকল্প হবে, পুনঃনির্মাণ নয়। টিএসসি কমপ্লেক্সটি আধুনিক সুবিধাসমূহ এবং একটি নান্দনিক ও বহুতল ভবনে পুনঃনির্মাণ করা হতে পারে। পিডব্লিউডির সঙ্গে হওয়া শেষ সাক্ষাতে তাদের সুপারিশ অনুযায়ী আমাদের প্রয়োজনীয় তালিকা জমা দিয়েছি। যদিও এখনো আমাদের পরিকল্পনার অগ্রগতি সম্পর্কে জানানো হয়নি। তবে তারা জানিয়েছে, কাজ চলছে। পিডব্লিউডির পক্ষ থেকে ঢাবি কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে, পুরো বিষয়টি সরাসরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধান ও নির্দেশনায় সম্পাদিত হচ্ছে।
সৈয়দ আলী আকবর জানান, টিএসসির নতুন ভবনে যেসব সুযোগ-সুবিধার কথা বলা হয়েছে সেগুলো হলো- সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনায় মহড়াকক্ষ, জিমনেশিয়াম, সামাজিক-সাংস্কৃতিক দলগুলোর জন্য আধুনিক সুবিধা সম্বলিত কক্ষ, আন্তঃক্রীড়া কক্ষ, ক্যাফেটেরিয়া, শিক্ষক মিলনায়তন, গাড়ি পার্কিংয়ে তিনতলা বিশিষ্ট স্থান, অতিথি কক্ষসহ আরও অনেক আধুনিক সুবিধাদি। এছাড়া তিনটি অডিটোরিয়াম থাকবে, যার একটিতে প্রায় ১৫০০ জনের বসার ব্যবস্থা ও অন্য দুটিতে ৩০০ জন করে ধারণক্ষমতা থাকবে। নতুন একটি সুইমিংপুল কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় বা তৃতীয় তলায় নির্মাণ করা হবে।
এ দিকে কৃত্রিম আধুনিকতায় টিএসিতে প্রাণের স্পন্দন অনুপস্থিত থাকবে উল্লেখ করে ফলে এটিকে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন ঢাবির শিক্ষকদের কেউ কেউ। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন- বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে টিএসসির সামাজিক রাজনৈতিক গুরুত্ব ও ঐতিহ্য আছে। এটি ভেঙে নাকি এখন বহুতল ভবন বানানো হবে! এমনিতেই মেট্রোরেল দিয়ে টিএসসির সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি চোখে ভাসছে, আর এখন বহুতল ভবন। আমরা উন্নয়ন বলতে যখন বহুতল ভবন বুঝি, তখন ‘ইতিহাস ঐতিহ্যের খেতা পুরি টাইপের’ কার্যক্রম মনটা ভারাক্রান্ত করে দিল। লাইব্রেরি ভেঙে বহুতল ভবন বানানোর কথা শুনলে তাও মনটা খুশি হতো। যেটা দরকার, সেটা করা হয় না। যেটা প্রায়োরিটি, সেটাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাবির ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী পুরনো টিএসসি ভবন ভেঙে ফেলার বিষয়ে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, এটি কখনোই হওয়া উচিত নয়। আমরা আমাদের চোখের সামনে এটিকে গড়ে উঠতে দেখেছি। এই টিএসসি চত্বর কেবলই একটি বিনোদনকেন্দ্র নয়। টিএসসি চত্বরে সবসময়ই বিশাল মাঠ ও খোলা জায়গা রয়েছে। কিন্তু নতুন পরিকল্পনায় টিএসসি প্রকৃতি ও প্রাণের স্পন্দন হারাবে। কৃত্রিমতার চাপে সাংস্কৃতিক উদারতা হারিয়ে যাবে। কেবল বহুতল ভবন নির্মাণই একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে পারে না, সাংস্কৃতিক উন্নয়নও সেখানে সমানভাবে ভূমিকা রাখে।