শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৩০ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
গুরুতর অসদাচরণে লিপ্ত রয়েছে ইসি

গুরুতর অসদাচরণে লিপ্ত রয়েছে ইসি

স্বদেশ ডেস্ক:

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বিরুদ্ধে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ তুলেছেন দেশের ৪২ বিশিষ্ট নাগরিক। তাদের ভাষায়, ইসি আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এমন সব অপরাধ করেছে, যা অভিশংসনযোগ্য। নির্বাচন কমিশনারদের আর তাদের পদে থাকার যোগ্যতা নেই। আলোচিত সুনির্দিষ্ট কিছু আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থসংশ্লিষ্ট গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ তুলে ধরে তা তদন্তের দাবিতে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন জানিয়েছেন তারা। গতকাল শনিবার এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে নাগরিকদের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়।

রাষ্ট্রপতির বরাবর দেওয়া আবেদনে ইসির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়, তা সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বিভিন্নভাবে গুরুতর অসদাচরণে লিপ্ত হয়েছেন। কমিশনের সদস্যরা একদিকে গুরুতর আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, যা অভিশংসনযোগ্য অপরাধ। একইভাবে তারা বিভিন্নভাবে আইন ও বিধিবিধানের লঙ্ঘন করে গুরুতর অসদাচরণ করে চলেছেন।

রাষ্ট্রপতি বরাবর লেখা ওই আবেদনে বলা হয়, নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত ও গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত সুনির্দিষ্ট আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থসংশ্লিষ্ট গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ তদন্তের লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।

গত ১৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির কাছে এ চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে গতকাল শনিবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। ৪২ নাগরিকের পক্ষে ওই চিঠি পাঠিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। তিনি এক সময় ইসির আইনজীবী ছিলেন। চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিভিন্ন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করে আসা অবসরপ্রাপ্ত সচিব আকবর আলি খান, অবসরপ্রাপ্ত মহাহিসাব-নিরীক্ষক এম হাফিজউদ্দিন খান, মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল, শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী।

রাষ্ট্রপতির কাছে লেখা চিঠিতে বলা হয়, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকেই বিভিন্নভাবে গুরুতর অসদাচরণে লিপ্ত হয়েছেন। কমিশনের সদস্যরা একদিকে গুরুতর আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, যা অভিশংসনযোগ্য অপরাধ। অন্যদিকে তারা বিভিন্নভাবে আইন ও বিধিবিধানের লঙ্ঘন করে গুরুতর অসদাচরণ করে চলেছেন বলে আমরা মনে করি। চিঠিতে গুরুতর অসদাচরণের কয়েকটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করার পাশাপাশি বিস্তারিত বিবরণও ওই আবেদনের সঙ্গে পাঠানো হয়েছে রাষ্ট্রপতির কাছে। চিঠিতে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তুলে ধরেছে সেগুলো হচ্ছে :

আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি এবং অর্থসংশ্লিষ্ট গুরুতর অসদাচরণ; ‘বিশেষ বক্তা’ হিসেবে বক্তৃতা দেওয়ার নামে ২ কোটি টাকার মতো আর্থিক অসদাচরণ ও অনিয়ম; নির্বাচন কমিশনের কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ৪ কোটি ৮ লাখ টাকার অসদাচরণ ও অনিয়ম; নিয়মবহির্ভূতভাবে তিনজন কমিশনারের তিনটি গাড়ি ব্যবহারজনিত আর্থিক অসদাচরণ ও অনিয়ম; অন্য গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম; ইভিএম কেনা ও ব্যবহারে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম; ঢাকা (উত্তর ও দক্ষিণ) সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোয় গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম; খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম; গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম; সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গুরুতর অসদাচরণ ও অনিয়ম।

গতকাল সংবাদ সম্মেলনে ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘আমরা সবাই মনে করেছি দায়িত্ব গ্রহণ করার পর নির্বাচন কমিশন যেসব কার্যকলাপ করেছে, সেগুলো গুরুতর অসদাচরণ। সাংবিধানিক পদে যারা আছেন তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়ালের কাউন্সিলের। দুদক বা পুলিশ এটা করতে পারবে না। রাষ্ট্রপতি এ তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন। এ প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতিকে অভিযোগ জানিয়েছি। তিনি আরও বলেন, ইসির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তদন্ত হওয়া উচিত। আমরা আশা করছি, গুরুতর অসদাচরণের দায়ে তারা দোষী হবেন। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তাদের পদ থেকে অপসারণ করবেন। এ ছাড়াও সংবিধানের ৪৮ (৫) অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদের আলোচনার জন্য উপস্থাপন করতে পারেন।’

সংবাদ সম্মেলনে শাহদীন মালিক আরও বলেন, ‘দেশে নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। নির্বাচন নির্বাচন খেলা হয়। রাষ্ট্রপতি দেশের অভিভাবক হিসেবে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য যেটা ভালো হয় করবেন। সে জন্য আমরা চিঠি দিয়েছি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনারদের অপসারণ করবেন বলে যে আশা প্রকাশ করা হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অতীতেও কিছু খারাপ নির্বাচন হয়েছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ নির্বাচন। এখন যেগুলো হচ্ছে, সেগুলোও এ রকম। এ ধরনের নির্বাচন কাম্য নয়। আমরা মনে করি, জাতি গভীর সংকট রয়েছে। গভীর সংকটে পড়লে জাতি রাষ্ট্রপতির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার একটি নৈতিক ক্ষমতা রয়েছে। আমরা নিঃসন্দেহে আশাবাদী। আশাবাদী রাষ্ট্রপতি এ অভিযোগের ইতিবাচক সাড়া দেবেন।’

আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে তিন বছর পর কেন এই অভিযোগ- জানতে চাইলে শাহদীন মালিক বলেন, ‘আমাদের অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ। এগুলো পর্যায়ক্রমে ঘটেছে। ২-৩টা অভিযোগ দিয়ে এটা করতে চাইনি। অপেক্ষা করেছিলাম, দেখেছি, পর্যবেক্ষণ করেছি। তাদের বিষয়ে অভিযোগ পত্রিকা থেকে সংগ্রহ করেছি। গুরুতর অসদাচরণ, দুর্নীতি যথেষ্ট হয়েছে। এখানে থাকার নৈতিক অবস্থান আর (তাদের) নেই। অভিযোগের পাল্লা অনেক ভারী হয়েছে। এ পর্যায়ে এসে বেশ কয়েক মাস ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।’

সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাদের এখন সরে দাঁড়ানোই ভালো হবে।’ রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করলেও তা নিয়ে কিছু হবে কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন সাবেক সচিব আব্দুল লতিফ মন্ডল, যিনি এক সময় রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিব ছিলেন। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি এটা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাবেন বলে আশা করা যায়। কিন্তু পাঠাবেন কিনা সন্দেহ আছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আলাদা করে পাঠানো যেতে পারে।’

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশন যেভাবে আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে, আগে কখনো দেখা যায়নি। আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। নির্বাচন কমিশনের নাম অবমাননা ও কলঙ্কিত করেছে। রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেছি, একই সাথে সরকারপ্রধানের কাছে যাব। প্রধানমন্ত্রীর কাছেও আবেদন করব। যতদিন সিদ্ধান্ত না হয়, ততদিন সিইসি ও কমিশনাররা স্বেচ্ছায় দায়িত্ব ছেড়ে দিতে পারেন, কেউ কেউ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে পারেন। আমরা তা আশা করব।’

চিঠিতে আরও যারা স্বাক্ষর করেছেন তারা হলেন- মানবাধিকারকর্মী ড. হামিদা হোসেন, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম, মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান, সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আহমেদ কামাল, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী জেডআই খান পান্না, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর, সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল, স্থপতি মোবাশ্বের হাসান, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, অধ্যাপক সিআর আবরার, আইনজীবী সারা হোসেন, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, লুবনা মরিয়ম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আকমল হোসেন, সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধ্যাপক স্বপন আদনান, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম, সাবেক ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, গোলাম মোর্তুজা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা, সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, ক্লিনিক্যাল নিউরোসায়েন্স সেন্টার ও বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের পরিচালক অধ্যাপক নায়লা জামান খান, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877