স্বদেশ ডেস্ক: রিফাত শরীফ হত্যার মূল আসামি নয়ন বন্ড, রিফাত ও রিশান ফরাজী এবং তাদের সাঙ্গোপাঙ্গ ‘০০৭’ মেসেঞ্জার গ্রুপে নিজেদের মধ্যে সর্বদা যোগাযোগ রক্ষা করত। এ গ্রুপের ভয়ে আতংকে দিন কাটত বরগুনার কলেজ শিক্ষার্থীসহ এলাকাবাসীর।
রিফাত হত্যার পর গ্রুপের পরিচালক নয়ন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যায়। রিফাত ফরাজীসহ গ্রুপের অনেক সদস্য গ্রেফতার হয়ে পুলিশ রিমান্ড ও জেলহাজতে রয়েছে। গ্রুপের বাকি সদস্যরা রয়েছে গোয়েন্দা নজরদারিতে। তাই ছত্রভঙ্গ হয়েগেছে গ্রুপটি, আতংক কেটেছে বরগুনাবাসীর।
ঔপন্যাসিক ইয়ান ফ্লেমিংয়ের লেখা বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র জেমস বন্ড। লন্ডনের সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস বা এসআইএসের প্রধান গুপ্তচর হিসেবে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৯৫ সালের পর এসআইএসের নাম বদলে করা হয় ‘এমআই ৬’। জেমস বন্ড ‘০০৭’ সাংকেতিক নম্বর ধারণ করেন। এখানে ডাবল-ও বা ডাবল-জিরো সংকেতের মাধ্যমে তাকে কর্তব্য পালনের প্রয়োজনে যে কাউকে হত্যা করার অনুমতি দেওয়া হত।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জেমস বন্ডকে অনুকরণ করেই বরগুনার বখাটে মাদক ব্যবসায়ী নয়ন বন্ড ‘০০৭’ মেসেঞ্জার গ্রুপ চালিয়ে আসছিল। এমনকি নয়নের প্রকৃত নাম সাব্বির আহম্মেদ নয়ন হলেও নিজেকে পরিচয় দিত ‘নয়ন বন্ড’ হিসেবে। নয়নের নেতৃত্বে দীর্ঘদিন ধরে ০০৭ নামে একটি গ্যাং গ্রুপ বরগুনা শহরের কলেজ রোড, ডিকেপি, দীঘির পাড়, কেজিস্কুল ও ধানসীড়ি সড়ক এলাকায় তাণ্ডব চালিয়ে আসতো। গ্রুপের সদস্যরা ০০৭ কে সংকেত ব্যবহার করত। ঘাতক নয়নের মোটর সাইকেল বাড়ির দেয়ালে ০০৭ বন্ড লেখা থাকতো।
বরগুনা পলিটকেনিক কলেজে অধ্যায়নরত ছাত্রদের মেসে এরা নিয়মিত হানা দিয়ে মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে টাকা পয়সা আদায়, ছিনতাই, ধানসিঁড়ি এলাকায় একসাথে ঘুরতে যাওয়া ছেলেমেয়েদের অপদস্ত করে টাকা আদায়সহ বেশ কয়েকজনকে মারধর করতো বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
এর মধ্যে ২০১৭ সালে রাকিব নামের এক কিশোরকে কুপিয়ে যখম, পরের বছর ক্রোক এলাকার ফারুক পিয়াদার ছেলে জীবনকে কুপিয়ে জখমসহ বেশ কিছু ঘটনার সাথে এই ০০৭ গ্রুপেরর সম্পৃক্ততা ছিল। এসব কাজে নয়ন সরাসরি অংশ না নিলেও তার নির্দেশনায় রিফাত ফরাজীর নেতৃত্বে গ্রুপটির সদস্যরা এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটাতো।
বরগুনা সরকারি কলেজে মেয়েদের উত্ত্যক্ত, নতুন শিক্ষার্থীদের ‘০০৭’ গ্রুপের সদস্য করাসহ ক্যাম্পাসে মাদকের আখড়া বসিয়ে ছিল রিফাত বাহিনী। ছোট ভাই রিশানের দায়িত্ব ছিল বন্ড গ্রুপের নতুন সদস্য যুক্ত করা এবং ওই সদস্যদের পর্যবেক্ষণ করা।
স্থানীয় এলাকাবাসী বলছে, নয়নের গড়া বন্ড গ্রুপের সদস্যরা শহরের কলেজ রোড, ডিকেপি, দীঘির পাড়, কেজিস্কুল ও ধানসিঁড়ি এলাকায় নানা ধরনের অপরাধ চালিয়ে আসছিল। তাদের ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারতো না।
এ গ্রুপের বিষয়ে কলেজের শিক্ষার্থী মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, রিফাত বাহিনীর অত্যাচারে শিক্ষার্থীরা অতিষ্ঠ হয়ে অধ্যক্ষের কাছে অভিযোগ করলেও তিনি আমলে নিতেন না।
এসব ঘটনার জনক রিফাত ফরাজী ও তার দলের বিরুদ্ধে কেউ মুখ না খোলায় তেমন একটা আইনের আওতায়ও আসেনি তারা। মামলা বা অভিযোগ তো দূরে থাক, কেউ এদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতেই সাহস পাননি। যে মুখ খুলেছে তাকেই লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। তবে মাদকসহ বিভিন্ন অভিযোগে সদর থানায় রিফাতের বিরুদ্ধে চারটি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় আটক হলেও রাতারাতি জামিনে এসে ফের একই কাজ করতো।
সর্বশেষ গত ২৬ জুন সকালে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে জখম করে ‘০০৭’ গ্রুপের সদস্যরা। গুরুতর অবস্থায় তাকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
এই ফেসবুক গ্রুপেই রিফাত হত্যার বিষয়ে সদস্যদের মাঝে কথোপকথন হয়।
‘০০৭ গ্রুপের সবাইকে কলেজে দেখতে চাই। রিফাত ফরাজী নামে একটি ফেসবুক আইডি থেকে মেসেঞ্জার গ্রুপে এ আহ্বান জানানো হয়েছিল। ‘মোহাম্মদ’ নামে আরেকটি আইডি থেকে জানতে চাওয়া হয়, কয়টার সময় আসতে হবে। এরপর মোহাম্মদ আরও জানতে চায়, কলেজের কোথায়?
উত্তরে রিফাত ফরাজী বলে, ‘৯টার দিকে।’ এই মেসেঞ্জার গ্রুপের কথোপকথনে একটি চাপাতির ছবি দিয়ে বলা হয় ‘পারলে হেইডাসহ।’ মোহাম্মদ বলে, ‘আমু আনে’।
০০৭ নামে মেসেঞ্জার গ্রুপে এই তথ্য মিলেছে, যেখানে আগের রাতেই বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যায় জড়িতরা নিজেদের মধ্যে কথা চালাচালি করে খুনের চূড়ান্ত ছক ঠিক করে।