শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৫২ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
হুন্ডির মাধ্যমে মানবপাচারের অর্থ যাচ্ছে জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে

হুন্ডির মাধ্যমে মানবপাচারের অর্থ যাচ্ছে জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে

স্বদেশ ডেস্ক:

পশ্চিম ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে জনশক্তি রপ্তানির নামে পাচারের শিকার হচ্ছেন অসংখ্য বাংলাদেশি। বেআইনি ও ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাচারকালে তাদের মাঝপথে জিম্মি করে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণও আদায় করা হচ্ছে। আর এসব অর্থের মধ্যে একটি অংশ চলে যাচ্ছে জঙ্গিগোষ্ঠী আল কায়েদার মতাদর্শী লিবিয়ার উগ্রবাদী সংগঠনগুলোর হাতে। ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে বা হুন্ডির মাধ্যমে জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে এ অর্থ তুলে দিচ্ছে উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত মানপাচারের গডফাদার হিসেবে পরিচিত কতিপয় বাংলাদেশি। মানবপাচার সংক্রান্ত তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ বলছে, লিবিয়াভিত্তিক উগ্রবাদী সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর সঙ্গে গোপন যোগসাজশ রয়েছে আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের। উন্নত ও প্রাচুর্যময় দেশে অভিবাসনের স্বপ্ন দেখিয়ে বাংলাদেশের সহজ-সরল যুবকদের একপর্যায়ে লিবিয়ায় পাঠানো হয়। এর পর সেখানে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। আর এ হীনকর্মে জড়িত সে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক সদস্যও। পুলিশের ভাষ্যÑ বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ রোধে মানবপাচারের স্রোত ও হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন রোধ করা জরুরি।

গত ২৮ মে লিবিয়ার মিসদাহ মরুভূমিতে ২৬ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়, আহত হয় আরও ১১ জন। আহতদের দেশে ফিরিয়ে আনার পর তাদের জবানিতে এবং বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তদন্তে ওঠে আসে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য। তদন্তকালে মানবপাচার চক্রে জড়িত তৃণমূল পর্যায়ের দালাল থেকে শুরু করে পাচারের রুটসহ আন্তর্জাতিক পাচারচক্রের গডফাদারদের তালিকা ও এ সংক্রান্ত অনেক তথ্য পাওয়া যায়। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের বাইরে অবস্থানরত বাংলাদেশের ৬ গডফাদারকে আইনের আওতায় আনতে সিআইডির পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলকে অবহিত করার পর ইতোমধ্যে জারি হয়েছে রেডঅ্যালার্ট।

তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে, বিশেষ করে সেসব দেশে প্রবেশের মুখ হিসেবে পরিচিত ইতালিতে অভিবাসনপ্রত্যাশী শত শত বাংলাদেশি বিভিন্ন সময় লিবিয়াতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাদের অনেককেই মেরে ফেলা হয়েছে, কেউবা আহত হয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ এমন অসংখ্য বাংলাদেশি তরুণ-যুবকও আছেন, যাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা অজানা।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (গুলশান বিভাগ) মো. মশিউর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, মানবপাচারের টাকা হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন হয়। এসব অর্থ সন্ত্রাসবাদসহ বিভিন্ন অন্যায় কাজে ব্যয় হয়। চাকরির জন্য যারা বিদেশ যেতে চান, তাদের প্রত্যেকের উচিত বিএমইটির কার্ডসহ সরকারি প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। তা হলে প্রতারিত হওয়ার শঙ্কা কমে যায়।

ডিবি পুলিশ বলছে, বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির অনুমতি নেই। তবে মানবপাচারকারী চক্রের স্থানীয় দালালরা বিভিন্ন জেলা বিশেষ করে মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ ও সিলেটের তরুণদের লিবিয়াসহ ইউরোপের দেশ ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, সাইপ্রাস পাঠানোর লোভ দেখিয়ে প্রলুব্ধ করে। এর পর ইচ্ছুক যুবকদের ঢাকায় এনে জড়ো করা হয়।

পাচারের ৪ রুট : বাংলাদেশ থেকে চারটি রুটে লিবিয়ায় পাঠানো হয়। এ ক্ষেত্রে দুবাইয়ের এক মাসের ট্র্যাভেল ভিসা সংগ্রহ বা ভারতে অবস্থিত লিবিয়ার দূতাবাস থেকে ট্র্যাভেল ভিসা সংগ্রহ করা হয়। প্রথম রুট হলোÑ ঢাকা বা চট্টগ্রাম বিমানবন্দর হয়ে দুবাইয়ের শারজাহ, সেখান থেকে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া হয়ে লিবিয়ার বেনগাজিতে পাঠানো হয়। দ্বিতীয় রুট হচ্ছেÑ ঢাকা/চট্টগ্রাম বিমানবন্দর হয়ে দুবাই। সেখান থেকে তিউনিশিয়া হয়ে বেনগাজি। তৃতীয় রুটÑ বেনাপোল হয়ে ভারতের বোম্বে। এর পর দুবাইয়ের শারজাহ হয়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় এবং সেখান থেকে বেনগাজিতে। আরেকটি রুটটি হলোÑ বেনাপোল হয়ে সড়কপথে সীমান্ত পেরিয়ে কলকাতায়। সেখান থেকে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া হয়ে লিবিয়ার বেনগাজি।

পুলিশ বলছে, ইউরোপ পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে দালালচক্র ১০-১২ লাখ টাকার চুক্তি করে। এর পর আড়াই লাখ থেকে তিন লাখ টাকা নগদ আদায় করে থাকে ভিসা প্রদানের আগেই। এর পর চারটি রুটের যে কোনো একটি ব্যবহার করে বেনগাজিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বিভিন্ন পণ্যের গুদামে আটকে রেখে তরুণদের কাছ থেকে নগদ অর্থকড়ি লুট করে নেওয়া হয়। এর পর শুরু হয় মুক্তিপণ আদায়ে নানা রকম অত্যাচার-নির্যাতন। এ ক্ষেত্রে খাবার ও পানি বন্ধ করে দেওয়া হয় শুরুতেই; চলে টাকা আদায়ে বর্বর শারীরিক নির্যাতন। নির্যাতন সইতে না পেরে অনেক তরুণের মৃত্যুও হয়। অনেকে মারাত্মক আহত হয়ে চিরদিনের জন্য অচল হয়ে যায়। তাদের মধ্যে যাদের ভাগ্য ভালো, তারাই শুধু ঘটনাক্রমে দেশে ফিরে আসার সুযোগ পান। বেনগাজির এসব টর্চারশেলে চালানো নির্যাতনে বাঙালি গডফাদার, তাদের চেলাচামু-া তো বটেই, লিবিয়ার মিলিশিয়া বাহিনীও সরাসরি অংশ নিয়ে থাকে।

নির্যাতন চলাকালে মোবাইল ফোনে বা অনলাইন অ্যাপসে দেশে অবস্থানরত পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয় আটক তরুণদের। প্রাণরক্ষার জন্য তাদের কাতর মিনতি স্বজনদের ব্যাকুল করে ফেলে। তারা যে কোনো উপায়ে অর্থ জোগাড় করেন। এর পর এসব টাকা বাংলাদেশে অবস্থানরত দালালরা বিকাশ, রকেটসহ মোবাইল ব্যাংকিংয়ে গ্রহণ করে ঢাকার হুন্ডি সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দেয়।

অন্যদিকে লিবিয়া বা আফ্রিকায় কর্মরত অন্য বাংলাদেশিদের বেতনের টাকা দেশে না পাঠিয়ে সেখানেই মুক্তিপণের অর্থ স্থানীয় মুদ্রা দিনারের মাধ্যমে বিনিময় হয়। লিবিয়ায় হুন্ডির ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে সেখানকার মানবপাচারকারী চক্র। এই অর্থের একটি বড় অংশ মাফিয়া, সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও জঙ্গি কার্যক্রমের ভরণপোষণ বা অন্যান্য কাজে ব্যয় হয়।

সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন, অর্থপাচার প্রতিরোধে গঠিত বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান আমাদের সময়কে বলেন, হুন্ডিতে অর্থপাচার হলে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স দেশে আসে না। এতে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের রির্জাভের। তিনি বলেন, আগে হুন্ডি হতো মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। গত কয়েক বছরে সেটি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারায় হুন্ডি কমে আসছিল। কিন্তু এ মুহূর্তে অর্থপাচারকারী চক্র প্রযুক্তির মাধ্যমে লেনদেন করছেন। হুন্ডির অর্থ সন্ত্রাসবাদসহ নানা ধরনের অপখাতে ব্যবহৃত হয়। পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা সে বিষয়ে কাজ করছি।

চার জেলায় গেমিং চক্র

দেশের চার জেলায় ১০টি গেমিং চক্র রয়েছে। এসব চক্রের সদস্যরা ইউরোপে গমনেচ্ছুদের সংগ্রহ করে লিবিয়ায় পাচার করছে। গেমিং চক্রের মধ্যে মাদারীপুরে আছে মিরাজ, বাদশা, নুরু, আতিয়ার, রুবেল; শরীয়তপুরে মনির; গোপালগঞ্জে ডেবিট, মমিন এবং সিলেটে পলাশ ও পারভেজ। এ ছয় গডফাদার ছাড়াও লিবিয়ায় বাংলাদেশের ৪০-৪৫ গ্রুপ মধ্যম শ্রেণির মানবপাচারকারী রয়েছে। তারাই গডফাদারদের হয়ে মিলিশিয়া ও স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে অত্যাচার, নির্যাতনের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় ও হুন্ডির কাজটি করে থাকে।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার সৈয়দা জান্নাত আরা বলেন, মানবপাচারের ক্ষেত্রে পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা, বিমান টিকিট, রুট নির্ধারণ এর পর জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের ক্ষেত্রে কয়েকটি ধাপ রয়েছে। তবে যারা নিয়ন্ত্রক সেসব গডফাদার বিদেশে অবস্থান করছে। হন্ডির টাকা মিলিশিয়াদের হাতে গেলে উভয় দেশের জন্যই তা ক্ষতিকর।

সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, লিবিয়ার ছোট ছোট দোকানে বাংলাদেশিরা হুন্ডির কারবার চালায়।

তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন, পাচারের শিকার একটি অংশ লিবিয়ায় অবস্থানরত তাদের আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে যাচ্ছেন। কিন্তু যাদের ইউরোপ পাঠানোর প্রলোভন দেখানো হয়, তাদের লিবিয়ায় আটক রাখা হয়। এর পর লাখ লাখ টাকা দাবি করা হয়। যারা টাকা প্রদান করে, তাদের নৌকায় করে ভূমধ্যসাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয় ইতালির উদ্দেশে। এর পর লিবিয়া নৌবাহিনীর নজরে পড়লে তাদের আটক/উদ্ধারের পর ফের জোয়ারা ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতনের মাধ্যমে স্বজনদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়। অনেকে সাগরে ডুবে মারা যায়। কেউ কেউ হয়তো সৌভাগ্যক্রমে ইতালির মাটি ছুঁতে পারেন।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877