আশরাফ দেওয়ান:
দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক অর্জন রয়েছে কিন্তু সাম্প্রতিক কালে এসব অর্জনে ভাটা স্পষ্ট। হবেই না কেন, মেধাবী শিক্ষক, মানসম্মত শিক্ষা আর জ্ঞান উৎপাদনের পরিবর্তে দিন দিন প্রাধান্য পাচ্ছে ক্ষমতা, তাঁবেদারি আর ‘তথাকথিতদের’ দৌরাত্ম্য। উচ্চশিক্ষার বৈশ্বিক র্যাঙ্কিং প্রকাশিত হলেই হইচই পড়ে যায়, সামাজিক নেটওয়ার্কের কল্যাণে আমজনতাও কর্তাব্যক্তিদের বায়বীয় বুলি শোনেন, আশ্বস্ত হন ‘সামনে হবে’।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, উচ্চশিক্ষার মান দিন দিন কেন নিম্নগামী? কেনই–বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যর্থ হচ্ছে জাতীয় উন্নয়নে অধিকতর অবদান রাখতে? অনেকেই বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিবছর অনেক সরকারি কর্মকর্তার জোগান দিচ্ছে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশেষায়িত শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কি এটা?
২০০১ সালে পেশাগত কাজে মালয়েশিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই, পরিচিতি পর্বে কথা হয় তৎকালীন ভিসির সঙ্গে, যিনি ১৯৬০–এর দশকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। একপর্যায়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমাদের শিক্ষাব্যবস্থার এমন দৈন্যদশা কেন’? উত্তর কী দেওয়া উচিত ছিল জানি না, তবে এতটুকু জানি, আমরা সব প্রথা ভেঙে ফেলেছি ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থে, শিখেছি সমাজ তথা দেশ ধ্বংসের নিত্যনতুন কৌশল।
আমাদের উচ্চশিক্ষার ক্রমাবনতির জন্য যে শুধু রাজনৈতিক সংস্কৃতি দায়ী, তা নয়, আরও কারণও রয়েছে। যেমন:
১. উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তি হবেন একজন গেমচেঞ্জার। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর আমলনামা, নেতৃত্বগুণ, সততা এবং কাজের প্রতি একাগ্রতা বাঞ্ছনীয়। তাঁর কারণে প্রতিষ্ঠান আলোকিত হয়। বর্তমানে যে প্রক্রিয়ায় কর্তা নিয়োগ হয়, এতে গেমচেঞ্জার পাওয়া দুষ্কর, তবে ‘রাজনীতিবিদ শিক্ষক’ প্রচুর। সম্ভবত এটা প্রধান অন্তরায়।
ফলে নিয়োগের অব্যবহিত পরে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কর্তাব্যক্তি ব্যস্ত হয়ে যান ‘নিজস্ব’ লোকবল বৃদ্ধির কাজে, যেখানে যোগ্যতার মাপকাঠি মোটা দাগে আঞ্চলিকতা, আনুগত্য, স্বজনপ্রীতি আর দলবাজি। বছর পনেরো আগে এমনই এক কর্তাব্যক্তি নতুন এক ইনস্টিটিউট খোলেন শুধু তাঁর সন্তানকে শিক্ষক বানানোর জন্য এবং এটাকে জায়েজ করার জন্য নিমিত্তে সঙ্গে বেশ কয়েকজনকে নিয়োগ দেন। এমন দৃষ্টান্ত ইদানীং বাড়ছে। কর্তাব্যক্তি অনেক সময়, সব স্টেকহোল্ডারের প্রতিনিধিত্ব ব্যতীত, নিজের মতো করে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন, ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হয় অসহায় ছাত্রছাত্রীদের।
তাতে কর্তার কিছু যায় আসে না। আর করবেই না কেন? প্রথমবারের ‘আনুগত্যের’ দলিল দ্বিতীয় মেয়াদ বা আরও উন্নত পদের যে সুযোগ করে দেয়। যদিও নিয়োগকর্তা সুনির্দিষ্ট কাউকে নিয়োগের কথা বলে দেন না, অনেকটা ‘অতি–উৎসাহী’ বা ‘উপযাচক’ হয়ে গেমচেঞ্জারের পরিবর্তে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়ান, যা দেশ, প্রতিষ্ঠান বা সরকার কারও জন্যই সুখকর না।
আবার আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির ‘অন্যায্য’ আবদার না রাখলে তাঁর টিকে থাকা অনেকটা ডিঙি নিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দেওয়ার মতো। যুগের পর যুগ দেশকে এর রেশ টানতে হয়।
২. নিয়োগ ও পদোন্নতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ‘নতুন স্বাভাবিক’ সংস্কৃতি। বলা হয় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাওয়া কঠিন, কিন্তু একবার পেলে জীবন নিশ্চিত। যেহেতু চাকরিটা ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ সেহেতু কোনো পর্যায়েই জবাবদিহি নেই। ফলে ব্যয়িত টাকা যেমন জ্ঞানে পরিণত হয় না, তেমনি শিক্ষার্থীরা হয় অদক্ষ।
আর পদোন্নতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মূলত বয়সভিত্তিক বা কখনো ‘ব্যক্তিনির্ভর, সাধারণত একটা পদে নির্দিষ্ট সময় পার করলে আর দু–তিনটি প্রকাশনা (প্রতিষ্ঠান কর্তৃক স্বীকৃত) থাকলেই হয়ে যায়। দলীয় সংশ্লিষ্টতা আর কর্তৃপক্ষের ‘নেকনজর’ অতিরিক্ত যোগ্যতা। তবে হ্যাঁ, প্রার্থী ‘ভিন্ন মতাবলম্বী’ হলে পদোন্নতি কপালনির্ভর, বেশি যোগ্যতা থাকলে দুর্গতি বাড়ে বৈকি।
অথচ উন্নত দেশে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বর্তমান পদ থেকে পরবর্তী পদের জন্য নিজেকে প্রমাণ করা অত্যাবশ্যক, কোনো ছাড় নেই। সুনির্দিষ্ট নির্ণায়কের ভিত্তিতে পদোন্নতি হয়। জ্যেষ্ঠদের কাছে শুনেছি, একসময় আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে বৈশ্বিক নিয়মকানুন অনুসৃত হতো কিন্তু এরশাদ আমলের শেষ থেকে নিয়োগ/পদোন্নতি মানদণ্ডের দ্রুত অবনমন ঘটে, এখন ‘আমরা সবাই রাজা আমাদেরই রাজার রাজত্বে’।
৩. পাঠ্যসূচি আর পরীক্ষা মূল্যায়ন (তত্ত্বীয়/ব্যবহারিক/গবেষণা) পদ্ধতির যুগোপযোগিতার অভাব আরেকটা কারণ। আধুনিক কারিকুলাম ছাড়া শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধি সম্ভব নয়। আবার পরীক্ষাপদ্ধতি স্বচ্ছ না হলে মেধার প্রকৃত মূল্যায়ন দুঃসাধ্য। আমাদের যেমন স্মার্টফোনের অ্যাপ প্রতিনিয়ত হালনাগাদ করতে হয়, যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে তেমনি আধুনিক পাঠ্যসূচি আর সুচারু মূল্যায়ন পদ্ধতি অত্যাবশক।
অনেক প্রতিষ্ঠানের বর্তমান পাঠ্যসূচি আর মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে মাঝেমধ্যেই খবর চাউর হয়। প্রচলিত পদ্ধতিতে প্রাপ্ত ফলাফল কেউ চ্যালেঞ্জ করতে চাইলেও পারে না (যদিও নিয়ম আছে)। আর শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় এসে ‘রাজনীতিবিদ শিক্ষকবৃন্দ’ এই সুযোগটা নিয়ে সমমনাদের যোগসাজশে নির্দিষ্ট কাউকে যেকোনো ক্ষেত্রে আনুকূল্য দিতেও পিছপা হন না। ফলে ক্রমাগত বাড়ছে শিক্ষিত ও অদক্ষ বেকারের সংখ্যা।
৪. উন্নত দেশে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের থাকে মিশন, ভিশন আর স্বল্প/দীর্ঘমেয়াদি কৌশলপত্র যেটা দেশে এ মুহূর্তে কারোর নেই, হোক সেটা নতুন বা পুরোনো প্রতিষ্ঠান। উন্নত বিশ্বে যেকোনো ছোট–বড় সংস্থায় এটা অকল্পনীয়। এমন অবস্থাও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অগ্রগামীর অন্তরায়। বিষয়টি নিয়ে কর্তাব্যক্তিরা কখনো কথা বলেন না। কেননা এতে তাঁদের কাজ বাড়বে, কমবে ‘অসদুপায়’ অবলম্বনের পন্থা।
সনদসর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থা কখনোই বর্তমান যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় হাতিয়ার হবে না, হতে পারে না। একমাত্র মানসম্মত ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা সবাইকে আলোর পথ দিতে পারে, করতে পারে ভবিষৎ নিরাপদ ও টেকসই।
৫. প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন একটা সংস্কৃতি বিরাজমান, যেখানে কাজের পরিবেশ তো নেই-ই, আছে শুধু মেধাবীদের ঘায়েল করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা; যার শেষাংশে জয়ী ‘রাজনীতিবিদ শিক্ষকগণ’। সম্মান বাঁচানোর নিমিত্তে মেধাবীরা চলে যায় নিভৃতে। বনের মধ্যে তরতর করে বেড়ে ওঠা গাছগুলো যেমন উন্নত মানের গাছগুলোকে বাড়তে দেয় না সূর্যালোক বেশি প্রাপ্তির আশায়, তেমনি রাজনীতিতে বহু শ্রমঘণ্টা ব্যয় করা শিক্ষকেরা কোনো প্রতিষ্ঠানকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেন না।
কারণ, তাঁদের টিকে থাকার একমাত্র অবলম্বন রাজনীতি। ‘রাজনীতিবিদ শিক্ষকদের’ সংখ্যা কিন্তু একদা ‘কম’ ছিল, এখন হু হু করে বাড়ছে। বাড়বেই না কেন, এমন ‘চিরস্থায়ী’ আর ‘জবাবহীনতার’ চাকরি কোথায় আছে। আর তাঁদের দাপটে শিক্ষকসমাজের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত।
শিক্ষাব্যবস্থার এই করুণ পরিণতি দিন দিন সমাজে বিশৃঙ্খলা বাড়াবে, দীর্ঘ মেয়াদে আসতে পারে বিভিন্ন সামাজিক দুর্যোগ।
সম্প্রতি ইউজিসি উচ্চশিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্ণপাত যৎসামান্য। দেশের বাস্তবতায় নিয়মগুলো মানাও দুঃসাধ্য। তবে এক উপাচার্যের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি কিন্তু বাহবা পাওয়ার যোগ্য।
ইউজিসির চেয়ারম্যান ১ নভেম্বর প্রথম আলোতে এক সাক্ষাৎকারে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে অনেকগুলো বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা কে পরাবে? শোনা যাচ্ছে, অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল হচ্ছে।
কিন্তু যেখানে অভিভাবক সংস্থা ইউজিসি হিমশিম খাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সামলাতে, নতুন সংস্থা কি পারবে সব জায়গায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে? পারবে কি শিক্ষায় সুশাসন নিশ্চিত করতে কিংবা লেজুড়বৃত্তি ছাত্র–শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করতে বা কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে? উত্তরটা অবশ্যই সময়নির্ভর কিন্তু নতুন কাউন্সিলের কর্তাব্যক্তি যদি গেমচেঞ্জার না হন, তবে অবস্থাটা অনুমেয়, মানে ‘নতুন বোতলে পুরোনো পানি’।
আমরা বিদ্যমান সিস্টেমকে ভেঙেচুরে দিচ্ছি, রাজনীতির ব্যানারে, কিন্তু কে বা কারা, কেনই–বা ভাঙল, তার উত্তর কে দেবে। বৈশ্বিক র্যাঙ্কিং বের হলে আহাজারি করি—যেন মাছের মায়ের পুত্রশোক। এমন কোনো উদাহরণ নেই যে ‘রাজনীতিবিদ’ শিক্ষকেরা প্রতিষ্ঠানকে আলোকিত করেছেন। তাঁদের টিকে থাকার একমাত্র অবলম্বন সমমনাদের নিয়ে দৈন্যর সংস্কৃতি চালু, ফলাফল নিশ্চিতরূপে তারাপদ রায়ের কবিতার মতো, ‘আমরা বুঝতে পারিনি, আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে’।
সনদসর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থা কখনোই বর্তমান যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় হাতিয়ার হবে না, হতে পারে না। একমাত্র মানসম্মত ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা সবাইকে আলোর পথ দিতে পারে, করতে পারে ভবিষৎ নিরাপদ ও টেকসই। না হলে কেউ কিন্তু নিরাপদ না, হোন তিনি সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ বা আমজনতা।
ড. আশরাফ দেওয়ান: স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস, কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া।