স্বদেশ ডেস্ক:
এক লাখ টাকায় প্রতি মাসে লাভ ৮৪৫০ টাকা! তবে তো এক বছরেই দ্বিগুণ টাকা! হ্যাঁ, জমিতে বিনিয়োগ করে মিলবে এমন লাভ।- এমন প্রলোভন দেখিয়ে হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করছে ‘সেবা আইডিয়াস অ্যান্ড লিভিং লিমিটেড’ নামে একটি কথিত আবাসন কোম্পানি। রাজধানীর উত্তরার মতো এলাকায় বিলাসবহুল অফিস খুলে বসেছে প্রতিষ্ঠানটি। এমএলএম ঘরানার প্রতিষ্ঠানটির টার্গেট মূলত অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। এমন অনেকেই প্রতিষ্ঠানটির হাতে তুলে দিচ্ছেন জীবনের শেষ সম্বল।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সেবা আইডিয়াস অ্যান্ড লিভিং লিমিটেড ‘সিল সিটি’ নামে কথিত আবাসন প্রকল্পের গল্প শুনিয়ে ফাঁদে ফেলছেন সাধারণ মানুষকে। দক্ষিণখানের শেষ প্রান্ত কাচকুরা বাজারের উত্তরপূর্ব পাশে আমাইয়া গ্রামের জলাশয়ে সিল সিটির সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে। সেখানে বেশ কয়েকটি স্থানে তাদের সাইনবোর্ড টানানো। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্যি, কোনো জমি কেনা নেই প্রতিষ্ঠানটির নামে। মূলত ভাড়ার জমিতে টানানো হয়েছে সিল সিটির এসব সাইনবোর্ড। বছরভিত্তিক নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ভাড়া পরিশোধ করেন তারা। এমনকি গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা খালেও সাইনবোর্ড ঝুলছে সিল সিটির।
সেবা আইডিয়াস অ্যান্ড লিভিং লিমিটেড কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে, আমাইয়া মৌজায় তাদের সাড়ে ৬ বিঘা জমি ইতোমধ্যে কেনা হয়ে গেছে; আরও ৫০ বিঘা জমি বায়না করা হয়েছে। কিন্তু তাদের বলা আর বাস্তবতার মধ্যে ভীষণ ফারাক রয়েছে। সরেজমিন এ প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে সিল সিটি কর্তৃপক্ষের জমি ক্রয়ের বক্তব্যের সত্যতা মেলেনি। প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে জমি কেনার কথা জানানো হলে গ্রামের লোকজন রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করেন!
এ তো গেল জমি। এবার আসা যাক তাদের করপোরেট কার্যালয়ে। উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর বাড়ি। এটিই সেবা আইডিয়াস অ্যান্ড লিভিং লিমিটেডের করপোরেট অফিস। কিন্তু অন্য সব আবাসন প্রতিষ্ঠানের অফিসের মতো যে কেউ চাইলেই এ অফিসে প্রবেশ করতে পারেন না। প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব প্রতিনিধির মাধ্যমে অফিসে ঢুকতে হয়। পরে বোঝা গেল, বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে এ কৌশল চক্রটির। গ্রাহক পরিচয়ে প্রতিষ্ঠানটির এক মার্কেটিং অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ হয় এ প্রতিবেদকের। সেই সূত্রে একপর্যায়ে নির্দিষ্ট দিনক্ষণে অফিসের সামনে হাজির হওয়ার পর ফারিয়া নামের এক তরুণী অফিসের নিচে এসে স্বাগত জানান এ প্রতিবেদককে। নিয়ে যান সেবা আইডিয়াস অ্যান্ড লিভিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী নুরুল ইসলামের কক্ষে। কাজী নুরুল ইসলাম এর আগেও ইউনিপে টুসহ বিভিন্ন এমএলএম প্রতিষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন। সেসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও তিনি মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়েছেন বলে জোর অভিযোগ রয়েছে। কাজী নুরুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে তাদের ব্যবসার বিভিন্ন দিক বোঝাতে থাকেন। বলেন, একটু রিস্ক না নিলে জীবনে কিছু করতে পারবেন না। এখানে ইনভেস্ট করলে এক বছরের মধ্যে মূল টাকা দ্বিগুণ হবে।
তিনি আরও জানান, সিল সিটিতে তিন কাঠার প্লটের দাম ৭৫ লাখ টাকা। আর এক হাজার ৩০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটের দাম ৬৫ লাখ টাকা। কথিত এই প্লট ও ফ্ল্যাটের বিপরীতে বিনিয়োগ করার সুযোগ দিয়ে থাকে তারা। তবে কেউ এককালীন এত টাকা বিনিয়োগ না করতে পারলে তাদের জন্য শেয়ারের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতি লাখে ৮ হাজার ৪৫০ টাকা লাভ এবং দুবছর পর মূল টাকা গ্রাহক চাইলে ফেরত নিতে পারবেন। বেশিরভাগ গ্রাহক ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে থাকে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিনিয়োগকারীদের সেখানে নিয়ে যাওয়া প্রত্যেক ব্যক্তিকে ১০ শতাংশ হারে কমিশন দেয় প্রতিষ্ঠানটি। তার ওপর আবার বিনিয়োগকারীকে প্রতি মাসে ৮ শতাংশ হারে মুনাফার টাকা দেওয়া কীভাবে সম্ভব এমন প্রশ্নের সঠিক কোনো উত্তর দিতে পারেননি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।
প্রতিষ্ঠানটির কাছে অনুমোদনসংক্রান্ত নথিপত্র চাওয়া হলে তারা একটি যা হাজির করেন, তা স্রেফ একটি ট্রেড লাইসেন্সের ফটোকপি। রাজউক অথবা জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমোদন নেই; নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র।
ওই অফিসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমাদের সময়কে বলেন, বিনিয়োগকারীদের নানাভাবে লভ্যাংশের প্রলোভন দেখানো হলেও পুরোটাই ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’। প্রকৃতপক্ষে এখানে বিনিয়োগের পর লাভ দূরে থাক, বিনিয়োগের টাকাও ফেরত পান না কেউ।
করপোরেট অফিসে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন কক্ষে সাজানো চেয়ার টেবিলে আগ্রহী বিনিয়োগকারীদের বোঝানো হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির দুই কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন-এখানে জমি বা প্লটে বিনিয়োগ করতে হবে একটু ভিন্নভাবে। মানে বিনিয়োগে মুনাফা ও জমি দুটোই এক সঙ্গেই মিলবে এখানে। জমি বিক্রিতে এক ধরনের এমএলএম পদ্ধতি অনুসরণ করেন তারা।
সেবা আইডিয়াস অ্যান্ড লিভিং লিমিটেড জানায়, গত ১৮ মাস ধরে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। ইতোমধ্যে ৩ হাজার গ্রাহক বিনিয়োগ করেছে তাদের প্রতিষ্ঠানে। ইতোমধ্যে শত কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছে সাধারণ মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বেশিরভাগই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। সারাজীবন চাকরি করে শেষ সম্বল তুলে দিচ্ছে সেবা আইডিয়াস অ্যান্ড লিভিং লিমিটেডের হাতে।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের এক কর্মী আমাদের সময়কে বলেন, বিনিয়োগকারীদের প্রতিদিনের টাকার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সংশ্লিষ্ট দালালের জন্য কমিশন হিসেবে রেখে অবশিষ্ট টাকার পুরোটাই ভাগাভাগি করে নিয়ে যান প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
অভিযোগের সব বিষয় প্রতিবেদকের কাছে শুনে সেবা আইডিয়াসের এমডি কাজী নুরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ‘মিটিংয়ে আছি। পরে আপনার সঙ্গে কথা বলব।’ ফোনে নয়, সরাসরি এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছার কথাও জানান তিনি কথাচ্ছলে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তরা পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরে আলম সিদ্দিকী আমাদের সময়কে বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের জানা নেই। আপনার কাছ থেকে প্রথম শুনলাম। আমাকে ঠিকানাটা দিলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’