স্বদেশ ডেস্ক:
ইয়াবা মামলায় পাঁচ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত এক আসামিকে বৃদ্ধ মায়ের সেবা যত্ন এবং সন্তানদের দেখাশোনা করাসহ তিন শর্তে প্রবেশনে পরিবারের সাথে থাকার অনুমতি দিয়েছেন উচ্চ আদালত। সম্প্রতি আইনে উচ্চ আদালত থেকে এই নির্দেশনা আসার পর সাতক্ষীরায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের একটি মামলায়ও এক বছর সাজাপ্রাপ্ত এক আসামিকে কারাগারে না পাঠিয়ে পাঁচ শর্তে বাড়িতে প্রবেশনে পাঠিয়ে সংশোধনের সুযোগ দিয়েছেন আদালত।
কারাগারে দাগি আসামিদের সাথে না থেকে সংশোধনের শর্তে পরিবারের সাথে থাকতে দেয়ার আদালতের এমন নির্দেশনাকে খুবই ইতিবাচক বলে মনে করেন দেশের শীর্ষ আইনবিদরা। তাদের মতে, একটা সুযোগ দেয়া হলো কতগুলো সুনির্দিষ্ট শর্ত দিয়ে বা শর্ত সাপেক্ষে। শর্তগুলো যদি সে যথাযথভাবে পালন করে, তা হলে এটা সে জেলে না গিয়েও থাকতে পারে। লঘুদণ্ডের ক্ষেত্রে, আদালত যদি এটা ব্যবহার করে তা হলে এক দিকে যেমন জেলখানার ওপর কয়েদিদের চাপ কমবে। আরেকটা হলো সে নিজেকে শোধরাতে পারেন।
আইনবিদরা আরো বলেন, বিচার সব সময় খালি আইনে যা আছে সেই মতো করলে হয় না। বিচারটা করতে হবে সুষ্ঠুভাবে যাতে সমাজে যারা আছে তারা উপকৃত হয়। খুব সিরিয়াস অপরাধ ছাড়া কিছু কিছু মামলা আছে যেগুলোয় শোধরানোর সুযোগ থাকে। এতে জেলখানায় চাপ কমবে এবং মানুষও সতর্ক হবে যে হ্যাঁ আমি একবার অপরাধ করেছি। ভবিষ্যতে আর এ ধরনের অপরাধ করব না। তার ব্যাপারে সব সময় প্রবেশন অফিসার যিনি থাকেন সেটা রিপোর্ট করবে। এটা একটা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত এবং এটা ব্যাপকভাবে প্রচালন হওয়া ভালো।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, প্রবেশনে পরিবারের সাথে থেকে সংশোধনের সুযোগ, এটা সব দেশেই আছে। আমাদের দেশেও আছে। এখানে লঘুদণ্ডের ক্ষেত্রে, আদালত যদি ব্যবহার করে তা হলে এক দিকে যেমন জেলখানার ওপর কয়েদিদের চাপ কমবে। অপর দিকে নতুন কয়েদি যারা সেখানে যায় অপরাধী হিসেবে তাদের চরিত্র যাতে আরো খারাপ না হয়।
খন্দকার মাহবুব হোসেন আরো বলেন, সবচেয়ে বড় কথা লঘুদণ্ডপ্রাপ্ত যারা আছে তাদেরকে প্রবেশন আইনে যেটা আছে সেই অনুযায়ী প্রবেশনে যদি দেয়া যায় তা হলে সেটা ইতিবাচক হবে। তিনি আরো বলেন, গুরুতর অপরাধ ছাড়া ছোট অপরাধের ক্ষেত্রে এবং প্রথম অপরাধ করেছে এমন ক্ষেত্রে আসামিকে জেলে না রেখে শর্ত সাপেক্ষে পরিবারের সাথে রেখে সংশোধনের সুযোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত খুবই ইতিবাচক।
এ বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, সমাজে বা পরিবারে আসামিদেরও দায়িত্ব আছে। সেই দায়িত্বটা যাতে সে পালন করতে পারে। একটা সুযোগ দেয়া হলো কতগুলো সুনির্দিষ্ট শর্ত দিয়ে বা শর্ত সাপেক্ষে। শর্তগুলো যদি সে যথাযথভাবে পালন করে, তা হলে এটা সে জেলে না গিয়েও থাকতে পারে। এটা এক দিক থেকে তার পরিবারের জন্য একটা সুযোগ দিলো।
তিনি বলেন, প্রবেশন দিতে পারে, একটা হলো খুব সিরিয়াস অপরাধ, খুনের মামলা ছাড়া কিছু কিছু মামলা আছে যেগুলোয় শোধরানোর সুযোগ থাকে। রিপিটেশন (পুনরায় অপরাধ) না করে সেজন্য দেয়া হয়। যাতে করে সে পরিবারের সাথে থাকতে পারে এবং বুঝতে পারে সে আবার যদি এই অপরাধটি করে তা হলে সে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে তারে আরো বেশি সাজা দেয়া হবে। কাজেই ক্ষেত্রটা আমার মনে হয়, এই রায় যেটা হয়েছে এইটা সত্যিকার অর্থে সমাজের দিকে তাকিয়ে। একটি লোক পরিবারে তার যে দায়-দায়িত্ব সেটা পালন করার জন্য এবং পরিবারের অন্যরা নিরাপদ অনুভব করবে। আমার মনে হয় এটা জাসটিস বা সুবিচারের লক্ষ্যে উচ্চ আদালত থেকে এই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
প্রবেশন হলো একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক সংশোধনী কার্যক্রম। দণ্ডিত ব্যক্তির শাস্তি স্থগিত করে তাকে কারাগারে অন্তরীণ না রেখে সমাজে খাপখাইয়ে চলার সুযোগ দেয়া হয় প্রবেশনে। এর মাধ্যমে পুনঃঅপরাধ রোধ এবং একজন আইনমান্যকারী নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তাকে সহায়তা করা হয়।
প্রবেশন আইনে প্রথম রায় : ৮ নভেম্বর ইয়াবা মামলায় ৫ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মতি মাতবরকে বৃদ্ধ মায়ের সেবাযত্ন করাসহ তিন শর্তে প্রবেশনে পরিবারের সাথে থাকার অনুমতি দিয়েছেন হাইকোর্ট। রায়ে আদালত দেড় বছরের জন্য প্রবেশন মঞ্জুর করেছেন। ৭৫ বছরের বৃদ্ধ মায়ের যত্ন নিতে হবে, দুই সন্তানের লেখাপড়া ও দেখাশোনা নিশ্চিত করতে হবে। আইন অনুযায়ী বয়স না হওয়া পর্যন্ত মেয়ের বিবাহ দিতে পারবে না। আগামী দেড় বছর প্রবেশনের এ তিনটি শর্ত তাকে মানতে হবে। আর তাকে থাকতে হবে একজন প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে। গত ৮ নভেম্বর বিচারপতি জাফর আহমেদের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আসামি মতি মাতবরের রিভিশন আবেদন খারিজ ও প্রবেশনের আবেদন গ্রহণ করে এ রায় দেন। বাংলাদেশে প্রবেশন আইনের অধীনে হাইকোর্ট বিভাগে এটিই প্রথম ও ঐতিহাসিক রায় বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
এ মামলায় আদালতে আসামিপক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। সাথে ছিলেন আইনজীবী মো: রুহুল আমীন ও মো: আসাদ উদ্দিন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো: এনামুল হক মোল্লা।
আইনজীবীরা জানান, এক হাজারের বেশি ইয়াবা উদ্ধারের অভিযোগে আসামি মতি মাতবরসহ দুইজনের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৩ নভেম্বর মামলা করে ঢাকার কোতোয়ালি থানা পুলিশ। ওই মামলার বিচার শেষে ২০১৭ সালের ৮ জানুয়ারি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুই আসামিকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা করে হাকিম আদালত। আসামিরা ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে ওই বছরই তা খারিজ করে দেয় মহানগর দায়রা জজ আদালত। পরে আসামি মতি মাতবর ২০১৭ সালের ১ জুলাই হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করেন। হাইকোর্ট রিভিশন আবেদনটি শুনানির জন্য গ্রহণ করে ৯ জুলাই মতি মাতবরকে জামিন দেয়। ২০১৫ সালের ২৩ নভেম্বর গ্রেফতারের পর দণ্ডিত এই ব্যক্তি ২০ মাস কারাভোগ করেন। যেহেতু মতি মাতবরের এটিই প্রথম অপরাধ এবং আর কোনো অপরাধের সাথে জড়িত থাকার কোনো রেকর্ড নেই। সে কারণে তিনি রিভিশনের শুনানিতে প্রবেশন অধ্যাদেশ, ১৯৬০ এর ধারা ৫ অনুযায়ী প্রবেশন চেয়ে আবেদন করেন।
এ মামলার আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, আমাদের দেশে এই জুরিসপ্রুডেন্স খুব বেশি আগায়নি। সামান্য পরিমাণ সাজাতেও একজনকে কারাগারে পাঠানো হয়। অথচ উন্নত বিশ্বে বড় সাজা হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আচার-আচরণ, গুণাবলি বিবেচনায় তাকে প্রবেশনে রাখা হয়। আসামি যেন নিজেকে শুধরে নিতে পারেন, সেই সুযোগটা তাকে দেয়া হয়। আদালত চলতি বছরের ৭ অক্টোবর ১০ দিনের মধ্যে আসামির নামে ব্যাংক হিসাব এবং টিন নম্বর খুলে দিতে ঢাকার অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসন সমিতিকে নির্দেশ দেয়। সেই সাথে ২১ অক্টোবর ঢাকা জেলার প্রবেশন কর্মকর্তাকে দণ্ডিত মতি মাতবরের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে হাইকোর্টে প্রতিবেদন দিতে বলে। সে অনুযায়ী প্রবেশন কর্মকর্তা মতি মাতবরের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে গত ২ নভেম্বর আসামি সম্পর্কে ইতিবাচক প্রতিবেদন দেন। সে প্রতিবেদন দেখেই রোববার হাইকোর্ট মতি মাতবরকে দেড় বছর প্রবেশনে থাকার অনুমতি দিলো।
অন্য দিকে গত ১০ নভেম্বর সাতক্ষীরায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের একটি মামলায় এক বছর সাজাপ্রাপ্ত আসামি হাসান আলী সরদারকে (২৫) কারাগারে না পাঠিয়ে বাড়িতে প্রবেশনে পাঠিয়ে সংশোধনের সুযোগ দিয়েছেন আদালত। তবে এই সময় তাকে পাঁচটি শর্ত মেনে চলার আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ আদেশ অমান্য করলে তাঁকে আবার কারাগারে যেতে হবে। সাতক্ষীরা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিতীয় আদালতের বিচারক ইয়াসমিন নাহার এ রায় দেন।
প্রবেশনে যাওয়া সাজাপ্রাপ্ত আসামির নাম হাসান আলী সরদার। তিনি সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ভাদড়া গ্রামের রজব আলী সরদারের ছেলে। এ মামলার আসামিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন এ টি এম ফখরুল আলম এবং রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ছিলেন শামছুল বারী।
আসামিপক্ষের আইনজীবী এ টি এম ফখরুল আলম জানান, গতকাল জি আর ৪৩/১৫ (টিআর ২৯/১৬) নম্বর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলার রায়ে তিন কেজি গাঁজা রাখার অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় আসামি হাসান আলী সরদারকে এক বছরের প্রবেশন দেয়া হয়েছে। তবে এই সময় আসামিকে পাঁচটি শর্তে বাড়িতে প্রবেশনে থাকার সুযোগ দিয়েছেন আদালত। সাজাপ্রাপ্ত আসামি শর্তগুলো মানছেন কি না, তা তদারকির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সাতক্ষীরা সমাজসেবা অধিদফতরের প্রবেশন কর্মকর্তা সুমনা সারমিনকে। এ মামলার রায়ে বিচারক তিন মাস পরপর সমাজসেবার প্রবেশন কর্মকর্তাকে আদালতে এ বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়ার আদেশও দিয়েছেন।