সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ১২:২০ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে জেলায় জেলায়

উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে জেলায় জেলায়

স্বদেশ ডেস্ক:

সারাদেশে একের পর এক ধর্ষণ-নিপীড়নের জন্য দায়ীদের বিচার দাবিতে গতকাল মঙ্গলবার টানা তৃতীয় দিনের মতো রাজধানীর রাজপথে ছিল বিক্ষোভ প্রতিবাদের উত্তাপ। দিনের শুরুতেই বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠনের ব্যানারে রাস্তায় নেমে আসেন প্রতিবাদকারীরা। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখী ছাত্র ইউনিয়নের কালো পতাকা মিছিলে বাধা দিলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে প্রতিবাদকারীদের। এতে পুলিশের লাঠিপেটায় ছাত্র ইউনিয়নের অন্তত ৫ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন।

এদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ধর্ষণের প্রতিবাদে গতকাল রাজধানীতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন যুব মহিলা লীগও। এ ছাড়া রাজধানীর উত্তরার সড়কে গতকালও ছিলেন হাজারও প্রতিবাদী শিক্ষার্থী। প্রতিবাদ হয়েছে রাজধানীর বিভিন্ন কলেজের সামনে। সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে মানববন্ধন

করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্র ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক সমিতি, বাংলাদেশ আঞ্জুমানে আল ইসলাম, দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলন ও সোনাইমুড়ী জনকল্যাণ সমিতি প্রভৃতি সংগঠন। মোহাম্মদপুর এলাকার আড়ংয়ের সামনে ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠন।

অন্যদিকে নোয়াখালীর বিভিন্ন স্থানে গতকালও বিভিন্ন দল, সংগঠনের ব্যানারে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাসদ নোয়াখালী, জেলা বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠন, জেলা যৌন হয়রানি নির্মূলকরণ নেটওয়ার্ক, স্টুডেন্টস অব নোয়াখালী এবং মানবিক ব্লাড ফাউন্ডেশন; চাটখিলে মলং মুড়ি, জয়াগ মৈত্রী যুব সংঘ, স্বেচ্ছাসেবী প্যানেল অব চাটখিল, বুলু ফোরাম সিবিএফ, এন সোশ্যাল ব্লাড ডোনেট ক্লাব, একতা ব্লাড ডোনেট সংগঠন, চাটখিল পাঁচগাও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, চাটখিল উপজেলার স্কুল, কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষার্থীসহ একাধিক সংগঠন গতকাল কর্মসূচি পালন করেছে।

সিলেট এমসি কলেজে স্বামীকে বেঁধে নববধূকে গণধর্ষণকা-ে যখন বিবেকবান মানুষমাত্রই মর্মাহত, তখন সেই ক্ষত না শুকাতেই নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণ করার জন্য চালানো বর্বরোচিত নির্যাতন এবং তা মোবাইল ফোনে ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো অসভ্য কা-ের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানের দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সাধারণ মানুষ। তাদের স্লোগানে-গর্জনে ছিল প্রতিবাদের হুঙ্কার; ছিল এসব কা-ের জন্য দায়ীদের সর্বোচ্চ বিচারের দাবি।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে ছাত্র আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেও গতকাল বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। এতে ধর্ষণ, নির্যাতন ও নিগ্রহের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে এসবের জন্য দায়ী যারা, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করা হয়। এদিন ক্ষোভের উত্তাপ বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন নগরীতে ছড়িয়ে পড়ে।

পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে জড়ো হয়ে ‘ধর্ষণ ও নিপীড়নবিরোধী ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে বিক্ষোভ শুরু করেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা। ‘ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, ধর্ষকের ফাঁসি চাই’, ‘ধর্ষকের আস্তানা, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘যে রাষ্ট্র ধর্ষণ পোষে, সেই রাষ্ট্র চাই না’, ‘আমার বোনকে ধর্ষণ কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘নিপীড়ক যেখানে, লড়াই হবে সেখানে’- ইত্যাদি স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে চারপাশ। প্রগতিশীল অনেক সংগঠনের নেতাকর্মী ছাড়াও লেখক, কবি, শিল্পী, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও নারী অধিকারকর্মীরাও এ বিক্ষোভে যোগ দেন।

দুপুর সোয়া ১টার দিকে তারা শাহবাগ মোড় থেকে কালো পতাকা মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা ঘুরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে যাত্রা করলে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়ে পুলিশ তাদের আটকে দেয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে মিছিলকারীদের হাতাহাতি হয়। পরে পুলিশ লাঠিপেটা করলে ছাত্র ইউনিয়নের বেশ কয়েক নেতাকর্মী আহত হন। তাদের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়নের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার শিক্ষা সম্পাদক আসমানিয়া আশা, ঢাকা মহানগরের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক মাহমুদা দীপা, সাজ্জাদ হোসেন শুভ, আরেফিন ইমন ও রাসেল রহমান- এই ৫ জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।

পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর মিছিলকারীরা রাস্তায় অবস্থান নিয়ে পুলিশ দিয়ে আন্দোলন বন্ধ করার প্রতিবাদে স্লোগানে স্লোগানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এ সময় তারা ধর্ষক ও নিপীড়কদের শাস্তির পাশাপাশি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালেরও পদত্যাগ দাবি করেন। বেলা ২টার দিকে মিছিলটি ফের শাহবাগ হয়ে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে সন্ধ্যায় শাহবাগে মশাল মিছিল এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা দাহ করার কর্মসূচি ঘোষণা করেন ছাত্রনেতারা।

ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মেহেদী হাসান নোবেল অভিযোগ করে বলেন, আমাদের ১০ জনেরও বেশি নেতাকর্মী পুলিশের পিটুনিতে আহত হয়েছেন। তিনি বলেন, এখানে সবচেয়ে ন্য ক্কারজনক হলো, আমাদের মিছিলে নারীরা ছিলেন সামনে আর পুলিশের নারীরা ছিলেন পুলিশবাহিনীর পেছনের দিকে। পুরুষ পুলিশরা আমাদের নারীদের ওপর হামলা করেছেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার সাজ্জাদুর রহমান বলেন, বিশৃঙ্খলা ও জনদুর্ভোগ ঠেকাতে মঙ্গলবার সকাল থেকেই শাহবাগ শাকুরা পয়েন্টে ব্যারিকেড দিয়ে রাখা হয় পুলিশের পক্ষ থেকে। আন্দোলনকারীরা ব্যারিকেডের তালা ভেঙে পুলিশের ওপর চড়াও হয়। এতে সংঘর্ষ বাধে। আন্দোলনকারীরা পুলিশের ওপর চড়াও হওয়ার পর পুলিশ আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছে মাত্র।

সারাদেশে ধর্ষণ-নিপীড়নের প্রতিবাদে টানা তৃতীয় দিনের মতো রাজধানীর উত্তরায় সড়কে মানববন্ধন-বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে উত্তরার বিএনএস সেন্টারের সামনে জড়ো হতে থাকেন ছাত্রছাত্রীরা। পরে তারা বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড, ব্যানারসহ ধর্ষণবিরোধী নানা লেখা নিয়ে রাস্তায় অবস্থান নিয়ে ধর্ষকের বিচার দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। শিক্ষার্থীদের হাতে থাকা বিভিন্ন প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল- ‘ধর্ষণমুক্ত দেশ চাই, ধর্ষকের ফাঁসি চাই’, ‘নারী কোনো পণ্য নয়, নারী কোনো ভোগ্য নয়’ প্রভৃতি। শিক্ষার্থীরা স্লোগান দেন, ‘মানুষ তুমি চুপ কেন?’, ‘আমার সোনার বাংলায় ধর্ষকের ঠাঁই নাই’ প্রভৃতি। সেখান থেকে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু হয়। এতে অংশ নেন রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, মাইলস্টোন কলেজ, উত্তরা হাইস্কুল, নবাব হাবিবুল্লাহ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এ কর্মসূচিতে যোগ দেন।

লালবাগ ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী মো. শাহাদাত হোসেন চোখে কালো কাপড় ও মুখে কালো মাস্ক পরে গতকাল গণঅবস্থানে আসেন। তার মাস্কের ওপরে লেখা- ‘পুরুষতন্ত্র নিপাত যাক’। শাহাদাত বলেন, এ রাষ্ট্রে আমরা নাগরিকরা এখন অন্ধের মতো হয়ে গেছি। ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, তবু বিচার হচ্ছে না। আইনের আওতায় আনা হয় খুবই কম। জামিন পেয়ে ধর্ষকরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। ন্যায্যবিচার হলে বারবার ধর্ষণের ঘটনা ঘটত না। এ কারণেই চোখ থাকতে আমরা অন্ধ।

দেশে একের পর এক ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদে মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে আইনপ্রণেতাদের জবাবদিহি করার দাবি জানিয়েছে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি। ধর্ষণ বন্ধে দেশব্যাপী প্রতিরোধের আহ্বান জানায় ওই কমিটি।

মানববন্ধনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফৌওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘বেগমগঞ্জের ঘটনায় নারীরা কেন লজ্জিত হবে? লজ্জিত হবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সেখান থেকে নির্বাচিত সাংসদ, প্রশাসন, নোয়াখালী থেকে নির্বাচিত ওবায়দুল কাদের এবং সংসদের স্পিকার। তারা কী জবাব দেবেন?’

পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, যতদিন মনে করবেন যে ধর্ষণের হার অন্য দেশের চেয়ে আমাদের দেশে কম, ততদিন ধর্ষণ কমবে না, বিচার হবে না। আইন ও সালিস কেন্দ্রের প্রতিনিধি ফাহমিদা জামান বলেন, সুষ্ঠু বিচার থাকলে এসব দেখতে হতো না। নারী, মেয়ে ও ছেলে শিশু নিরাপদ না।

ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রও প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন করেছে। সংগঠনের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু বলেন, দেশে ধর্ষণের মহামারী শুরু হয়েছে। ধর্ষণ আইনে পরিবর্তন এনে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।

দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি যুব মহিলা লীগের

নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ধর্ষণের প্রতিবাদে গতকাল যুব মহিলা লীগ দুপুরে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু জাদুঘরসংলগ্ন মিরপুর রোডে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। মানববন্ধনে অবিলম্বে নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণ বন্ধ এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এ সংগঠনের নেতারা। যুব মহিলা লীগ সভাপতি নাজমা আক্তারের সভাপতিত্বে এতে অংশ নেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল, সহসভাপতি ও সংসদ সদস্য আদিবা আনজুম ও খোদেজা নাসরিন, সহসভাপতি কোহেলি কুদ্দুস মুক্তি প্রমুখ। মানববন্ধনে বক্তারা নারী নির্যাতনকারীদের বর্বর ও মানুষরূপী পশু আখ্যা দেন। তারা নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। এসব অপরাধরোধে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877