বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০৭ অপরাহ্ন

বিএনপিতে হান্নান শাহ অপূরণীয়

বিএনপিতে হান্নান শাহ অপূরণীয়

মঞ্জুর হোসেন মিলন:

বিগত বিএনপি সরকারের মেয়াদ শেষে জরুরি অবস্থার সময়ে সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অব. আ স ম হান্নান শাহ ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার আস্থাভাজনদের অন্যতম। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ‘দুর্নীতি’র মামলায় দণ্ডিত। বর্তমানে খালেদা জিয়া সরকারের হস্তক্ষেপে মুক্ত আর তারেক রহমান বিদেশে (লন্ডন) অবস্থান করছেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রায় সবার নামেই রয়েছে অর্ধশতাধিক মামলা। বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর দলের এহেন কঠিন দুঃসময়ে রাজনীতিতে বিচক্ষণ, দৃঢ়চেতা ও দুঃসাহসী মরহুম হান্নান শাহর অভাববোধ করছেন তৃণমূলের বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকরা।

২০১৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বাসা থেকে আদালতে হাজিরা দিতে বের হওয়ার সময় হান্নান শাহ ঢাকার মহাখালী ডিওএইচএস’র বাসায় হৃদরোগে আক্রান্ত হলে প্রথমে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয় এবং পরে অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় চিকিৎসকদের পরামর্শে দ্রুত (১১ সেপ্টেম্বর) এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে হান্নান শাহকে সিঙ্গাপুরে নেয়া হয়। চার বছর আগে (২৭ সেপ্টেম্বর) আজকের এই দিনে ৭৫ বছর বয়সে সিঙ্গাপুরের র‌্যাফেলস হার্ট সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন কিংবদন্তি তুল্য রাজনৈতিক নেতা হান্নান শাহ। দেশে-বিদেশে সাত দফা জানাজা শেষে গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার ঘাগটিয়া চালা গ্রামে মা- বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয় তাকে।

হান্নান শাহ ১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবর গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঘাগটিয়া গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবা ফকির আবদুল মান্নান আইনজীবী এবং পাকিস্তান আমলে প্রাদেশিক মন্ত্রী ছিলেন। হান্নান শাহের ছোট ভাই শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি।

আলাপচারিতায় রাজনীতি, পরিবার এবং কাপাসিয়ার উন্নয়ন অগ্রযাত্রা নিয়ে কথা হয় হান্নান শাহর ছোট ছেলে বিএনপি নেতা শাহ রিয়াজুল হান্নানের সাথে। তার তথ্যানুযায়ী, বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন প্রাপ্ত হন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অন্য বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের সাথে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে দেশে ফিরে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে একদল সেনাসদস্যের হাতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হন। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থেকে জিয়াউর রহমানের মরদেহ ঢাকায় নিয়ে আসেন তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আ স ম হান্নান শাহ। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। তবে কিছুদিন পরে সেই সময়ের সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ জোর করে রাষ্ট্রীয়ক্ষমতা দখল করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবে হান্নান শাহ স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন। অবসরের পর এরশাদ বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন হান্নান শাহকে। এখান থেকেও হান্নান শাহ স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে ১৯৮৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দেন। যোগদানের পর প্রথমে ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক, ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত দলের সাংগঠনিক সম্পাদক (ঢাকা বিভাগ) এবং ১৯৯৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ২০০৯ সালে বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে দলের সর্বোচ্চ ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হয় হান্নান শাহকে।

হান্নান শাহ ১৯৯১ সালের নির্বাচনে গাজীপুর-৪ আসন (কাপাসিয়া) থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তাকে পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। ২০০১ সালের নির্বাচনে জিতে বিএনপি আবারো ক্ষমতায় গেলেও সেবার হেরে যান হান্নান শাহ। ২০০৭ সালের শুরুতে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর দুই বছরের জরুরি অবস্থার মধ্যে বেগম জিয়া কারাগারে থাকাকালে বিএনপিকে সংগঠিত রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন হান্নান শাহ। দলের ‘সংস্কারপন্থী’ অংশের বিরুদ্ধে সে সময় গণমাধ্যমেও সোচ্চার ছিলেন তিনি।

নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় কয়েকবার কারাগারে যেতে হয়েছিল আ স ম হান্নান শাহকে। বর্তমান সরকারের সময়েও তাকে কারাগারে যেতে হয়েছে, ৩০টি মামলা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। নাশকতাসহ বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলায় ক্লান্ত বিএনপির নেতাকর্মীরা নির্বিঘ্নে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে পারছেন না। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিএনপির নাজুক অবস্থা। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠছে না বা পেরে উঠছেন না নেতাকর্মীরা। এ অবস্থায় রাজনৈতিক সঙ্কট উত্তরণে হান্নান শাহের মতো একজন প্রতিবাদী ও সংগ্রামী নেতার অভাব বোধ করছে লক্ষ কোটি নেতাকর্মী ও সমর্থক।

জেল-জুলুম, মামলা-হামলা উপেক্ষা করে এবং ব্যক্তিগত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিকে প্রাধান্য না দিয়ে কঠিন দুঃসময়ে দৃঢ় চেতা হান্নান শাহর বিচক্ষণতা ও স্পষ্টতা মনে থাকবে দীর্ঘ সময়। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত রাজনীতি শক্তিশালী করতে এবং বর্তমান সঙ্কট নিরসনে হান্নান শাহের মতো নেতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন কর্মী-সমর্থকরা।

লেখক : সভাপতি, গাজীপুর সিটি প্রেস ক্লাব।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877