মোহাম্মদ আবু নোমান:
প্রাণপ্রিয় বাবা পারভেজ হোসেনকে ফিরে পেতে আকুতি জানিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে শিশু আদিবা ইসলাম হৃদি। সেই কান্না গণমাধ্যমে দেখে অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। শিশু হৃদির বাবার স্থানে আমরা নিজেকে দাঁড় করিয়ে উপলব্ধি করলেই বুঝতে পারব, এরকম অবস্থায় আমরা কেউ উপনীত হলে আমাদের পরিবারের অবুঝ সন্তানদের অবস্থা কী হতো? কিভাবে কাটছে স্বজনহারাদের প্রতিটি মুহূর্ত! ভাবা যায়, শিশু হৃদির মতো কত পরিবারের গুম হওয়া আপনজনদের সময় কাটছে কত কষ্ট আর যন্ত্রণায়! এর বাইরে গুম হওয়া ব্যক্তিটি যদি হয়ে থাকেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম, সেই পরিবারের সদস্যদের অসহনীয় যন্ত্রণাটা কী? ভুক্তভোগী ছাড়া এই কষ্ট বোঝা যাবে না। ৩০ আগস্ট ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের আয়োজনে স্বজনকে ফিরে পাওয়ার দাবি জানাতে আসেন স্বজনহারা পরিবারের সদস্যরা। বিশ্বব্যাপী যারা গুমের শিকার হয়েছেন, তাদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস ছিল ওই দিন।
দেশে গুম হওয়া মানুষের স্বজনদের নীরব কান্না শোনার যেন কেউ নেই। হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর স্বজনরা জানতেও পারেননি তারা জীবিত নাকি মৃত। বুকভরা বেদনা নিয়ে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় আছেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা। মা-বাবা, ভাইবোন, সন্তান, কারো স্ত্রী তাকিয়ে থাকেন দরজার দিকে। হয়তো কখনো কেউ ফিরে এসে দরজার ওপার থেকে ডাক দেবে প্রিয় নাম ধরে। অপেক্ষার রাত পেরিয়ে ভোর হয়, ফিরে না প্রিয়জন। পরিবারের স্বপ্ন ছিল যাকে ঘিরে, সেই মানুষটিই গুম হয়ে গেছে। হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর স্বজনদের প্রশ্ন কোথায় গেল তারা। তারা খুন হলে অন্তত লাশটা ফেরত দেয়া হোক এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন তাদের স্বজনরা। এ ছাড়া দেশে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, এনকাউন্টার, গুম, মাদকবিরোধী অভিযান, হেফাজতে মৃত্যুসহ নানা নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে। আমরা লাশ দেখছি। দেখছি গুম হওয়া, খুন হওয়া স্বজনের কান্না।
মানবাধিকার সংস্থা এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের হিসাবে ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে গুমের শিকার হয়েছেন ৫৫৩ জন। তাদের কেউ ফিরে এসেছেন। কেউ উদ্ধার হয়েছেন সীমান্তের ওপারে। কারো লাশ পাওয়া গেছে। কিছু ভুক্তভোগী পরিবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ তুলছে। রাষ্ট্রের কোনো না কোনো বাহিনী জড়িত বলেই জনমনে বদ্ধমূল ধারণা। তবে এ কথাও ঠিক, দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পুরনো।
বাংলাদেশে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘও। ২০০১ সালে গুমবিরোধী সনদ ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর প্রোটেকশন অব অল পারসন্স অ্যাগেইনস্ট এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স’ নামে চূড়ান্ত হয়। বিশ্বের শান্তিপ্রিয় বেশির ভাগ দেশই গুমবিরোধী সনদে সই করলেও বাংলাদেশ এখনো স্বাক্ষর করেনি।। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার ফোরামের শুনানিতে বাংলাদেশকে প্রায় নিয়মিতভাবে আসামির মতো কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে। বেশ কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনা এসেছে। বিভিন্ন সময়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নও। এসব বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছে দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংগঠনগুলোও।
টেকনাফে পুলিশের গুলিতে সাবেক সেনাকর্মকর্তা মেজর (অব:) সিনহা মো: রাশেদ খান হত্যা। মেজর সিনহা যদি সাবেক সামরিক অফিসার না হয়ে সাধারণ একজন নাগরিক হতেন, তা হলে কি এমন তোলপাড় হতো? কেউ হয়তো জানতই না বা জানলে ভয়ে চুপ করে থাকত, প্রকাশ পেত না। হয়তো অনেক ইস্যুর ভিড়ে যেমন অসংখ্য বিচারবহির্ভূত হত্যা চাপা পড়ে যায়, যা গণমাধ্যমেও আসে না। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, ওসি প্রদীপের দায়িত্ব পালনকালে টেকনাফে ১৬১টি ক্রসফায়ারের ঘটনায় ২০০ শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। এরপরও তিনি পুলিশের সর্বোচ্চ পিপিএম পদক পেয়েছেন। এর আগে তিনি বরখাস্তও হয়েছিলেন। কিন্তু কোনো কিছুই তার পদকপ্রাপ্তিতে বাধা হয়নি। মেজর সিনহার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পর থেকে সংবাদমাধ্যমে পুলিশের বিরুদ্ধে একের পর এক গুরুতর অভিযোগ আসছে। সিনহা হত্যার বিষয়ে গঠিত প্রশাসনিক তদন্ত কমিটির গণশুনানিতেও বহু মানুষ তাদের অভিযোগ জানাতে হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু সিনহা হত্যার বিষয়টি ছাড়া অন্য কোনো অভিযোগ কেউ শোনেননি। সম্প্রতি বিভিন্ন মিডিয়ার সংবাদ শিরোনামগুলো থেকে ধারণা করা যায়, জাতীয় পর্যায়ে যদি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন নিয়ে কোনো গণশুনানির ব্যবস্থা করা হয়, তা হলে তা সামাল দিতে কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হবে।
আমেরিকার চেয়ে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কম বলে ইতঃপূর্বে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন। আমেরিকা বা ব্রিটেনে যেভাবে লোকজন হারিয়ে যায়, তার সাথে আমাদের দেশের গুম পরিস্থিতির কোনো মিল নেই। কারণ সেখানকার পরিবারগুলো স্বজনদের অন্তর্ধানের জন্য রাষ্ট্রকে দোষারোপ করে থাকে না। সংবাদ সম্মেলনও করে না। বাংলাদেশী পরিবারগুলোর দুশ্চিন্তা, হতাশা, আর আমেরিকা বা ব্রিটেনের স্বজনহারাদের অসহায়তা এক নয়। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনার বিষয়ে সরকারি মহল থেকে অবিশ্বাস্য ও অগ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দেয়ায় রাষ্ট্রের ওপর নাগরিকের আস্থা তলানিতে এসে ঠেকেছে।
দেশের ইতিহাসে প্রথম আনুষ্ঠানিক অর্থে ‘পদ্ধতিগত হত্যাকাণ্ড’ পরিচালনার সূচনা ঘটে ২০০২ সালে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ অভিযানের মাধ্যমে। ওই অভিযানে পঞ্চাশের বেশি মানুষ মারা যায়। তখন বলা হয়েছিল, জিজ্ঞাসাবাদের সময় ওই সব ব্যক্তি ‘হার্ট অ্যাটাকে’ মারা গেছেন। তীব্র সমালোচনার মুখে অপারেশন ক্লিন হার্ট ২০০৩ সালে বন্ধ ও নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যুকে দায়মুক্তি দিয়েছিল ২০০৩ সালের একটি আইন। সম্প্রতি ওই আইনকে অসাংবিধানিক এবং জন্ম থেকে বাতিল বলে রায় দেন হাইকোর্ট। একই সাথে উচ্চ আদালত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে ১০০ কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করতে নির্দেশনা দেন। এ ছাড়া ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) প্রতিষ্ঠা করে বিএনপি। এর কিছু দিন পর থেকেই ‘ক্রসফায়ার’ শব্দটি আলোচিত হতে থাকে। তখন চরমপন্থী আখ্যা দিয়ে নিরীহ ব্যক্তিও ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে, এমন অভিযোগ উঠেছিল। পরে পুলিশও ক্রসফায়ারে যুক্ত হয়। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০০৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চারদলীয় জোট সরকার আমলে ক্রসফায়ারে ৭৩৬ জনের মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে ৫৪৪ জনই ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার আগে গ্রেফতার হয়েছিলেন।
ক্ষমতায় থাকাকালে বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের সূচনা হয় চারদলীয় জোট আমলে। তাদের রেখে যাওয়া ‘এক্সট্রাজুডিশিয়াল অ্যাকশন্স’ অপসংস্কৃতির অপব্যবহারের গ্যাঁড়াকলে পড়ে আজ হাড়ে হাড়ে টেন পাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত। বর্তমান ক্ষমতাসীনরা বিএনপির রেখে যাওয়া পথকেই অনুসরণ করছে। তার পরও বর্তমান ক্ষমতাসীনদের বুঝতে হবে, ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়; বরং বিচারের দাবিটাই চিরস্থায়ী। তবে বাস্তবতা হচ্ছে- যারাই ক্ষমতায় থাকেন, তারাই এই সত্যটা ভুলে যান। আমরা আশা করি, দেশ থেকে নিষ্ঠুর, যুক্তিহীন, হঠকারী ও বেআইনি হত্যাকাণ্ড অবিলম্বে বন্ধ হবে।