রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:১৫ অপরাহ্ন

সালতামামি-২০১৯: কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে দুর্গতির বছর

সালতামামি-২০১৯: কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে দুর্গতির বছর

স্বদেশ ডেস্ক:

বিদায়ী ২০১৯ সালের অন্যতম হৃদয়বিদারক ঘটনা কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। ক্রেতা না থাকায় চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়েন কোরবানিদাতারা। উপযুক্ত দাম না পেয়ে অনেকে কোরবানিকৃত পশুর চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলেন। ট্রাকভর্তি চামড়া নদীতে ফেলে দেয়ার মতো ঘটনাও দেখতে হয়েছে দেশবাসীকে। শেষ পর্যন্ত যারা কম দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন তাদের মন ছিল ভারাক্রান্ত। কারণ এর মাধ্যমে চামড়ার প্রকৃত হকদার গরিব-মিসকিনরা অন্তত ৫০০ কোটি টাকা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এ জন্য আড়তদার, ফড়িয়া, ট্যানারি মালিকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের একটি গ্রুপ অপর গ্রুপকে দায়ী করলেও সরকারের নির্লিপ্ততার সুযোগে ব্যবসায়ীরা হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল অঙ্কের টাকা। চামড়া নিয়ে এমন অরাজক ঘটনা সারা দেশের মানুষের মনে ব্যাপক দাগ কেটেছে।

ঐতিহ্যবাহী লালবাগ মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা জোবায়ের হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, কোরবানির চামড়া বরাবরই গরিব-মিসকিন ও এতিমের হক। যারা আল্লাহর হুকুম পালনে গরু, মহিষ, ছাগল বা হালাল পশু কোরবানি করেন, সেই পশুর চামড়া বিক্রির টাকা স্থানীয় মাদরাসার গরিব ছাত্র, এতিম-মিসকিন বা গরিব মানুষের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে দিয়ে থাকেন। কিন্তু কয়েক বছর হলো সেই চামড়ার দাম পাচ্ছেন না কোরবানি দাতারা। এবার কোরবানির পশুর চামড়ার দাম এমনভাবে কমেছে যে, বিক্রির জন্য ক্রেতাই খুঁজে পাওয়া যায়নি। লাখ টাকার কোরবানির গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ৪০০ টাকায়। চামড়ার দাম না পাওয়ায় কোরবানি দাতাদের অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে মাটিতেই পুঁতে ফেলেছেন বা রাস্তায় ফেলে চলে গেছেন।

এমন অসংখ্য ঘটনার মধ্যে একটির বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, সিলেট নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৮০০ পশুর চামড়া সংগ্রহ করেছিল খাসদবির দারুস সালাম মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। এ চামড়া বিক্রি করে যে টাকা আয় হতো তা দিয়ে মাদরাসার কিছুটা খরচ চলত। সারা দিনে সংগ্রহ করা ৮০০টি পশুর চামড়া ঈদের দিন রাতে আম্বরখানায় বিক্রি করতে নিয়ে গিয়েছিলেন মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ক্রেতারা প্রতি পিস চামড়ার দাম মাত্র ২৫ থেকে ৩০ টাকা দিতে চান। ব্যবসায়ীরা অজুহাত দেখান, তারা গতবারের দেয়া চামড়ার টাকাই এখনো ঢাকা থেকে পাননি। সেগুলো বকেয়া থাকায় এবার তারা দাম দিয়ে চামড়া কিনতে পারছেন না। এমনকি এই টাকায় তারা যে চামড়াগুলো কিনছেন সেগুলোও বিক্রি করা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন তারা। একপর্যায়ে মাদরাসার পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের ন্যায্য দাম দেয়ার দাবি জানিয়ে বলা হয় প্রয়োজনে বাকিতে চামড়াগুলো কিনে নিতে। ছয় মাস পরে টাকা দিলেও হবে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সেটিও মানেননি। ফলে চামড়া ব্যবসায়ীদের গঠিত সিন্ডিকেটের প্রতিবাদস্বরূপ ৮০০ চামড়া আম্বরখানায় ফেলে চলে যান তারা। দেশের বিভিন্ন এলাকায় এমন ঘটনা অহরহ ঘটেছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন অভিযোগ করেছে, আড়তদারেরা সিন্ডিকেট করে দাম কমিয়েছে। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ এ অভিযোগ করেছেন। তবে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ট্যানারি মালিকদের কাছে আমাদের বকেয়া প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। অনেকেই টাকা পাননি। আমাদের প্রায় আড়াই শ’ আড়তদারের মধ্যে ২০ থেকে ৩০ জন চামড়া কিনতে পেরেছেন। তাই বাজারে ক্রেতা কম।

চামড়ার দরপতন নিয়ে সিন্ডিকেটের কথা উচ্চারিত হলেও এর সাথে কারা জড়িত সে বিষয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খোলেননি। সিন্ডিকেটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধ কোনো প্লাটফর্ম না থাকায় সিন্ডিকেটের সাথে সংশ্লিষ্টরা বরাবরই অধরা রয়ে যায়। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, যদি ধরে নেই মধ্যস্বত্বভোগীরা সুযোগ নিয়েছেন, তা হলে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা কী করেছেন? এর পেছনে কোনো চক্র যদি কাজ করে তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা উচিত। পরিস্থিতি যে পর্যায়ে তাতে বোঝা যাচ্ছে, বাজার পর্যবেক্ষণ ঠিকমতো হয়নি। এর মাধ্যমে এ শিল্পের কতটা লাভ বা ক্ষতি হবে সেটি বিবেচনা করা জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এ বছর কোরবানির আগে প্রতি বর্গফুট কাঁচা চামড়ার মূল্য সরকারিভাবে নির্ধারণ করা হয় ঢাকায় ৪৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৫ টাকা। একেকটি গরুর চামড়া হাতবদল হয়েছে ২০০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে। ট্যানারি মালিকরা এবার সরকারি দামেই চামড়া কেনার কথা জানিয়েছেন। কারখানায় প্রক্রিয়ার পরে এসব চামড়া দিয়ে জুতা, স্যান্ডেল, ব্যাগ বা জ্যাকেট তৈরি করা হয়ে থাকে। বাজারে চামড়ার দাম দিন দিন অস্বাভাবিক হারে কমলে একই হারে বাড়ছে চামড়াজাত পণ্যের দাম। জনমনে প্রশ্ন, চামড়ার এমন দরপতনের পরও এসব পণ্যের দাম এতটা চড়া কেন?

ক্ষোভ প্রকাশ করে ধানমন্ডির ব্যবসায়ী সোলায়মান খান নয়া দিগন্তকে বলেন, যখন কোরবানির চামড়া প্রায় পানির দরেই বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন, তখনো দোকান থেকে চামড়ার পণ্য কিনতে হচ্ছে কয়েক গুণ বেশি দাম দিয়ে। কিছু দিন আগে কোরবানির গরুর চামড়া বিক্রি করতে হলো মাত্র ৩০০ টাকায়। এর বেশি কেউ দাম দেবে না। কিন্তু যখন দোকান থেকে জুতা-স্যান্ডেল কিনতে এলাম, কোনোটাই চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকার নিচে কিনতে পারছি না। তা হলে এত সস্তায় চামড়া কিনে, সেটা দিয়ে জিনিসপত্র বানিয়ে এত বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে কেন?

অভিযোগের জবাবে বাংলাদেশের ফিনিশড লেদার ও লেদারসামগ্রী প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, কাঁচামালের সাথে তৈরি হওয়া পণ্যের দাম মেলানো যাবে না। বিশেষ করে চামড়ার মতো কাঁচামাল অনেক হাত ঘুরে আমাদের কাছে আসে। এখন যে চামড়াটা আপনি ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে বলছেন, সেটা কিন্তু আমাদের কাছে আসতে দর অনেক বেড়ে যায়। আমরা সরকারি রেট অনুযায়ীই কিনছি। এর সাথে সেটাকে প্রসেস করা, কারখানা ও শ্রমিক খরচ যোগ হবে। এরপর সেই প্রসেসড চামড়াটা আরেকজন কিনে নিয়ে দেশী-বিদেশী ক্রেতাদের অর্ডার অনুযায়ী সেটা দিয়ে জুতা, স্যান্ডেল বা ব্যাগ তৈরি করবে। তার কাছ থেকে সেসব ব্র্যান্ড এসব পণ্য কিনে নিয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি করে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, এক জোড়া জুতা বিদেশে রফতানি করা হয় হয়তো ১৪ বা ১৬ ডলারে, কিন্তু সেটাই হয়তো বায়ার তার দোকানে বিক্রি করছে ৮০ বা ১০০ ডলারে। সেখানেও তাদের অনেক খরচ রয়েছে বলে তিনি বলেন। বিজ্ঞাপন, দোকানের খরচ, কর্মী ব্যয় এবং অনেক সময় জুতা বা পণ্য অবিক্রীত থেকে যায়, এসব খরচও সেখানে যোগ হয়। তৈরী পোশাকসহ এ ধরনের সব ব্যবসাতেই এ বিষয়গুলো অনুসরণ করা হয় বলে তিনি জানান।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877