রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ১১:৫৩ অপরাহ্ন

প্রাথমিকে ঝরে গেল দেড় লক্ষাধিক

প্রাথমিকে ঝরে গেল দেড় লক্ষাধিক

স্বদেশ ডেস্ক:

প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা গত রোববার শেষ হয়েছে। এবার পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনো অভিযোগ উঠেনি। প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনীতে ছয়টি বিষয়ের পরীক্ষায় বহিষ্কৃৃত হয়েছে ১১৭ জন। এর মধ্যে প্রাথমিকে ২৬ জন এবং ইবতেদায়িতে ৯১ জন। প্রাথমিকের গণিত ও ইংরেজি পরীক্ষায় কোনো বহিষ্কার নেই। তবে ইবতেদায়িতে ইংরেজি ও গণিতে বহিষ্কার হয়েছে যথাক্রমে ১১ জন ও ৫০ জন। প্রাথমিকের এ তথ্য নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। কারণ গণিত ও ইংরেজি নিয়েই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভীতি বেশি। এ ভীতি শুধু প্রাথমিকে নয়, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও এ ভীতি বিরাজ করছে। কিন্তু দুই দিনের (গণিত ও ইংরেজি) পরীক্ষায় কোনো পরীক্ষার্থী নকলের অভিযোগে বহিষ্কার না হওয়ার তথ্যকে গ্রহণযোগ্য নয় বলে অভিযোগ করেছে পরীক্ষা মনিটরিং করা সংস্থা ও ব্যক্তিরা। তারা বলেন, এটি কোনো অবস্থায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এতে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে।

এবারের প্রাথমিকে বহিষ্কার হওয়া ২৬ জনের সবাই ভুয়া পরীক্ষার্থী বলে নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছে। তারা পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ছিল না। তাদের প্রায় সবাই এবারের জেএসসিতে অংশ নিয়েছিল। অন্যের নামে তারা পরীক্ষা দিতে এসেছিল। তাদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়, তবে অন্য কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, তারা কম বয়সী। তারা স্বপ্রণোদিত হয়ে পরীক্ষা দিতে আসেনি। পরীক্ষায় অংশ নিতে বাধ্য করেছে কিছু অসাধু শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) মহাপরিচালক এ এফ এম মনজুর কাদির গতকাল সোমবার নয়া দিগন্তকে বলেন, বেসরকারি সাহায্য সংস্থা পরিচালিত স্কুলের শিক্ষার্থী এরা। মাঠপর্যায়ে এদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দেয়া হবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে।
সমাপনী শুরুর বছর থেকেই প্রশ্ন ফাঁসের অভিযাগ উঠে। এর জন্য তদন্ত কমিটিও করতে হয়েছে; কিন্তু তাতেও ঠেকানো যায়নি। এবার (২০১৮ সাল) প্রশ্ন ফাঁস হয়নি বলে একপ্রকার বাহবাই নিচ্ছে মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর (ডিপিই)। প্রশ্ন ফাঁস না হওয়ার কারণ হচ্ছে, সমাপনী পরীক্ষায় নির্বাচনী প্রশ্ন (এমসিকিউ) বাদ দেয়া হয়েছে গত বছর থেকে। প্রশ্ন ফাঁস হয়ে থাকে মূলত এমসিকিউর জন্য; কিন্তু ছয়টি বিষয়ের প্রতিটিতে ১০০ নম্বর করে মোট ৬০০ নম্বরের পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়েছে। ফলে ছোট্টমণিদের ওপর লেখার চাপ বেড়েছে।

পরীক্ষার শেষ দিনে প্রাথমিক ও ইবতেদায়িতে অনুপস্থিত ছিল এক লাখ ৪৮ হাজার ৯০৪ জন। এরা সবাই সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য নিবন্ধিত হয়েছিল। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে যে তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে তাতে দেখা যায়, প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনীতে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য প্রবেশপত্র সংগ্রহ করে ২৯ লাখ আট হাজার ১৮৭ জন খুদে শিক্ষার্থী। এর মধ্যে প্রাথমিকে ২৫ লাখ ৫৫ হাজার ৯২ জন এবং ইবতেদায়িতে তিন লাখ ৫৩ হাজার ৯৫ জন। গত ১৭ থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত চলা সমাপনী পরীক্ষায় উপস্থিত ছিল প্রাথমিকে ২৪ লাখ ৫৪ হাজার ৪৫২ জন। ইবতেদায়িতে তিন লাখ ৪৮ হাজার ৩৪ জন। প্রাথমিকে অনুপস্থিত ছিল এক লাখ ৬৪৩ জন। আর ইবতেদায়িতে ৪৮ হাজার ২৬১ জন। দুই ধারায় অনুপস্থিত এক লাখ ৪৮ হাজার ৯০৪ জন। এ সংখ্যাটিই ঝরে পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রাথমিক প্রায় দেড় লক্ষাধিক শিক্ষার্থী ঝরে পড়াকে আশঙ্কাজনক ও হতাশার বলে মন্তব্য করেন তারা।

পরীক্ষায় এরা কেন অংশগ্রহণ থেকে বিরত রইল তার কোনো ব্যাখ্যা বা জবাব নেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই)। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার পরীক্ষার আগ মুহূর্তে দেশব্যাপী প্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে তিন বিভাগের ১৭ জেলায় ব্যাপক ক্ষতি এবং বহু মানুষ আশ্রয়হীন হয়। প্রাকৃতিক এ বিপর্যয়ের কারণে শিক্ষার্থী কমেছে।

মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, এ ক্ষেত্রে দারিদ্র্যই মূল কারণ বলে মনে করা হয়; কিন্তু সরকারের উদ্যোগের পরও বিপুল শিক্ষার্থী ঝরে পড়া যা-ই বলি না কেন হতাশাজনক। শতভাগ ভর্তিও এখন প্রায় নিশ্চিত হয়েছে। তবে এবারের পরীক্ষায় প্রাথমিকে পরীক্ষার্থী কমেছে এবং ইবতেদায়িতে বেড়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশে জন্মহার কমেছে। তাই প্রাথমিকে ভর্তি কম হয়েছে। ইবতেদায়িতে কেন বাড়ল, তার উত্তরে প্রতিমন্ত্রী ও প্রাথমিকের সচিব বলেন, মাদরাসাপর্যায়ে এখনো জন্মহার রোধ করা যায়নি। এবার প্রাথমিকে পরীক্ষার্থী বিগত বছরের চেয়ে দুই লাখ ২৩ হাজার ৬১৫ জন কম। ইবতেদায়িতে গত বছরের তুলনায় ৩০ হাজার ৯৮৩ জন ছাত্রছাত্রী বেড়েছে। প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় ছাত্রের চেয়ে ছাত্রী এক লাখ ৬৬ হাজার ৮৭৪ জন বেশি। এটিই আশাব্যঞ্জক তথ্য। প্রাথমিকে ছাত্রী বাড়ার কারণ সম্পর্কে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের নানা উদ্যোগের কারণে ছাত্রীসংখ্যা বাড়ছে। এটা আশাব্যঞ্জক।

পরীক্ষার্থী অনুপস্থিতির কারণ সম্পর্কে ডিপিইর মহাপরিচালক বলেন, কিছু বেসরকারি স্কুল ও এনজিওর কারণে এমনটি ঘটেছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও এনজিওকে চিহ্নিত করতে এ বছর ব্যবস্থা নেয়া হবে। মাঠপর্যায়ে তথ্য নেয়ার পর প্রকৃত অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করা হবে এবং স্কুলে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হবে। তিনি এসব শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে মানতে নারাজ। দেশে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কর্মরত এনজিওগুলোর মোর্চা গণসাক্ষরতার প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধুরী নয়া দিগন্তকে বলেন, সমাপনী পরীক্ষা এত দিন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে যতটা উৎসব ও আনন্দময় ছিল, এটি ফিকে হয়ে গেছে। সমাপনী পরীক্ষা এখন তাদের জন্য বোঝা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সমাপনী ঘিরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার-নোট গাইড এবং একশ্রেণীর শিক্ষক ভয়ানক বাণিজ্য গড়ে তুলেছেন। এগুলো সামাল দেয়া রাজধানীর অভিভাবক ও উচ্চবিত্তের জন্য সম্ভব হলেও নি¤œবিত্ত ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য এটি বোঝা। এ কারণেই চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীকে পৌঁছানোর পর চূড়ান্ত পরীক্ষায় সন্তানদের অংশ নেয়ার সুযোগ দিতে পারছেন না অভিভাবকরা। এর ফলে ঝরে পড়ছে বেশি।

এটি শুধু বিশেষজ্ঞদের মত নয়, বরং গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। সমাপনী পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। সমাপনী হলে জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষা কেন? আর জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষা চালু থাকলে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা কেন? এর যেকোনো একটি পরীক্ষা চালু থাকতে পারে। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক জাফর ইকবাল তো গত কয়েক বছর থেকেই বলছেন, অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত কোনো পাবলিক পরীক্ষা রাখা উচিত নয়। তিনি বলেন, কোমলমতি শিশুদের আনন্দ পাঠ বা খেলাধুলার মাধ্যমে শেখানো উচিত। জোর করে তাদের ওপর পরীক্ষা চাপিয়ে দিয়ে ভালো কিছু আশা করা বাস্তবসম্মত নয়।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877