সোমবার, ০৩ Jun ২০২৪, ০৭:৫৮ অপরাহ্ন

নায়ক হয়েও নায়ক নন যারা….

নায়ক হয়েও নায়ক নন যারা….

আরফাতুন নাবিলা: পৃথিবীতে নায়কের চেয়ে খলনায়কের গল্পই বেশি। নায়করা বেঁচে থাকেন তাদের ভালো কাজের মাধ্যমে, আর খলনায়করা নিষিদ্ধ এবং খারাপ কাজের মধ্য দিয়ে। কিছু ক্ষেত্রে মানুষের ভালো করেও অনেকেই সম্মান আর ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তাদের বেছে নিতে হয়েছে নির্বাসিত জীবন অথবা মৃত্যু। এমনই কিছু মানুষকে নিয়ে আজকের এই লেখা:-
হাগ থম্পসন: প্রায় ৫০ বছর আগে সংঘটিত ভিয়েতনামের মিন লাই গণহত্যা সম্পর্কে কমবেশি আমরা সবাই জানি। এই গণহত্যায় আমেরিকান সৈন্যদের হাতে নিরস্ত্র অনেক ভিয়েতনামবাসী মারা যায়। ১৯৬৮ সালের ১৬ মার্চ সাউথ ভিয়েতনামে এই গণহত্যা সংঘটিত হয়। এই গণহত্যা আমেরিকানদের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়। আমেরিকান সৈন্যরা সেদিন কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই ভিয়েতনামবাসীর ওপর অতর্কিত হামলা করে। সাধারণ জনগণের ওপর সে হামলা হয়তো বন্ধ হতো না, যদি না সেখানে উপস্থিত হতেন মেজর হাগ থম্পসন। গণহত্যার সেই দিনটি ছিল ১৯৬৮ সালের ১৬ মার্চ। সেদিন হেলিকপ্টারের পাইলটের আসনে ছিলেন মেজর থম্পসন। সে সময় তিনি নিচ থেকে অতর্কিত গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান। তখনই তিনি করে নিচে নেমে এলেন ঘটনার পূর্ণ অবস্থা দেখতে। তার সহকারী ক্রুকে সঙ্গে নিয়ে তিনি নিচে এসে যা দেখতে পান তার জন্য তারা মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। দেখামাত্রই যেকোনো ভিয়েতনামবাসীকে হত্যা করার যে নির্দেশ আমেরিকান সৈন্যরা পেয়েছিল, তা মানতে গিয়ে তখন পর্যন্ত তারা ৫০৪ জন মানুষকে হত্যা করেছে! এর মধ্যে ২১০ জনের বয়স ছিল ১২ বছরের নিচে, ৫০ জন ছিল ৩ বছরের শিশু! এই হতাহতের দৃশ্য দেখে থম্পসন নিজের ট্রেনিংয়ের সব কথা ভুলে গিয়ে নিজের ভাবনামতো কাজ করা শুরু করেন। হেলিকপ্টার ল্যান্ড করে তিনি বন্দুক তুলে ধরেন তার দেশেরই সৈন্যদের দিকে। তিনি বলেন, নিরীহ ভিয়েতনামবাসীর ওপর যদি আর একটাও গুলি চলে, তাহলে তিনি তার সৈন্যদের গুলি করতে এক মুহূর্ত দ্বিধাবোধ করবেন না। তার নির্দেশ পেয়ে সৈন্যরা গোলাগুলি বন্ধ করে। বন্ধ হয় হত্যাকান্ড। থম্পসন আর ক্রু মিলে যথাসাধ্য চেষ্টা করেন আহতদের সেবা দেওয়ার। দেশে ফিরে এসে থম্পসন তার সিনিয়রদের এ বিষয়ে জানান। পরবর্তী সব মিশন বাতিল করে দেওয়া হয়। বেঁচে যায় নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে থাকা শত শত ভিয়েতনামবাসী।
সে সময় কেউ থম্পসনকে জীবন বাঁচানো নায়ক হিসেবে মানতে চায়নি। অনেকে আজও মানে না। তার এই কাজের জবাবদিহির জন্য তাকে কংগ্রেস থেকে তলব করা হয়। সেখানে প্রতিনিধিরা তাকে অনেক কটূক্তি করেন। কংগ্রেস থেকে বলা হয় তাকে যেন আদালতে পাঠানো হয়। জনগণও তাকে ঘৃণা করতে থাকে। প্রতিদিন তার ফোনে মৃত্যুর হুমকি আসত। ৩০ বছর ধরে তার কাজ স্থগিত রাখা হয়। মৃত্যুর আট বছর আগে থম্পসন শেষ পর্যন্ত তার কাজের জন্য স্বীকৃতি পান। তাকে সেনাবাহিনী থেকে মেডেল দিয়ে সম্মান দেওয়া হয়। ২০০৬ সালে মাত্র ৬২ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
জোসেফ গোল্ডবার্গার: ২০ শতকের শুরুর দিকে, দক্ষিণ আমেরিকায় একটি সমস্যা দেখা দেয়। এলাকা জুড়ে দেখা দেয় পেলাগ্রা নামক একটি রোগ। প্রায় ৩০ লাখ মানুষ এই জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। রোগের ধরন ছিল বেশ করুণ। রোগীর চামড়া খসে পড়ত। তারা পাগল হয়ে যেত। এদের মধ্যে প্রায় দশ লাখ লোক এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এই দুর্ভোগের অবসানে এগিয়ে আসেন জোসেফ গোল্ডবার্গার নামে একজন ব্যক্তি। তিনি রোগীদের সাহায্য করার উদ্দেশ্যে নিউ ইয়র্ক ত্যাগ করেন। কিন্তু বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে দক্ষিণ আমেরিকায় আটকে দেওয়া হয়। বর্তমানে ভয়াবহ রোগ পেলাগ্রার কারণগুলো জানা। নিকোটিনিক এসিডের স্বল্পতার কারণে এ রোগ হতো। সে সময় চিকিৎসকদের এ ব্যাপারে কোনো ধারণা ছিল না। ১৯১০ সালে মানুষজন জানত এ রোগ মানুষের মাধ্যমেই একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে ছড়ায়। গোল্ডবার্গার গবেষণা করে জানান এ রোগ হয় মূলত সঠিক পুষ্টির অভাবে। কিন্তু তার কথা কেউ মানতে চাইল না। কারও কথা না শুনে স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে গোল্ডবার্গার কয়েদিদের ভুট্টা, বিস্কুট, ভাত আর মিষ্টি আলু খাওয়াতে লাগলেন। দক্ষিণে এই খাবারগুলো জনপ্রিয় থাকার কারণেই এগুলোকে বেছে নেওয়া হতো। দুই সপ্তাহ পর, রোগীরা পেলাগ্রার প্রথম লক্ষণ নিয়ে রিপোর্ট করলেন। পুষ্টিকর খাবারের কারণে তাদের স্বাস্থ্য ধীরে ধীরে ভালো হচ্ছিল। এত স্বচ্ছ প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তার সব চেষ্টা, ইচ্ছা, চিকিৎসাকে বাতিল করে দেওয়া হলো। গোল্ডবার্গার বারবার চেষ্টা করেও বোঝাতে ব্যর্থ হলেন যে দক্ষিণীদের খাদ্যাভ্যাসের কারণেই এ সমস্যা গুরুতর আকার ধারণ করেছে। এত এত মানুষ মারা যাচ্ছে। এ সমস্যার উত্তরণে তাদের প্রতিদিনের জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করা খুব জরুরি। কিন্তু একে তো ইহুদি তার ওপর আমেরিকান হওয়ার কারণে গোল্ডবার্গারের কথা কেউ শুনল না। বরং বারবার নানা জায়গায় তাকে প্রতিহত করা হলো।
এই মানুষদের বোঝাতে গোল্ডবার্গার কঠিন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হলেন। ১৯১৬ সালে, তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘নোংরা দল’। এই দলে তিনি ছাড়া আরও ছিলেন তার স্ত্রী এবং আরও ১৬ জন স্বেচ্ছাসেবক। তারা সবাই পেলাগ্রা রোগীদের শরীরের রক্ত নিজেদের শরীরে প্রবেশ করান। এটির পরও যখন তাদের মেনে নেওয়া হচ্ছিল না, তখন তারা কেকপিঠার সঙ্গে রোগীদের চামড়া, কফ, মল-মূত্র মিশিয়ে খাওয়া শুরু করলেন। এত কিছুর পরও তারা সবার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হচ্ছিলেন! কিন্তু গোল্ডবার্গার হাল ছাড়েননি। তিনি মারা যান ১৯২৯ সালে। তার আগ পর্যন্ত তিনি তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেছেন। দক্ষিণ আমেরিকায় ১৯৪০ সাল নাগাদ পেলাগ্রা রোগের নিরাময় হয়নি।
বাজ অলড্রিন: ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে, নীল আর্মস্ট্রং আর বাজ অলড্রিন এমন একটি কাজ করেন, যা তাদের আগে কেউ করেননি। তারা চাঁদ জয় করেন। লাখ লাখ মানুষের স্বপ্নপূরণ করা কোনো সহজ কথা ছিল না। অলড্রিন বুঝতে পারছিলেন না তার এত বড় অর্জনকে কীভাবে তিনি মানুষের উন্নতির কাজে লাগাবেন। চাঁদের নিস্তব্ধতার মতো তিনি যেন অনুভব করছিলেন ‘দুর্দান্ত নীরবতা’। পৃথিবীতে কোনো কিছুর সঙ্গেই এর তুলনা চলে না। দেশের যেখানেই তিনি যাচ্ছিলেন সেখানেই তিনি পাচ্ছিলেন অত্যধিক জনপ্রিয়তা। সবাই তাকে এক নজর দেখতে চায়, তার সঙ্গে ছবি তুলতে চায়। কিন্তু এতসব জনপ্রিয়তা চাচ্ছিলেন না অলড্রিন। তিনি শুধু কাজে ফিরতে চান। কিন্তু তার আর করার মতো কিছু ছিল না। কোনো কাজ না থাকায় দিনের পর দিন অলড্রিন শুধু বিছানায় শুয়ে থাকতেন। শুধু মদ্যপান করার জন্য তিনি বিছানা থেকে উঠে বাইরে যেতেন। এমনকি তার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না স্ত্রী জোয়ানেরও। কিছুদিন পর অলড্রিন কাজে ফিরলেন টেস্ট পাইলট হিসেবে। কিন্তু এই কাজটিও খুব বেশি দিন চলল না। কোমর আর ঘাড় ব্যথায় তিনি ভুগতে লাগলেন। মদ্যপান এবং অলসতার মাত্রা আরও বেড়ে গেল।
১৯৭৪ সালটি ছিল অলড্রিনের জন্য অন্ধকার একসময়। সে সময় অলড্রিনের বাবা মারা গেলেন, স্ত্রীর সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হয়ে গেল। কয়েক মাস পর, তিনি বিয়ে করলেন বান্ধবী বেভারলিকে। এই বিয়েটাও বেশি দিন টিকল না। এর একমাত্র কারণ ছিল তার অতিরিক্ত মদ্যপান। অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে বেশিক্ষণ কথাও বলতে পারতেন না অলড্রিন। এক দিন মাতাল অবস্থায় তিনি তার বান্ধবীর ঘরের দরজা ভেঙে ফেলেন। পুলিশ গ্রেপ্তার করে জাতীয় এই নায়ককে। ১৯৭৮ সালে অলড্রিন শেষবারের মতো মদ্যপান করেন। তিনি নাম লেখালেন বেনামি মদ্যপায়ীর তালিকায়। আজ প্রায় ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি নীরব রয়েছেন। মিডিয়ায় আজকাল তাকে নিয়ে খুব বেশি প্রচার দেখা যায় না।
কেভিন কার্টার: খাবারের আশায় বসে থাকা একটি শিশু মৃত্যুর প্রহর গুনছে। তার শরীরের প্রতিটি হাড় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিছু দূরেই একটি শকুন অপেক্ষা করছে শিশুটির মৃত্যুর। শিশুটি মারা গেলেই সে তাকে ঠুকরে ঠুকরে খাবে। এমন দৃশ্যের ছবিটির গল্প আজ বিখ্যাত জগৎ জুড়ে। কিন্তু এমন একটি দৃশ্য চোখের সামনে দেখা যেকোনো মানুষের জন্যই ভয়াবহ বিষয়। এই ছবিটা যখন তোলা হয়, তখন শিশুটির দিকে তাকিয়ে রয়েছিল দুই জোড়া চোখ। একটি সেই অপেক্ষমাণ শকুনের আর অন্য জোড়া চোখ ছিল ফটোগ্রাফার কেভিন কার্টারের। বিশৃঙ্খলা ভরা জীবন সঙ্গে নিয়ে কেভিন কার্টার তার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার জাতিগত অস্থিরতা, যুদ্ধ, দাঙ্গা নিয়ে ডকুমেন্ট তৈরির শুরুর মধ্য দিয়ে। এ রকমই এক দুঃসহ সময়ে তার তোলা ছবিটি বিখ্যাত হয়ে যায়। ‘একটি শকুন এবং ছোট্ট মেয়ে’ অথবা ‘সংগ্রামী মেয়ে’ শিরোনামের সেই ছবিটি আজও বিখ্যাত। ১৯৯৩ সালে তোলা এই ছবিটি সুদানের দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। ছবিটি তোলার পর অনেকে প্রতিষ্ঠান অর্থসাহায্য করেছিল। সবাই তার ছবি তোলার ক্ষমতা আর মানবিক দিকের প্রশংসা করলেন। কার্টার পুলিৎজার পুরস্কারও অর্জন করলেন। তার এতসব সাফল্য চোখ এড়াল না সমালোচকদের। পুলিৎজারের অনুষ্ঠানে অনেক শ্রোতা তার এই ছবির ব্যাপারে অভিযোগ জানায়। দক্ষিণ আফ্রিকার ফটোগ্রাফাররা এই ছবির ভুল অর্থ দাঁড় করায়। অনেকেই কার্টারকে দোষারোপ করেন, তিনি চাইলে মেয়েটির দুরবস্থা দূর করতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি শুধু নিজে বিখ্যাত হতে চেয়েছেন একটি ছবি তোলার মাধ্যমে। সবাই বলার আগ থেকেই কার্টার নিজেকে এই নিয়ে দোষ দিয়ে আসছিলেন।
তিনি যখনই ক্যামেরা ধরতে যান, তখনই তাকে বিষণœতা ঘিরে ধরে। ছবির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি তখনো জানতেন না কিন্তু কার্টার এটাও মানতে পারছিলেন না যে তিনি চাইলেই মেয়েটিকে বাঁচাতে পারতেন। এ বিষয়টি তার ভেতরে আরও জেঁকে বসে যখন তিনি পুলিশের হাতে প্রতিবাদকারীদের মৃত্যু হতে দেখেন এবং বন্ধু কেন ওস্টারব্রোকের হত্যার কথা শোনেন। প্রতিদিনের জীবন এবং ক্যারিয়ারে তিনি হোঁচট খেতে থাকেন। বান্ধবীর সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্কে ছেদ পড়তে শুরু করে। এলোমেলোভাবে তিনি বিভিন্ন জায়গায় তার ফিল্মের রিলগুলো শেষ করে ফেলতে লাগলেন। এমনকি ফটোগ্রাফি নিয়ে তার আর কোনো চিন্তাভাবনাই ছিল না। তার একমাত্র নেশা হয়ে গেল মারিজুয়ানা আর ঘুমের ওষুধ মেশানো একটি ড্রাগ ‘হোয়াইট পাইপ’-এর প্রতি। পুলিৎজার অর্জনের দুই মাস পর মাত্র ৩৩ বছর বয়সে তিনি মারা যান।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877