মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৫, ০৯:১৫ অপরাহ্ন

উভয় সংকটে পুলিশ

‍স্বদেশ ডেস্ক:

সরকারের পটপরিবর্তনের পাঁচ মাস পরও পুলিশের আত্মবিশ^াস পুরোপুরি ফেরেনি। দায়িত্ব নিতে চান না অনেক পুলিশ সদস্য। আসামি গ্রেপ্তারের জন্য অভিযানে অংশ নিতে অনীহা অনেক পুলিশ সদস্যের। রাজনৈতিক মামলার তদন্তেও আগ্রহ কম। এখনও বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনায় আস্থাহীনতায় রয়েছেন এই বাহিনীর সদস্যরা। ফলে যেনতেনভাবে চাকরিটা চালিয়ে নিতে চাচ্ছে পুলিশের বড় একটি অংশ। এর ফলে দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সম্প্রতি পুলিশের বিভিন্ন স্তরের ১০ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে এই চিত্র উঠে এসেছে।

পুলিশের এসব সদস্য আমাদের সময়কে বলেন, পুলিশের দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না। মাঠ পুলিশের দায়িত্ব সিনিয়র অফিসাররা নিচ্ছেন না। কোনো অভিযোগ উঠলেই বদলি কিংবা সাময়িক বহিষ্কার করা হচ্ছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক মামলার তদন্তে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের স্বাধীনতা কম। মামলার তদন্ত হয় তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে। সেই অনুযায়ী মামলার তদন্ত করলে গেলেও বিপাকে পড়তে হচ্ছে। আবার স্রোতের জোয়ারে গা ভাসিয়ে তদন্ত করলেও ভবিষ্যতে বিপাকে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পুলিশ এখন উভয় সংকটে রয়েছে। তাই গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করছে মাঠ পুলিশের একটি অংশ। এর প্রভাব পড়ছে দেশের সার্বিক নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলায়।

পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের বিভিন্ন থানায় অন্তত ৭ বছর ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এক পুলিশ পরির্দশক গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, চাকরিটা টিকে থাকলে বেতন পাওয়া যাবে। চাকরি চলে গেলে পরিবার নিয়ে খাব কী? তাই কোনোভাবে চাকরিটা চালিয়ে যাচ্ছি। কোনো ধরনের ঝুঁকির মধ্যে যাচ্ছি না। পুলিশ সদস্যদের একটি অংশ এভাবে গা বাঁচিয়ে চলছে বলে জানান তিনি।

গত ২৯ ডিসেম্বরের পুলিশের ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজির কক্ষে ঢুকে ‘হুমকি’ দেওয়ার ঘটনায় মাঠ পুলিশের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে

দেখা যায়, ময়মনসিংহে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক আশরাফুর রহমান চেয়ারে বসে আছেন। তার সামনে হইচই করছেন বেশ কয়েকজন। কেউ উচ্চস্বরে ধমকাচ্ছেন, কেউ বা অভিযোগ করছেন, কেউ বা প্রশ্ন করে জবাব চাইছেন। এই ঘটনা নিয়ে আলোচনা গড়িয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর পর্যন্ত।

ময়মসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি আশরাফুর রহমান তখন জানান, এক জাসদ নেতা এক সিটি কাউন্সিলরকে গ্রেপ্তার করা নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নাম করে কিছু লোকজনকে নিয়ে তার কক্ষে ঢুকে এ ঘটনা ঘটিয়েছেন।

পুলিশের কর্মকর্তারা বলেন, এভাবে চলতে থাকলে কাজ করা কঠিন। পুলিশের কাজের জবাবদিহি শুধু

পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে করা উচিত। যে কোনো বিষয় নিয়ে যদি পুলিশকে জনে জনে জবাবদিহি করতে হয়, তাহলে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা কঠিন।

সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, রাজনৈতিক নেতাদের বুঝতে হবে যে, তদন্ত স্বাধীনভাবে করতে দিতে হবে। এটার সদিচ্ছা থাকতে হবে। যারা চূড়ান্ত অর্থে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন করতে হবে। তাদের পরিবর্তন হোক আর না হোক, আইন অনুযায়ী কাজ করতে হবে। এখন অফিসারদের কাজ হবে অধস্তনরা যাতে মনোবল না হারায়, সেটি নিশ্চিত করা। পুলিশ রাষ্ট্রের প্রধান আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এখন পুলিশের যদি মনোবল ভেঙে যায়, তাহলে এটা সমাজের জন্য বাঞ্জনীয় নয়। একটি ফৌজদারি অপরাধের সুষ্ঠু বিচার হবে কী করে, যদি সুষ্ঠু তদন্তই না হয়।

মামলার তদন্তের বিষয়ে নুরুল হুদা বলেন, মামলার তদন্ত করতে হবে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে। কোনো রাজনৈতিক দল কী ভাবল এটা বাস্তবতা হলেও এভাবে তো কাজ করার নিয়ম না। কে কার দিকে চাইল, আর কে কী বলল, ওভাবে তো তদন্ত হয় না। আগে ওভাবে করা হয়েছে বলেই তো এই দুর্দশা হয়েছে। তিনি বলেন, বিদ্যমান সংকট উত্তরণে সরকার ও পুলিশকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।

জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকা-ের একটি মামলায় পরিদর্শক শাহ আলমকে কুষ্টিয়া থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গত বুধবার দিবাগত রাত ১২টার পর তাকে কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় উত্তরা পূর্ব থানায় আনা হয়। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে তিনি থানা থেকে পালিয়ে যান। পুলিশ হেফাজত থেকে ঢাকার উত্তরা পূর্ব থানার সাবেক ওসি শাহ আলমের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনার সময় দায়িত্বে থাকা ওসি মো. মহিববুল্লাহকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে এই প্রতিবেদকের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন পরিদর্শক মর্যাদার তিন পুলিশ কর্মকর্তা। তারা বলেন, কাজ করতে গেলে ভুল হবে। কাজ না করলে তো আর ভুলও হবে না। এখন আসামি গ্রেপ্তার করতে গেলে আইন অনুযায়ী আত্মরক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু এখন পুলিশকে মারলেও প্রতিউত্তর করা যায় না। প্রভাবশালী কেউ অভিযোগ করলেই পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তাদের দাবি, উত্তরা পূর্ব থানার ওসি মহিববুল্লাহের দোষের যথাযথ তদন্ত না করেই শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

মাঠ পুলিশের কার্যক্রমে গতি না থাকার বিষয়ে অধস্তনদের নিয়মিত পদোন্নতি না পাওয়াকে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন দুই পুলিশ সদস্য। তাদের একজন বলেন, ২৩ বছর আগে সারদায় যে বিসিএস ক্যাডার পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ট্রেনিং করেছি তারা এখন ডিআইজি। আবার আমি পুলিশ ইন্সপেক্টর থাকায় অবস্থায় যারা এসআই হিসেবে যোগদান করেছেন তারাও এখন ইন্সপেক্টর। আর আমিও ইন্সপেক্টর। এতটা বছর কোনো পদোন্নতি নেই। তাহলে ভালো কাজ করার আগ্রহ কীভাবে তৈরি হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশের একটা অংশের মধ্যে এখনও অনিশ্চয়তা রয়েছে। অনেকে এখনও মামলার ভয়ে আছেন। গ্রেপ্তার-মামলার তদন্ত নিয়ে সরকার ও প্রভাবশালীরা কী ভাববে, সেটা নিয়েও ভয়ে থাকতে হচ্ছে পুলিশকে। পুলিশের প্রায় ৫০ হাজার সদস্যের বদলি করা হয়েছে। নতুন জায়গায় ভিন্ন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতেও সময় লাগছে। ফলে পুলিশি কার্যক্রমে গতি কিছুটা বাড়লেও পুরোপুর আস্থা ফিরে আসেনি, যার প্রভাব পড়ছে বাহিনীর ওপর। রাজপথের প্রকাশ্য রাস্তায় কুপিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। সারাদেশের আইনশৃঙ্খলার ওপরও এর প্রভাব পড়ছে।

রাজধানীর ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বে থাকা একাধিক কর্মকর্তা বলেন, সড়কে আইন ভাঙলে মামলা দিতে গেলে অনেকেই বাজে ব্যবহার করে। ৫ আগস্টের আগের পুলিশের ভূমিকা নিয়ে কটু কথা বলেন। ট্রাফিক পুলিশের ওপর চড়াও হন, এমন ঘটনাও আছে। এখন আইন মানাতে গেলে গালিগাজের শিকার হই। আবার গালিগালাজের ভয়ে আইনি পদক্ষেপ না নিলে সড়কে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। আমরা এখন উভয় সংকটে আছি।

সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, আমাদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি আছে। সেটা আইনগত প্রশ্নে হোক কিংবা অপরাধী গ্রেপ্তার ও তদন্তের প্রশ্নে হোক। এই ঘাটতিগুলো কীভাবে পূরণ করা যায়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পেশাদারত্বমূলক ভূমিকা পালনে সক্রিয় করে তুলতে হবে। এই জায়গায় পুলিশকে প্রস্তুত করতে বাহিনীকে ঢেলে সাজাতে হবে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877