স্বদেশ ডেস্ক:
দেশ জুড়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ চলছে। গতকাল শুক্রবার পঞ্চগড়ে চলতি শীত মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ৩ রেকর্ড করা হয়েছে। শীতের তীব্রতা আর দুদিন থাকতে পারে। এদিকে শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শীতজনিত রোগ বাড়ছে। সর্দি-কাশি, জ্বর, নিউমোনিয়া, টনসিলাইটিস, ব্রংকিউলাইটিস, সাইনোসাইটিস, অ্যাজমা, চর্মরোগ, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়াসহ শীতজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু থেকে বয়স্ক সব বয়সের মানুষ। বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শিশু ও বয়স্করা। হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে শীতজনিত রোগীর চাপ বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত বছর নভেম্বর থেকেই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা শীতজনিত রোগীদের তথ্য সংগ্রহ করছে। অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর নভেম্বর থেকেই হাসপাতালগুলোতে শীতজনিত রোগী আসতে শুরু করে।
এ বছরের প্রথম দিনই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শীতজনিত শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত রোগে (অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন বা এআরআই) আক্রান্ত চারজন মারা গেছে। গত তিন দিনে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৯ হাজার ৭৫৮ জন। তাদের মধ্যে ডায়রিয়ার রোগী ৭ হাজার ২০০ ও নিউমোনিয়া, ফুসফুসে সংক্রমণসহ শীতজনিত শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত রোগী ২ হাজার ৫৫৮ জন।
অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত বছর ১ নভেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত হাসপাতালে ১ লাখ ৬০ হাজার ৬৬৮ জন শীতজনিত রোগী ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে ১ লাখ ১৫ হাজার ৭৭৬ জনই শীতজনিত ডায়রিয়া রোগী, যা মোট রোগীর ৭২ শতাংশ। বাকি ৪৪ হাজার ৫৯২ জন বা ২৮ শতাংশ শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত রোগী।
গত বছর ১ নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৫৫ জন। তাদের মধ্যে ৫৪ জনই শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণজনিত রোগে আক্রান্ত ছিল, যা মোট মৃত্যুর ৯৮ শতাংশ।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এক মাস আগেই হাসপাতালগুলোতে শীতজনিত রোগীর চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আবু হোসেন মো. মইনুল আহসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, শীতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে এক মাস আগেই আমরা হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছি। শীতজনিত রোগীর চিকিৎসায় বিশেষ গাইডলাইন তৈরি করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব গাইড লাইনে হাসপাতালে রোগীদের কম্বল ব্যবহার, হাসপাতালের ভাঙা জানালা-দরজা মেরামত, নেবুলাইজার মেশিন ঠিক করা, অক্সিজেন সিলিন্ডারে অক্সিজেন রাখা ইত্যাদি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এখন এসবের খোঁজ নিচ্ছি। অক্সিজন ও অ্যান্টিবায়োটিকসহ কোনো ধরনের ওষুধ বা সরঞ্জামাদির সংকটের কোনো তথ্য আমরা পাইনি।
এ চিকিৎসক কর্মকর্তা সাধারণ মানুষের উদ্দেশে বলেন, বাচ্চা ও বয়স্ক এ দুই বয়সীদের অবশ্যই শীতের থেকে দূরে রাখতে হবে। এদের নিউমোনিয়া, ফুসফুসে সংক্রমণ, শ্বাসতন্ত্রের রোগ হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। যতটুকু সম্ভব ঘরের বাইরে না যাওয়া ও ঘরের ভেতর থাকতে হবে। সেরকম কষ্ট হলে নিকটস্থ হাসপাতালে যেতে হবে। বাসায় থেকে ঝুঁকি নেওয়ার দরকার নেই।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ শফি আহমেদ বলেন, শীতে সর্দি, কাশি, ব্রংকিউলাইটিস ও অ্যাজমার প্রকোপ বাড়ছে। চর্মরোগ ও ডায়রিয়াও বাড়ছে। শিশুদের ঠান্ডা থেকে দূরে রাখতে হবে। গরমের কাপড় পরিধান করাতে হবে। বিশুদ্ধ পানি খেতে হবে। নাক দিয়ে পানি এলে নরমাল স্যালাইন দিয়ে নাক পরিষ্কার করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিহিস্টামিন ও অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া যাবে না। শ্বাসকষ্ট হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়াতে হবে।
পঞ্চগড়ে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড : জেলা পঞ্চগড়ে চলতি শীত মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ৩ রেকর্ড করা হয়েছে, যা দেশের ও মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। এতে আবার তৃতীয় দফা শুরু হলো শৈত্যপ্রবাহ। চলছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। গেল ডিসেম্বরের মাঝামাঝি রেকর্ড হয়েছিল ৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি। তবে দুদিন ধরে ঘন কুয়াশার পর সকালেই রোদের দেখা মিলেছে। ফলে দিনের বেলা স্বস্তিতে ছিল মানুষ।
গতকাল সকাল ৯টায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করেছে তেঁতুলিয়া আবহাওয়া অফিস। বৃহস্পতিবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১১ দশমিক ৩ ডিগ্রি। দিনের তাপমাত্রা (সর্বোচ্চ) রেকর্ড করা হয় ২০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তিন দিন পর আবারও শুরু হয়েছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। হালকা কুয়াশার সঙ্গে উত্তরের হিমেল বাতাসে হাড়কাঁপানো শীত অনুভূত হচ্ছে। এতে দুর্ভোগ বেড়েছে জনজীবনে। বিশেষ করে দিনমজুর, কৃষিশ্রমিক, পাথরশ্রমিক, রিকশা-ভ্যানচালকসহ খেটে খাওয়া মানুষের বেশি দুর্ভোগ দেখা দেয়।
তেঁতুলিয়া আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জিতেন্দ্র নাথ রায় বলেন, শুক্রবার সকাল ৯টায় চলতি শীত মৌসুমের সর্বনিম্ন ৮ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। একই সঙ্গে বাতাসের আর্দ্রতা ৯৯ শতাংশ এবং গতি ছিল ঘণ্টায় ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার। এই সপ্তাহে শীতের তীব্রতা আরও বাড়তে পারে। শীতে সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্টজনিত বিভিন্ন রোগব্যাধি।
সূর্যের দেখা মিললেও নেই কোনো তাপ: নীলফামারীতে চার দিন পর ঘন কুয়াশা কেটে উঁকি দিয়েছে সূর্য। গতকাল সকাল থেকে সূর্য মামার দেখা মেলায় খুশি শীতার্ত মানুষ। কিন্তু ছিল না রোদের কোনো তাপ। এতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কিছুটা বাড়লেও কমেনি শীতের প্রকোপ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবারও শীত জড়িয়ে ধরছে খেটেখাওয়া মানুষদের।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, কিছু অঞ্চলে রাতের তাপমাত্রা কমলেও বেড়েছে দিনের তাপমাত্রা। উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগে এখনো রয়েছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহের অধীনে। তবে উত্তুরে হিম বাতাস বইছে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, শনি ও রবিবার পূর্বাভাসেও একই ধরনের আবহাওয়া থাকতে পারে, যার মধ্যে রাত এবং দিনের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে শীতের অনুভূতি বাড়বে কারণ রাত এবং দিনের তাপমাত্রার পার্থক্য কম থাকবে। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, চলতি মাসে তিন থেকে পাঁচটি শৈত্যপ্রবাহের শঙ্কা রয়েছে। শীতের অনুভূতি বাড়াতে তাপমাত্রার পার্থক্য কম থাকার কারণে আরও শৈত্যপ্রবাহের আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে দেশের উত্তর ও উত্তরপূর্ব, উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে দুটি মাঝারি থেকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া চলতি মাসে দেশের অধিকাংশ এলাকায় স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হতে পারে। এদিকে কয়েক দিন ধরে সৈয়দপুর বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ ওঠানামাতেও ব্যহত হয়েছে।
কুড়িগ্রামে বিড়ম্বনায় অতি দরিদ্ররা : জেলার ওপর দিয়ে বইছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ১৬টি নদ-নদীর তীরবর্তী চর ও দ্বীপ চরের কয়েক লাখ অতিদরিদ্র মানুষগুলো বিপদে পড়েছে। শীতের দাপটে ব্যাহত হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত ঘনকুয়াশায় ঢেকে গেছে সমগ্র জেলা। গতকাল সকাল ৯টায় জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করেছে রাজারহাট আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র। প্রয়োজন ছাড়া লোকজন তেমন একটা ঘর থেকে বাইরে বের হচ্ছে না। গ্রামাঞ্চলের দরিদ্ররা খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টাও করছে।
কুড়িগ্রাম আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার বলেন, কয়েক দিন তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করার পর বয়ে যাচ্ছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ, যা আরও কয়েক দিন অব্যাহত থাকতে পারে।
বিপর্যস্ত জনজীবন : ভোলায় টানা দুদিনের শৈত্যপ্রবাহে জনজীবনে অচলাবস্থা নেমে এসেছে। ঘনকুয়াশার কারণে দিনভর সূর্যের দেখা মিলছে না। সবচেয়ে কষ্টে দিন কাটছে ভোলার জেলেপল্লীর মানুষের। শীতের তীব্রতায়ও জীবিকার তাগিদে নদীতে নামছে জেলেরা। এ ছাড়া বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলের মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। শীতের তীব্রতায় সন্ধ্যার পর কমে যাচ্ছে যানবাহন, ফাঁকা হচ্ছে শহর, বন্দর, হাটবাজার। শৈত্যপ্রবাহের মৃদু বাতাস আর কনকনে শীতে কাঁপছে ভোলার মানুষ।
এদিকে ঘনকুয়াশার কারণে ভোলা-লক্ষ্মীপুর নৌরুটে ফেরি চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। ঘনকুয়াশার কারণে রাতে ফেরি চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এতে দুই পাড়ে পারাপারের অপেক্ষায় আটকে আছে প্রায় শতাধিক যানবাহন। ভোলা- লক্ষ্মীপুর রুটের ফেরি ইনচার্জ কাওসার হোসেন জানান, রাতে ঘনকুয়াশার কারণে ফেরি চলাচল করতে অসুবিধা হচ্ছে।
ভোলার আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, গত দুদিনে ভোলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রয়েছে। তবে আগামী কয়েক দিনে তাপমাত্রা আরও নিচে নামতে পারে। এ ছাড়া আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ও ঘনকুয়াশা অব্যাহত থাকতে পারে।