স্বদেশ ডেস্ক:
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাবুল ইসলাম ঢাকায় একা থাকেন। প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবারে সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে নিজ পরিবারের কাছে জামালপুরে ছুটে যান। আবার ছুটি কাটানো শেষে রোববার সকালে ঢাকায় ফিরে অফিস ধরেন। এভাবেই প্রতি সপ্তাহে তিনি ট্রেনে করে যাওয়া–আসা করছেন নিয়মিতভাবে।
গত বৃহস্পতিবারও কমলাপুর স্টেশন থেকে ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেসে করে রওনা হয়েছিলেন বাবুল। কিন্তু পথে হঠাৎ চলন্ত ট্রেনটি থেমে যায়। স্টাফদের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন, ময়মনসিংহের ত্রিশালে ফাতেমানগর স্টেশনে একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে, তাই লাইন বন্ধ। এতে শুধু বাবুল একা নন, তাঁর মতো আরও হাজারখানেক যাত্রী আটকা পড়েন। শেষ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টা পর দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনটি উদ্ধার করার পর বন্ধ লাইনটি সচল হয়। ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
গত বৃহস্পতিবার রাত সোয়া নয়টার দিকে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী মহুয়া কমিউটার ট্রেনটি ফাতেমানগর স্টেশনে ঢোকার সময় দুটি রেললাইনের সংযোগস্থলে ইঞ্জিনসহ চারটি বগি নিয়ে লাইনচ্যুত হয়। এরপর রাজধানী ঢাকার সঙ্গে ময়মনসিংহ বিভাগের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাতে অন্য আরও কয়েকটি ট্রেন বিভিন্ন স্টেশনে আটকা পড়ে।
ততক্ষণে বাবুলের মতো অন্যান্য ট্রেনে আটকে পড়া যাত্রীদেরও অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়তে হয়। রাত হয়ে যাওয়ায় খাবারের দোকান বন্ধ ছিল এবং বিকল্প উপায়ে যাওয়ার জন্য অন্য কোনো যানবাহনও পাওয়া দুষ্কর ছিল। উপায়ান্তর না পেয়ে ট্রেনে বসেই অলস সময় কাটাতে হয়েছে বিভিন্ন ট্রেনের যাত্রীদের। আর মধ্যবর্তী স্টেশনগুলোয় অপেক্ষারত ট্রেনযাত্রীদের স্টেশনে অপেক্ষা করতে হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
তবে এ ঘটনায় বড় ধরনের কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। জরুরি ভিত্তিতে রিলিফ কল করা হলে ঢাকা ও ময়মনসিংহ থেকে দুটি উদ্ধারকারী ট্রেন ঘটনাস্থলে এসে রাতভর চেষ্টা চালিয়ে তিনটি বগি উদ্ধার করে ভোর পাঁচটার দিকে মেইন লাইনটি সচল করতে সক্ষম হয়। তবে পার্শ্ববর্তী লাইনে থাকা ট্রেনের ইঞ্জিন ও অপর আরেকটি কোচ উদ্ধারে আরও সময় লাগে এবং সকাল ১০টা নাগাদ পুরোপুরি উদ্ধারকাজ শেষ হয়। এ ঘটনার ফলে শুক্রবারও এই রুটে চলাচলকারী প্রতিটি ট্রেনেরই শিডিউল বিপর্যয় দেখা দেয়। ফলে প্রতিটি ট্রেনই কয়েক ঘণ্টা দেরিতে চলাচল করেছে।
যাত্রীদের অভিযোগ, এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ এই অঞ্চলের রেল নেটওয়ার্কের আধুনিকায়নে গুরুত্ব না দেওয়ায় এ ধরনের
ঘটনা বারবার ঘটছে। কর্তৃপক্ষ কার্যত কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
আরমানুল হক নামের হাওর এক্সপ্রেসের এক যাত্রী বলেন, ময়মনসিংহ অঞ্চলের রেলপথে বিভিন্ন সময়ে ট্রেন লাইনচ্যুতির দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু পুরোনো লাইনটির আধুনিকায়নে রেল কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত উদাসীন ভূমিকা পালন করছে। এ ছাড়া পুরোনো লাইন ও স্লিপার বদল না করা এবং নিয়মিত তদারকির অভাবকেও দায়ী করেন তিনি।
জামালপুর কমিউটার ট্রেনের যাত্রী গোলাম রাব্বানী ট্রেন লাইনচ্যুতি প্রসঙ্গে তিনি রেলের আধুনিকায়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, সারা বিশ্ব এগিয়ে গেলেও এ দেশের রেল যোগাযোগ এখনো সেই মান্ধাতা আমলের পদ্ধতিতেই চলছে। তাই পুরোনো সবকিছু পরিবর্তন করে আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহারের পরামর্শ দেন তিনি। দাবি জানান প্রতিটি সিঙ্গেল লাইন সেকশনগুলো ডাবল লাইনে উন্নীত করার।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাতের ঘটনা ছাড়াও ১০ মে আঠারবাড়ীতে ময়মনসিংহ এক্সপ্রেস, ১৪ আগস্ট নান্দাইল রোড স্টেশনে ভৈরব লোকাল, ১৭ সেপ্টেম্বর কেওয়াটখালি এলাকায় তিস্তা এক্সপ্রেস, ১২ অক্টোবর নীলগঞ্জে একটি মালগাড়ি, পরদিন ময়মনসিংহ স্টেশনের সামনে একটি ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হয়।
এ ছাড়া গত বছরের ডিসেম্বরে শম্ভুগঞ্জে একটি মালগাড়ি, সেপ্টেম্বরে ফাতেমানগর স্টেশনে জামালপুর কমিউটার ও ময়মনসিংহ স্টেশনে একটি মালগাড়ি এবং অক্টোবরে বলাশপুর এলাকায় ময়মনসিংহ এক্সপ্রেস ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়েছিল। সে সময় প্রতিটি লাইনচ্যুতির ঘটনাতেই দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেন উদ্ধারে গড়ে সাত থেকে আট ঘণ্টা করে সময় ব্যয় হয়। এতে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। এমনকি উদ্ধারকারী ট্রেন উদ্ধারকাজে গিয়ে নিজেই লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
এত ঘন ঘন ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনার বিষয়ে ময়মনসিংহ স্টেশন সুপার জহুরুল ইসলাম বলেন, একটি ট্রেন লাইনচ্যুতির পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে, তবে কারিগরি বিষয় সম্পর্কে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, স্লিপার পুরোনো হয়ে নড়ে যাওয়া, ইঞ্জিন ও বগিতে ত্রুটি থাকা, নির্ধারিত গতিসীমার চেয়ে বেশি গতিতে ট্রেন চালানোসহ ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে মাটি নরম হয়ে গেলে ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটতে পারে। তবে ট্রেন
পরিচালনা যেহেতু একটি দলগত কাজ এবং বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের সমন্বয়ে ট্রেন চলাচল করে, তাই এ ধরনের সমস্যা প্রতিরোধে তিনি লোকবল–সংকটকেই দায়ী করেন।
রেলওয়ের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী সুকুমার বিশ্বাস বলেন, ব্রিটিশ শাসনামলে স্থাপিত রেললাইনগুলোর সংস্কারকাজ জরুরি। তবে তিনিও লোকবল–সংকটের কারণ দেখিয়ে বলেছেন, অনেক সময় দায়িত্বে অবহেলার জন্যও ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটে। তবে যাত্রী ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুরক্ষায় নিয়মিতভাবে রেললাইনে তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম গুরুত্বসহকারে করে যাচ্ছেন বলে দাবি এই প্রকৌশলীর।