স্বদেশ ডেস্ক:
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের একশ দিন পূর্ণ হলো আজ শনিবার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট শপথ নেয় বর্তমান সরকার। এরপর দেশের বিপর্যস্ত অর্থনীতি, ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক করার পাশাপাশি রাষ্ট্র সংস্কারের কার্যক্রম শুরু করে সরকার। নানা শ্রেণি-পেশার অধিকারের দাবি আর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির অস্বস্তির মধ্যেও সরকারের গতি ফিরতে শুরু করেছে অর্থনীতি, আইনশৃঙ্খলা, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসনসহ সর্বত্র। এদিকে রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার প্রশ্নে সরকারকে সমর্থন দিলেও তারা দ্রুত নির্বাচন চাইছে।
এ সময়ে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো। বিএনপি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছে। অন্যথায় রাজপথে আন্দোলনে নামার কথা বলেছেন দলটির নেতারা। যুগপৎ আন্দোলনের দলগুলোও নির্বাচনের বিষয়ে সরকারকে অবস্থান স্পষ্ট করার আহ্বান জানিয়েছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনের চাপ সামলে রাষ্ট্র সংস্কারে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার।
বর্তমান সরকার এ সময় ১০টি অধ্যাদেশ জারিসহ ৯৫টি সংবিধিবদ্ধ প্রজ্ঞাপন ও আদেশ জারি করা হয় ৯৫টি। এ ছাড়া ঐতিহাসিক ৭ মার্চসহ আওয়ামী লীগের দলীয় দিবস বলে পরিচিত আটটি জাতীয় দিবস বাদ দেওয়া হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর বাড়ানো হয় উপদেষ্টা পরিষদ। গত ১০ নভেম্বর নতুন উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম, চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী ও ব্যবসায়ী শেখ বশির উদ্দিন। প্রধান উপদেষ্টাসহ এই সরকারের সদস্য সংখ্যা এখন ২৪ জন। এ ছাড়া প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় বিশেষ সহকারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তিনজনকে।
সরকারের উপদেষ্টাদের ভাষ্যমতে, দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দেশের অর্থনীতি সচল ও বিভিন্ন সেক্টরের সংস্কারে মনোযোগ দিয়েছে এই সরকার। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার বিচারকাজ শুরু, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাও কাজ করছে।
নির্বাচনের চাপ : একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রকাঠামোয় দায়িত্ব নেওয়ার একশ দিনের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের দাবি তুলেছে রাজনৈতিক দলগুলো। একদিকে রাষ্ট্রে সংস্কার, অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের নির্বাচনের চাপ সামলে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার। তবে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সর্বশেষ সংলাপে নির্বাচনই প্রাধান্য পেয়েছে। তারা এই সরকারের কাছে নির্বাচন ও সংস্কারের একটি রোডম্যাপ চেয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কার শেষ করে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোট ছাড়া অন্য সব রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা প্রতিনিয়ত বৈঠক করছেন। বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা রাজনীতিতে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে তাদের বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছেন। ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ও সংস্কার নিয়ে সম্পাদকম-লীর সঙ্গেও বৈঠক করেছেন।
নানান প্রতিকূলতা : একশ দিনের পথ মোটেই মসৃণ ছিল না অন্তর্বর্তী সরকারের। শুরু থেকেই নানামুখী চাপে পড়ে সরকার। নতুন সরকারের কাছে একের পর এক দাবি-দাওয়া নিয়ে হাজির হতে থাকেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন। কেউ আসেন চাকরি জাতীয়করণের জন্য, কেউ গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে। এ ছাড়াও ঘটেছিল মব জাস্টিজের ঘটনা, শিক্ষকদের পদত্যাগ, সচিবালয়ে আনসারের অবরোধ কর্মসূচি। সবই ভালোভাবে সামাল দিয়েছে সরকার। রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ নিয়েও বেশকিছু দিন আন্দোলন চলছিল। সেটিও সফলভাবে সামাল দেয় সরকার।
গণহত্যার বিচারকাজ শুরু : জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচারকাজ শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে অর্ধশতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। সেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতা, পুলিশের তৎকালীন আইজিসহ বেশ কয়েকজন সদস্য, র?্যাবের তৎকালীন ডিজি, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাদের আসামি করা হয়। ইতোমধ্যে গণহত্যার মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এ ছাড়া পৃথক অভিযোগে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, দীপু মনি, আকম মোজাম্মেল হকসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধেও একই আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
সংস্কার কমিটি : রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের লক্ষ্যে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন, গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম ও নারীষিয়ক ১০টি কমিশন গঠন করা হয়। এ ছাড়া গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনগুলো এরই মধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু : ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে- জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচারে জাতিসংঘের নেতৃত্বে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরকে আমন্ত্রণ, শহীদ ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি, আহতদের দীর্ঘমেয়াদে চিকিৎসা ও শহীদদের পরিবারের দেখাশোনার জন্য ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ গঠন।
এ ছাড়া ব্যাংকগুলোকে বড় বড় ঋণখেলাপি ও লুটেরা ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দখল থেকে মুক্ত করে পরিচালনা পরিষদ পুনর্গঠন; দুর্নীতি ও অর্থ পাচারে অভিযুক্ত প্রভাবশালী দেড়শ ব্যক্তির তালিকা তৈরি ও ৭৯ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু; ১৫ শতাংশ হারে আয়কর পরিশোধ করে কালো টাকা সাদা করার বিধান বাতিল; দায়মুক্তি আইন নামে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের অধীন চলমান সব কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা; গণশুনানি ছাড়া নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি না করার সিদ্ধান্ত; রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া প্রকল্প কিংবা একনেকে যাওয়ার প্রক্রিয়াধীন আছে- এমন প্রকল্প পুনরায় যাচাই-বাছাই করার সিদ্ধান্ত। গুম থেকে নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর।
দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরতে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের অধীন সম্পাদিত চুক্তিগুলো পর্যালোচনায় জাতীয় কমিটি গঠন, তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তিসহ অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। তবে রাষ্ট্রের সংস্কার সম্পন্ন করা, নির্বাচন ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের সঙ্গে নিত্যপণ্যের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ বেশি আলোচনায় আসছে।
৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকে আত্মগোপনে চলে যান আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা। তবে শীর্ষ নেতৃত্বসহ আওয়ামী সরকারের ঘনিষ্ঠ আমলাদের অনেকেই গ্রেপ্তারও হয়েছেন। স্বৈরশাসনের অবসানের পর মানুষের মধ্যে বিপুল আশা ও উদ্দীপনা রাষ্ট্র সংস্কার ও অর্থনীতি পুনর্গঠন করে একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের।