বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:৫১ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
ছাত্রদল নেতার গুদামে সাড়ে ১৭ লাখ টাকার ভারতীয় কম্বল-সিগারেট যে ১২ নির্দেশনা দিলেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল কাদের আসেন, আমার বাসায় আসেন: মির্জা ফখরুল পিআইবির মহাপরিচালক হলেন ফারুক ওয়াসিফ চাকরির বয়সসীমা ৩৫ চান প্রশাসন ক্যাডাররা, জনপ্রশাসনকে জানাল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বন্যা দেখতে গিয়ে নদীতে পড়ে গেলেন দুই এমপি ফ্যাসিবাদে জড়িত কবি, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের আইনের আওতায় আনা হবে গণহত্যায় উসকানিদাতা কবি-সাংবাদিকদেরও বিচারের আওতায় আনা হবে : নাহিদ ইসলাম সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতার সুফল পাবে জনগণ : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আমরা সরকারকে সময় দিতে চাই : মির্জা ফখরুল
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিচার পুনরায় করা সম্ভব?

বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিচার পুনরায় করা সম্ভব?

স্বদেশ ডেস্ক:

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আবারো ২০০৯ সালের পিলখানা হত্যাকাণ্ডের আলোচনা সামনে এসেছে। নতুনভাবে সামনে আসছে নানা অভিযোগ আর ষড়যন্ত্রের আলোচনা।

এই ঘটনায় রাজনৈতিক দোষারোপ আগেও হয়েছে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া অতীতে একাধিকবার এর পেছনে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাকে দায়ী করেছেন। একইভাবে শেখ হাসিনাও বারবার আঙুল তুলেছিলেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর দিকে।

পিলখানা ঘটনার ১৫ বছর পেরিয়ে যাবার পর এখন পুনরায় তদন্তের দাবি আসছে বিভিন্ন তরফ থেকে। সে ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত সেনা ও বিডিআর পরিবার তো বটেই, তৎকালীন সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদও ভিডিও বার্তায় সেই দাবি তুলেছেন।

সেনাবাহিনীর তদন্ত আদালতে সরকারের সহযোগিতা না করার অভিযোগও করেছেন। যদিও তার বিরুদ্ধেও এ ঘটনায় সম্পৃক্ততার অভিযোগ করে এসেছে বিএনপিসহ বিভিন্ন মহল।

সেনাবাহিনী ও তৎকালীন বিডিআর সদস্যদের পরিবারগুলোর অনেকে ঘটনাটিকে‘বিডিআর বিদ্রোহ’ বলতে চান না। তাদের মতে পুরো বিষয়টিই ছিল ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের আলোচনায় সবচেয়ে বেশি আসছে আওয়ামী লীগ সরকার এবং ভারতের নাম।

বিডিআর নায়েক শামছুল ইসলামের ছেলে জুয়েল আজিজ বলেন, ‘পিলখানার গণ্ডগোলটা যদি না হতো তাহলে এই সরকার এতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেন না। কারণ পিলখানার ঘটনা দিয়েই সেনাবাহিনীকে দমন করে সরকার এতদিন ক্ষমতায় ছিল।’

বিডিআর পরিবারের আরেক সদস্য আইনজীবী আব্দুল আজিজ ভারতের দিকে ইঙ্গিত করে বলছিলেন, ‘বড়াইবাড়ি যুদ্ধে আমার আব্বু বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রধান সহকারী ছিল বলে তাকে টার্গেট করা হয়।’

২০০১ সালে কুড়িগ্রামের বড়াইবাড়ি গ্রামে (রৌমারী সীমান্তে) ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সাথে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষা বাহিনীর রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ হয় যেখানে ১৬ জন বিএসএফ ও ২ জন বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) সেনা নিহত হয়।

আব্দুল আজিজের বাবা আব্দুর রহিম তৎকালীন বিডিআরের উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলে জানান আব্দুল আজিজ।

বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় তাকে আসামী করা হয় এবং কারা হেফাজতে তার মৃত্যু হয় ২০১০ সালে।

ওই ঘটনায় আগের অপমৃত্যুর মামলা থাকলেও এখন নতুন করে সিএমএম আদালতে একটি মামলা করেছেন আব্দুল আজিজ।

সেখানে অভিযুক্ত তালিকায় এসেছে শেখ হাসিনা, জেনারেল আজিজ আহমেদ, শেখ ফজলে নূর তাপস, শেখ সেলিম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, হাসানুল হক ইনু, এমন বেশ কিছু নাম।

এছাড়াও তৎকালীন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মহাপরিদর্শক, জেল সুপার, দায়িত্বরত ডাক্তারসহ ২০০ জন অজ্ঞাতনামাকে আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

আব্দুল আজিজ জানান তার বাবার বিরুদ্ধে পোক্ত প্রমাণ না থাকায় তাকে রাজসাক্ষী করার চেষ্টা করা হয়।

আব্দুল আজিজ বলেন, ‘উনি রাজসাক্ষী হন নাই। ১৭ মাস তিনি কারাভোগ করার পরে পরবর্তীতে উনি অসুস্থ হয়। পায়ে এবং পেটে ব্যথা ছিল। আম্মু দেখতে গিয়ে জিজ্ঞেস করে কী চিকিৎসা দেয়া হয়েছে, আব্বু বলে যে আমাকে ইনজেকশন দেয়া হইসে। এই ইনজেকশন দেয়ার ১৮-২৪ ঘণ্টার ভেতর আমার আব্বু মারা যায়।’

তৎকালীন বিডিআর সদস্যদের পরিবারদের নানা ধরনের সামাজিক হেনস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।

আব্দুল আজিজ বলেন, ‘আমার বোন ও ভাইকে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে বিদ্রোহীর সন্তান বলে, আমাদের লেখাপড়া থেকে প্রতিটা পদে পদে আমাদের বঞ্চনা করা হয়েছে।’

বিডিআর নায়েক শামছুল ইসলামের সন্তান জুয়েল আজিজও জানাচ্ছিলেন ক্ষোভের কথা।

জুয়েল আজিজ বলেন, নিজের চোখেই দেখলাম যে গোলাগুলি চলতেছে, সবাই এদিক ওদিক ছুটতেসে। অথচ আমার বাবা তার অফিসরুমে নামাজে দাঁড়ায় গেছে। আমার সেই নামাজরত বাবার তিন বছরের সাজা হইসে। টোটাল সাত বছর জেল খেটে বের হইসে।’

এরপর যতদিন তার বাবা বেঁচে ছিলেন ততদিন সবসময় খুব বিমর্ষ থাকতেন এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপবাদ মাথায় নিয়েই তার মৃত্যু হয়।

জুয়েল আজিজ জানান, তার বাবা বেঁচে থাকতে ‘দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতো সারাজীবন সততার সাথে চাকরি করে শেষ বয়সে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা মাথায় নিয়ে মারা যাওয়া যে কতটা কষ্টের বাবা তোরা বুঝবি না। সন্তান হিসেবে চাই আমার বাবা মরণোত্তর কলঙ্কমুক্ত হোক।’

আব্দুল আজিজ এবং জুয়েল আজিজ ‘পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ঐক্য’ নামের সংগঠনের যথাক্রমে আহ্বায়ক এবং সদস্য সচিব।

নয় দফা দাবি নিয়ে তারা ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ শুক্রবার বিকেল ৩টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানবন্ধনের ডাক দিয়েছেন।

পিলখানায় নিহত সেনাসদস্যদের পরিবারের তরফ থেকেও বেশ কিছু দাবি সামনে আনা হয়েছে। এর মাঝে আগের সব তদন্ত প্রতিবেদন বিস্তারিত প্রকাশ, ক্ষতিগ্রস্ত বা চাকরীচ্যুত পরিবারের ক্ষতিপূরণ, নির্দোষ বিডিআর সদস্যদের মুক্তির মতো বিষয়ও রয়েছে।

এর পাশাপাশি আগেকার তদন্তে যেসব নাম উঠে আসেনি সেগুলো সামনে আনা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতে তদন্তের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন সাকিব রহমান, যিনি প্রয়াত কর্নেল কুদরত ইলাহী রহমান শফিকের সন্তান ও আইনজীবী।

কুদরত ইলাহী রহমান বলেন, ‘আগেকার মামলায় যাদের মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে তারা ‘হয়তো সেই অ্যাকশনের সাথে জড়িত ছিল। কিন্তু এটার মাস্টারমাইন্ড যারা কিনা পর্দার আড়ালে রয়ে গেছে, তাদেরকে বের করাটাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য।’

বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো: জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী অবশ্য পুনরায় তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন। যিনি তৎকালীন সেনাবাহিনীর তদন্ত কমিটির দায়িত্বে ছিলেন।

সঠিকভাবে এই হত্যাকাণ্ডের পূর্ণ তদন্ত ও ন্যায়বিচার প্রক্রিয়া শিগগিরিই শুরু করা হবে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম।

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। ১৫ জনের মৃত্যু হওয়ায় উচ্চ আদালতে মোট ৮৩৫ আসামির শুনানি শুরু হয়।

২০১৭ সালে হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ১৮৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয় ২২৮ জনের। খালাস দেয়া হয় ২৮৩ জনকে। পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ হয়েছিল ২০২০ সালে।

এখনো আপিল বিভাগে ঝুলছে অনেকের আবেদন। ঝুলছে বিস্ফোরক মামলাও। তবে ১৫ বছর পর এসে নতুন করে তদন্ত বা বিচারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের জায়গা রয়েছে।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান বলেন, ‘এটার মামলা সংক্রান্ত বিভিন্ন আলামত, সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স, এবং ঐ সময়কার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, সাক্ষ্যপ্রমাণের বিষয়গুলো হয়তো অনেক সময় এভেইলেবল থাকবে না।’

তবে আগের যেসব তথ্যপ্রমাণ রয়েছে সেগুলোর সাথে আগে হয়তো সাক্ষ্য দিতে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে, বা আগে দিতে পারেননি এমন হলে এখনও তদন্ত সম্ভব বলে জানান তিনি।

শিহাব উদ্দিন বলেন, যদি বিষয়টি এমন হয় যে পুনঃতদন্ত চাওয়া হচ্ছে এইজন্য যে যাদের সংযোগে হত্যাকাণ্ডটি হয়েছে বা কী কারণে সংগঠিত হয়েছে, মোটিফ কী ছিল, এই জায়গাগুলো বের হয়ে আসেনি সেটি আমার মনে হয় এই পর্যায়েও সফলভাবে করা সম্ভব।

আগের বিচারপ্রক্রিয়ায় যে রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করার অভিযোগ এসেছে, পুনরায় তদন্তের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বিবেচনার যেন না আসে এবং আসলেই যারা পরিকল্পনার সাথে জড়িত সেটা সঠিকভাবে সামনে আনার প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।

পিলখানার ঘটনাটির পরিসর বেশ বড়। পূর্ণাঙ্গ বিচারও প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। ১৫ বছরে অনেকের সাজা ভোগ শেষ হয়েছে, অনেকে অপেক্ষায়, আবার অনেকে মারাও গেছেন। তবে এনিয়ে অনেক ধরনের আক্ষেপের জায়গাও রয়ে গেছে। ন্যায়বিচার নিশ্চিতে এখন নতুন মাত্রা যুক্ত হবে কিনা সেদিকে নজর থাকবে সামনের দিনগুলোতে।

সূত্র : বিবিসি

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877