স্বদেশ ডেস্ক:
আগামী বছরের ১ জুলাই থেকে যেসব ব্যক্তি সরকারি চাকরিতে যোগ দেবেন তারা আর প্রচলিত পেনশন সুবিধা পাবেন না। এর পরিবর্তে তাদেরকে সর্বজনীন পেনশনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দফতর কাজ শুরু করে দিয়েছে বলে জানা গেছে।
অর্থমন্ত্রী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন আগামী বছরের অর্থাৎ ২০২৫ সালের ১ জুলাই বা তৎপরবর্তীতে যোগদানকারী সরকারি কর্মচারীরাও সর্বজনীন পেনশনের আওতায় আসবেন।
জানা গেছে, বর্তমানে সরকারি চাকুরেদের বিদ্যমান পেনশন নীতিমালা অনুযায়ী ২৫ বছর চাকরি হওয়ার পর যে কেউ চাকরি থেকে অবসর নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে তার বেসিকের বা মূল বেতনে ৯০ ভাগ পেনশন হিসেবে গণনা করা হয়। যদি কারো শেষ বেতন ৬০,০০০/- হয় তাহলে ওই বেতনের ৯০% অর্থ, অর্থাৎ ৫৪,০০০/- টাকা পেনশনের জন্য গণনা করা হয়। যার ৫০% অর্থাৎ ২৭০০০/- টাকার ওপর প্রতি টাকায় ২৩০/- টাকা হারে এককালীন ৬২ লাখ ১০,০০০ হাজার টাকা দেয়া হয় এবং বাকি ২৭০০০/- টাকার সাথে চিকিৎসা ভাতা বাবদ ১৫০০/- যোগ করে ২৮,৫০০/- প্রতি মাসে মাসিক পেনশন হিসেবে প্রদান করা হয়।
এ ছাড়াও প্রতি বছর মূল পেনশনের সমপরিমাণ ২টা উৎসব ভাতা, ২০% বৈশাখী ভাতা, পে-স্কেল হলে নতুন করে পেনশন নির্ধারণের সবিধাও প্রাপ্য হন। আরো আছে, এখন আবার ৫% বিশেষ ভাতাও পায় মাসিক পেনশনের সাথে অর্থাৎ ২৮৫০০/- এর সাথে বিশেষ ভাতা বাবদ আরোপিত ১৩৫০/- তার মানে সব মিলে ২৯৮৫০/- টাকা পাচ্ছেন।
বিদ্যমান নীতি অনুযায়ী পেনশন পাবার জন্য কোনো সরকারি চাকুরেদের বেতন থেকে কোনোপ্রকার অর্থ কর্তন করা হয় না। সব অর্থ সরকারি কোষাগার থেকে দেয়া হয়ে থাকে।
অন্য দিকে সর্বজনীন পেনশন নীতিমালা অনুযায়ী সরকারি চাকুরেদের পেনশন পেতে হলে মাসিক দুইহাজার থেকে ১০ হাজার টাকা জমা করার প্রয়োজন হবে। বাকি সমপরিমাণ অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান প্রদান করবে। এই কর্মসূচির আওতায় থাকা ব্যক্তিবর্গ অবসরের সময়ে এককালীন কোনো অর্থ পাবেন না। তারা মাসিক (কেউ যদি ৪২ বছর অর্থ জমা দেন) চাদা বা জমার বিপরীতে অবসরকালীন সময়ে ৬৮ হাজার ৯৩১ টাকা থেকে ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৬৫৫ টাকা পাবেন।
এ দিকে গত ১ জুলাই সোমবার থেকে থেকে সরকারের সর্বজনীন পেনশন স্কিমের ‘প্রত্যয়’ স্কিম যাত্রা শুরু করেছে। স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে চলতি বছরের ১ জুলাই বা তৎপরবর্তীতে যোগদানকারী সব কর্মচারী বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যয় স্কিমের আওতাভুক্ত হবেন। নতুন এ স্কিমে লাম্পগ্রান্ট, পিআরএল ও প্রভিডেন্ট ফান্ড বহাল রাখা হয়েছে। অন্য দিকে চলতি বছরের গত ৩০ জুন পর্যন্ত যেসব শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিরত আছেন তারা পূর্বের ন্যায় সব পেনশন সুবিধা প্রাপ্য হবেন। আর সরকারি চাকুরেরা যারা আগামী বছরের ১ জুলাই তারিখে চাকরিতে যোগ দেবেন তারা এই প্রত্যয় স্কিমের আওতায়ভুক্ত হবেন।
সর্বজনীন পেনশন স্কিমের ‘প্রত্যয়’ স্কিমের যাত্রার শুরুতে এ স্কিমের বিভিন্ন বিষয় অধিকতর স্পষ্ট করতে গতকাল মঙ্গলবার একটি স্পষ্টীকরণ ব্যাখ্যা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এ দিকে সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলন অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
গতকাল পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে অর্থমন্ত্রীর অফিস কক্ষে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) দক্ষিণ, মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট ইয়াংমিং ইয়ংয়ের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে মন্ত্রী এ কথা বলেন। প্রত্যয় স্কিম নিয়ে শিক্ষকদের আন্দোলনের কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছে না বলে জানান তিনি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, সরকারি, স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ছাড়া দেশের বিপুলসংখ্যক জনসাধারণ একটি সুগঠিত পেনশনের আওতা-বহির্ভূত থাকায় সব শ্রেণিপেশার মানুষের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিমের মাধ্যমে একটি সুগঠিত পেনশন কাঠামো গড়ে তোলার জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিমের প্রবর্তন করেছে সরকার। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩ এর ১৪ (২) ধারা অনুযায়ী, দেশের সব মানুষের জন্য পেনশন স্কিম প্রবর্তনের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে একটি টেকসই পেনশন ব্যবস্থায় আনয়নের লক্ষ্যে অন্যদের পাশাপাশি স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত এবং এর অঙ্গসংগঠনের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ‘প্রত্যয়’ স্কিম প্রবর্তন করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে ৪০৩টি স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৯০টির মতো প্রতিষ্ঠানে পেনশন ব্যবস্থা চালু আছে। অবশিষ্ট প্রতিষ্ঠানে কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ডের (সিপিএফ) আওতাধীন। সিপিএফ সুবিধার আওতাধীন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা এককালীন আনুতোষিক প্রাপ্ত হয়ে থাকেন, কোনো পেনশন পান না।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যায় বলা হয়, বর্তমানে সরকারি পেনশনে আনফান্ডেড ডিফাইন্ড বেনিফিট সিস্টেমের পেনশন ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। ফলে পেনশনের যাবতীয় ব্যয় প্রয়োজন অনুযায়ী প্রদত্ত বাজেট বরাদ্দ থেকে মেটানো হয়। ১ জুলাই ২০২৪ সাল থেকে ফান্ডের ডিফাইন্ড কন্ট্রিবিউটরি সিস্টেমের পেনশন ব্যবস্থা চালু হবে বিধায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বেতন থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণে মাসিক জমার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রত্যয় স্কিমে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারীর প্রাপ্ত মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা, যা কম হবে তা কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বেতন থেকে কাটা হবে এবং সমপরিমাণ অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা প্রদান করবে। অতঃপর উভয় অর্থ ওই কর্মকর্তা-কর্মচারীর কর্পাস অ্যাকাউন্টে জমা হবে।
আনফান্ডেড ডিফাইন্ড বেনিফিট সিস্টেমের পেনশন ব্যবস্থায় সরকারের আর্থিক সংশ্লেষ ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়, যা দীর্ঘমেয়াদে কোনোক্রমেই টেকসই ব্যবস্থা নয়। অন্য দিকে ফান্ডেড কন্ট্রিবিউটরি পেনশন সিস্টেমে প্রাপ্ত কন্ট্রিবিউশন এবং বিনিয়োগ মুনাফার ভিত্তিতে একটি ফান্ড গঠিত হবে বিধায় এটি দীর্ঘমেয়াদে একটি টেকসই পেনশন ব্যবস্থা। উল্লেখ্য, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ২০০৪ সাল থেকে ফান্ডেড কন্ট্রিবিউটরি পেনশন ব্যবস্থা চালু আছে।
নতুন পেনশন ব্যবস্থাপনা প্রবর্তনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সব শ্রেণী-পেশার মানুষকে টেকসই সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর মধ্যে আনা সম্ভব হবে। এতে ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন ও ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আবেদনের পর নিজ বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে একই পদে বা উচ্চতর কোনো পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হলে তিনি সার্ভিস প্রটেকশন ও পে-প্রটেকশনপ্রাপ্ত হন বিধায় এটিকে নতুন নিয়োগ হিসেবে গণ্য করা হয় না। সে ক্ষেত্রে তার বিদ্যমান পেনশন সুবিধার আওতায় থাকার সুযোগ থাকবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মচারী যারা ২০২৪ সালের ১ জুলাই ও তৎপরবর্তী সময়ে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন কেবল তারা প্রত্যয় স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হবেন।
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইনে ৬০ বছর বয়স থেকে পেনশন প্রাপ্তির উল্লেখ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ৬৫ বছর থেকে অবসরে যাবেন বিধায় ৬৫ বছর থেকে আজীবন পেনশনপ্রাপ্ত হবেন। এ ক্ষেত্রে সরকার আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করবে।
কন্ট্রিবিউটরি পেনশন সিস্টেমে অংশগ্রহণকারীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এককালীন নয়, বরং মাসিক পেনশনের যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ নির্ধারণ করাই অগ্রগণ্য বিধায় এ ক্ষেত্রে আনুতোষিকের ব্যবস্থা রাখা হয়নি, বরং বিদ্যমান মাসিক পেনশনের কয়েকগুণ বেশি মাসিক পেনশন প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রত্যয় স্কিমে মাসিক পাঁচ হাজার টাকা বেতন থেকে কাটা হলে একই পরিমাণ অর্থ প্রতিষ্ঠান জমা প্রদান করলে ৩০ বছর পর একজন পেনশনার প্রতি মাসে ১,২৪,৬৬০ টাকা হারে আজীবন পেনশন পাবেন। তার নিজ আয়ের মোট জমাকৃত অর্থের পরিমাণ ১৮ লাখ টাকা এবং তিনি যদি ১৫ বছর ধরে পেনশন পান সে ক্ষেত্রে তার মোট প্রাপ্তি হবে দুই কোটি ২৪ লাখ ৩৮ হাজার ৮০০ টাকা, যা তার জমার প্রায় ১২.৫ গুণ। পেনশনার পেনশনে যাওয়ার পর ৩০ বছর জীবিত থাকলে তার জমার প্রায় ২৫ গুণ অর্থ পেনশন পাবেন।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় পেনশনার আজীবন পেনশন পান। তার অবর্তমানে পেনশনারের স্পাউজ (স্বামী/স্ত্রী) এবং প্রতিবন্ধী সন্তান আজীবন পেনশন পান। নতুন পেনশন ব্যবস্থায়ও পেনশনার আজীবন পেনশন পাবেন। পেনশনারের অবর্তমানে তার স্পাউজ (স্বামী/স্ত্রী) বা নমিনি পেনশনারের পেনশন শুরুর তারিখ থেকে ১৫ বছর হিসাবে যে সময় অবশিষ্ট থাকবে সে পর্যন্ত পেনশন প্রাপ্য হবেন। উদাহরণস্বরূপ, একজন পেনশনার অবসরে যাওয়ার পর পেনশন ভোগরত অবস্থায় পাঁচ বছর পেনশন পেয়ে তার পর মৃত্যুবরণ করলেন। এ ক্ষেত্রে তার স্পাউজ বা নমিনি আরো ১০ বছর পেনশন পাবেন।