স্বদেশ ডেস্ক:
কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সদস্যরা সামরিক প্রশিক্ষণ নেয় প্রতিবেশী দুই দেশে। কেএনএফের সশস্ত্র সদস্যদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণের মেয়াদ তিন মাস। এর মধ্যে এক মাস ভারতের মিজোরামে তাত্ত্বিক ও শারীরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বাকি দুই মাস মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের সঙ্গে মিয়ানমার আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এ ধরনের প্রশিক্ষণে কেএনএফের ২০ জনেরও বেশি সদস্য মিয়ানমার আর্মির সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হয়েছে। সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত কেএনএফের প্রতিটি সদস্য সামরিক কৌশলে উচ্চতর দক্ষতাসম্পন্ন ও যুদ্ধংদেহী। ভয়ানক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত এমন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকি-চিন সদস্য সংখ্যা ৩ থেকে ৪ হাজার। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন, গ্রেপ্তারকৃতদের বক্তব্য ও স্থানীয়দের সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার কেওক্রাডং পর্বতের কাছাকাছিসহ পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকায় কুকি-চিনের আস্তানা থাকলেও অধিকাংশ সদস্য বর্তমানে ছদ্মবেশে মিশে আছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে। চাঁদাবাজি-লুটপাটসহ বিভিন্নœ অপকর্মের কারণে স্বল্প সময়ের জন্য লোকালয়ে এলেও কাজ শেষে দ্রুতই তারা ফের আস্তানা ও প্রতিবেশী দেশে ফিরে যায়। রুমা ও থানচির দুই ব্যাংকের তিনটি শাখায় ডাকাতি ও লুটপাটের পর কুকি-চিন সদস্যরা আর লোকালয়ে আসেনি। তাদের ধরতে যৌথ বাহিনীর সমন্বিত অভিযানে টিকতে না পেরে এই সন্ত্রাসী সংগঠনের কিছু সদস্য সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী দেশে চলে গেছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
গত বছর থেকে এ পর্যন্ত কুকি-চিনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিরোধে অভিযান চালিয়ে কেএনএফ ও জঙ্গি সংগঠনের সদস্যসহ ৯৯ জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। শান্তি আলোচনার কারণে কেএনএফের বিরুদ্ধে তারা অভিযান স্থগিত রাখলেও সাম্প্রতিক অপকর্মের পর সেটি আবার জোরদার করা হয়েছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, কেএনএফ সদস্যরা চাঁদাবাজি ও লুটপাটসহ চোরাগোপ্তা হামলা করেছে। তারা আইইডি বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। আমাদের সদস্যও আহত হয়েছেন। সর্বশেষ তারা বান্দরবনে দুটি ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা ও লুটপাট চালায়। তাদের হাতে অপহৃত ব্যাংক ম্যানেজারকে আমরা উদ্ধার করেছি। এখন আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে- লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার এবং সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। এ ক্ষেত্রে আমরা আগে যে অভিযান চালিয়েছি, সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে অভিযান পরিচালনা করছি।
গোয়েন্দা তথ্য বলছে, কেএনএফের জন্ম ২০০৮ সালে। ২০১৬ সালে কেএনএফের সশস্ত্র গ্রুপ তৈরি হয়। শুরুতে এর নাম ছিল কুকি-চিন ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার্স (কেএনভি)। বর্তমানে এই সশস্ত্র সংগঠনের নাম কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)। প্রথম দিকে তারা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পরিচালনা করে এবং ভারতের মনিপুর ও মিয়ানমারের কাচিন রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। প্রথম ব্যাচে শতাধিক সদস্যকে মণিপুরে প্রশিক্ষণে
পাঠানো হয়। এর পর শতাধিক সদস্যকে মিয়ানমারের কারেন ও কাচিন রাজ্যে গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। ২০১৯ সালে ইনফ্যান্ট্রি ও কমান্ডো প্রশিক্ষণের পর তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে ফিরে আসে। শুরুতে তারা নিশ্চুপ ছিল। তার পর চাঁদাবাজি, লুটপাট ও সর্বশেষ ব্যাংক ডাকাতিতে জড়ায়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, রুমা ও থানচিতে সর্বশেষ ডাকাতি ও লুটপাটকা-ে অংশ নিয়েছিল কেএনএফের শতাধিক প্রশিক্ষিত সদস্য। এসব সদস্য মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশে কাচিন বিদ্রোহীদের কাছে কমান্ডো
ট্রেনিংপ্রাপ্ত। প্রায় এক মাস আগে তারা বান্দরবানের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে ব্যাংক ডাকাতির রেকি করে। তার পর পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যাংক ডাকাতি, থানা ও বাজারে আক্রমণ ও লুটপাট চালায়। দ্রুত হামলা চালাতে সক্ষম কেএনএফের এসব সদস্য অধিকাংশই বয়সে তরুণ, বয়স ১৮ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। অভিযানে তারা সামরিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তা, পার্বত্য অঞ্চলের শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, পাশর্^বর্তী দুই দেশের সমমনা বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে কেএনএফের চুক্তি রয়েছে। চুক্তির আওতায় তারা সেখানে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবং গা ঢাকা দেওয়ার জন্য আশ্রয় নেয়। মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর হয়ে যুদ্ধ করে তারা অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহ করে। পাহাড়ের লুটপাট ও চাঁদাবাজির টাকায় তারা পাশর্^বর্তী দেশ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র কেনে। মিয়ানমারে কেএনএফের কোনো সদস্য গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া না গেলেও ভারতে দুই দফায় ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে এ সংগঠনের প্রধান নাথান বমসহ বিপুলসংখ্যক সামরিক প্রশিক্ষিত কেএনএফ সদস্য এখনো ভারতের মিজোরামে অবস্থান করছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, ২০২২ সালের ২৪ মার্চ রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার ট্রাই জংশনের কাছাকাছি ভারতীয় অংশের মিজোরাম রাজ্যের লংতলাই জেলার পারভা থেকে কেএনএফের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করে বিএসএফ। গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির সভাপতি এবং চিফ অব স্টাফের সিলমোহরসহ সরঞ্জামাদি উদ্ধারের কথা জানায় বিএসএফের ১৯৯নং পারভা ব্যাটালিয়ন। আটককৃতদের কাছ থেকে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের তথ্যও পাওয়া যায়। এ ছাড়া ২০২২ সালের ১২ এপ্রিল পারভা ১১৯ ব্যাটালিয়ন বিএসএফ সশস্ত্র সরঞ্জামসহ কেএনএফের ৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কুকি-চিনের বক্তব্যের সূত্রে এবং স্থানীয়দের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম উপজেলা নিয়ে কেএনএফের কল্পিত কুকি-চিন রাজ্য গঠিত। বম, পাঙ্খুয়া, লুসাই, খুমি, ম্রো, খিয়াং নামের ছয় জাতিগোষ্ঠী মিলে কেএনএফ গঠিত হয়। তারা নিজেদের পার্বত্য চট্টগ্রামের আদি বাসিন্দা বলে মনে করে। একই সঙ্গে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা প্রভৃতি জনগোষ্ঠীকে বার্মিজ ও ভারতীয় জাতিভুক্ত এবং বহিরাগত মনে করে। এ কারণে জেএসএস ও ইউপিডিএফের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রতি তাদের বৈরী মনোভাব রয়েছে।
গ্রেপ্তার কুকি-চিন সদস্যরা জানিয়েছেন, ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের বিভক্তি ও একাত্তর-পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সশস্ত্র আন্দোলনের ফলে পার্বত্য জেলা ছেড়ে ভারতের মিজোরাম, লংৎলাই, লুংলেই ও মামিট জেলায় চলে যায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অনেকেই। দেশে ছেড়ে ভিন্ন দেশে যাওয়া অনেকের আর্থিক সহায়তা ও সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে কুকি-চিন রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। গত বছরের ২১ জুন রাঙামাটির বিলাইছড়ির বড়থলি ইউনিয়নের সাইজামপাড়ায় কেএনএফ সন্ত্রাসীরা তিনজনকে গুলি করে হত্যা করে। তাদের গুলিতে দুটি শিশু আহত হয়। সন্ত্রাসীদের হুমকিতে বড়থলি ইউনিয়নের তিনটি পাড়ার ৯০-এর অধিক পরিবার গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে বান্দরবানের বিভিন্ন পাড়ায় আশ্রয় নেয়।
জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করা কেএনএফের সভাপতি নাথান বম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ঢাকা মহানগর শাখা ও কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। খাগড়াছড়ির চেঙ্গী স্কোয়ারের পাশে এমএন লারমার ভাস্কর্যটির অন্যতম কারিগর তিনি। তিনি কুকি-চিন জাতীয় ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (কেএনডিও) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এক সময় তিনি বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে মিজোরামের লংটলাই জেলার মুনাউন গ্রামে থাকতেন। তবে তার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
ব্যাংক ডাকাতি ও দুটি মেশিনগানসহ ১৪টি অস্ত্র লুটের পর কেএনএফের বিরুদ্ধে কঠোর যৌথ অভিযান শুরু হয়েছে। পাহাড়ি এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। অভিযানে বান্দরবান জেলা শহরতলি শ্যারণপাড়া থেকে কেএনএফের বান্দরবান জেলার প্রধান সমন্বয়কারী ও কেএনএফ প্রধান নাথান বমের ঘনিষ্ঠ চেওসিম বমকে (৫৫) গ্রেপ্তার করে র্যাব। স্থানীয় বম জনগোষ্ঠী বলেছেন, চেওসিম বমের শ্যারণপাড়ার বাড়িতে কেএনএফপ্রধান নাথান বমের সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠী জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কিয়ার প্রধান সমন্বয়কারী শামীম মাহফুজের বৈঠক হয়েছিল। তার বাড়িতেই কেএনএফের সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠী শারক্কিয়ার মাসিক তিন লাখ টাকার চুক্তিতে কেএনএফ সদস্যরা জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল।