শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:০৭ অপরাহ্ন

বিআরটি প্রকল্পের গণশুনানিতে তোপের মুখে কর্মকর্তারা

বিআরটি প্রকল্পের গণশুনানিতে তোপের মুখে কর্মকর্তারা

স্বদেশ ডেস্ক:   

বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) নিয়ে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে গণশুনানি ও অংশীজন সভায় অংশ নিয়ে প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতা, অব্যবস্থাপনা, নকশার ত্রুটিসহ বিভিন্ন কারণে তোপের মুখে পড়েন কর্মকর্তারা। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের (উন্নয়ন) অতিরিক্ত সচিব ও প্রকল্প সমন্বয়ক একেএম শামীম আক্তার।

বুধবার (২৭ মার্চ) বিকালে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি এই গণশুনানি ও অংশীজন সভার আয়োজন করে। গাজীপুর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়ে। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন গাজীপুর জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম, গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। সভায় সভাপতিত্ব করেন বিআরটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. মনিরুজ্জামান (অতিরিক্ত সচিব, পিআরএল)। এ ছাড়া বিভিন্ন অংশীজন, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা অংশ নেন।

গণশুনানিতে জানানো হয়, গাজীপুর শহরের শিববাড়ি থেকে ঢাকা বিমান বন্দর পর্যন্ত ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ বাসে যেতে সময় লাগবে ৪৪ মিনিট। কোম্পানির নিজস্ব ১৩৭টি নতুন এসি বাস চলাচল করবে। প্রকল্পের শিববাড়ি ও বিমানবন্দরে দুটি বাস টার্মিনাল, ৮টি ফ্লাইওভার, ২৫টি বাস স্টপেজ, ১৫টি ফুটওভার ব্রিজ, ৩২ কিলোমিটার ফুটপাথ, উভয় পাশের ড্রেন ৫৫ কিলোমিটার এবং মাটি থেকে নিয়ম অনুযায়ী উচ্চতা থাকবে ৮ দশমিক ৫ মিটার। বাস চলাচলের সময় কোথাও যানজট থাকবে না এবং ৪৪ মিনিটে গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে।

আলোচনার শুরুতে বক্তব্য দেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও সিটি করপোরেশনের মেয়রের প্রধান উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম। তিনি প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট ১৭টি ত্রুটি উল্লেখ করে বক্তব্য দেন। এ সময় তিনি বলেন, যারা এমন ত্রুটিপূর্ণ নকশা প্রণয়ন করে সরকারের হাজার কোটি টাকা নষ্ট করেছে, লাখো মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, শুরুতে এই প্রকল্পের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন, আজকের এই সভার কেউ তখন ছিলেন না। ফলে এখানে আমরা যা আলোচনা করব তা স্থানীয় জনগণের স্বার্থে আলোচনা করব।

তিনি অভিযোগ করেন, প্রকল্পের শুরুতে কথা ছিল মহাসড়কের দুই পাশের হকারদের জন্য দশটি হকার্স মার্কেট নির্মাণ এবং ড্রেনের পানি অপসারণে মহাসড়কের দুই পাশে পাঁচটি খাল খনন করা হবে। কিন্তু এর কিছুই করা হয়নি। তিনি বলেন, এই প্রকল্পের ভোগড়া এলাকার ফ্লাইওভারের উচ্চতা কম। ফলে পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলে অসুবিধা হবে। ড্রেন সরু হওয়ায় সড়কের পানি অপসারিত হবে না। বিআরটি স্টেশনে আসা-যাওয়ার জন্য ৭২ ফুট উঁচু সিঁড়ি নির্মাণ করা হয়েছে, ফলে বয়স্ক মানুষ, নারী ও শিশুরা এই সিঁড়ি অতিক্রম করতে দুর্ভোগে পড়বেন। সওজের আগে ১০০ ফুট চওড়া মহাসড়ক ছিল। অথচ অনেক স্থানে বিআরটি সড়কের বাইরে দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলার যানবাহন চলাচলের মহাসড়ক অত্যন্ত সরু হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান আলী অভিযোগ করেন, প্রকল্পের জন্য তাদের প্রতিষ্ঠানের সীমানা প্রাচীর ভাঙতে হয়েছে। কথা ছিল উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে তা পুনরায় নির্মাণ করা হবে। কিন্তু তা না হওয়ায় আন্তর্জাতিক মানের এ প্রতিষ্ঠানের গবেষণা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

গাজীপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান টিটু বলেন, প্রকল্পটির চান্দনা চৌরাস্তা থেকে শিববাড়ি মোড় পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার সড়কের কোথাও এক ইঞ্চিও ফুটপাথ রাখা হয়নি। এমনকি এই দীর্ঘ পথের কোথাও কোনো ইউটার্নও নেই।

স্থানীয় সাংবাদিক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, দীর্ঘ মহাসড়কে বিআরটি লেনের বাইরে অনেক জায়গায় বিআরটি স্টেশনে যাত্রী আসা-যাওয়ার জন্য ফুটপাথ বন্ধ করে সিঁড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। যাত্রী পারাপারের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। গাজীপুরের কয়েক লাখ পোশাক শ্রমিকের রাস্তা পারাপারে কোনো ফুটওভার ব্রিজ অথবা এক পাশের যানবাহন অন্য পাশে যাওয়ার জন্য ইউটার্নও রাখা হয়নি। অপ্রশস্ত ড্রেনের কার্যকারিতা নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়েছে।

এসব বিষয়ে বিআরটি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ইলিয়াস শাহ উত্তর দেওয়া শুরু করলে তার বক্তব্য সন্তোষজনক না হওয়ায় অংশগ্রহণকারীরা কথা বলতে থাকেন। পরে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব তাকে থামিয়ে দেন। তিনি বলেন, আপনি স্বীকার করে নেন যে, এখানে বিভিন্ন ত্রুটি রয়েছে, যা ভবিষ্যতে আমরা সমাধান করব।

এক পর্যায়ে জেলা প্রশাসক প্রস্তাব করেন, যেহেতু অনেক সমস্যা এখানে আলোচনা হয়েছে। এসব সমস্যা চিহ্নিত করে একটি প্রস্তাবনা উপস্থাপন করার জন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করা যেতে পারে। এই কমিটি সবার সঙ্গে আলোচনা করে একটি প্রস্তাব দেবে এবং সেই অনুযায়ী পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

প্রকল্পের নবনিযুক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. মনিরুজ্জামান বলেন, আজকে আমরা আপনাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মতামত শুনলাম। প্রকল্পের অনেক সীমাবদ্ধতা ধরা পড়েছে। আমরা এগুলো সমাধান করব। ভবিষ্যতে ফুটপাথ এবং রাস্তা সম্প্রসারণে অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণ করে চিহ্নিত সমস্যাগুলোর সমাধান করা হবে।

প্রকল্প পরিচালক ইলিয়াস শাহ বলেন, যানবাহন চলাচলের সুবিধার জন্য প্রকল্প এলাকায় সাতটি ইউটার্নের ব্যবস্থা রাখা হবে।

প্রকল্প সমন্বয়ক একেএম শামীম আক্তার বলেন, বিআরটি প্রকল্প এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আজকে যে সমস্যাগুলো আলোচনা হয়েছে, এগুলো আমরা চিহ্নিত করে ভবিষ্যতে অন্য প্রকল্প গ্রহণ করে এসব সমস্যার সমাধান করব। এ সময় তিনি প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার পর ধৈর্য নিয়ে এ কাজে সহায়তার জন্য গাজীপুরবাসীকে ধন্যবাদ জানান।

রাজধানীর সঙ্গে দেশের কয়েকটি অঞ্চলের যোগাযোগ সহজ করতে ২০১২ সালে হাতে নেওয়া হয় রাজধানীর বিমান বন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার বিআরটি প্রকল্প। প্রকল্পের শুরুতে ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৩৯ কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন নির্ধারণ করা হয়। সময় বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ব্যয়। সবশেষ ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। কিন্তু প্রকল্প চালু হওয়ার পর এক যুগ পেরিয়ে গেল। তার পরেও নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি প্রকল্পের কাজ। কর্তৃপক্ষ আশা করেছে, চলতি বছরের ডিসেম্বর নাগাদ চালু হতে পারে সম্পূর্ণ প্রকল্প।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877