রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৮:৩৩ পূর্বাহ্ন

৭ বছরে মেট্রোরেলের ব্যয় বৃদ্ধি দ্বিগুণ

৭ বছরে মেট্রোরেলের ব্যয় বৃদ্ধি দ্বিগুণ

স্বদেশ ডেস্ক:

জনদুর্ভোগ ও যানজট নিরসনের সরকার রাজধানীতে মেট্রোরেল কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে বিভিন্ন ধাপে। চলমান মেট্রোরেল লাইন-৬ প্রকল্প থেকে প্রতি কিলোমিটারে দ্বিগুণ খরচ হবে লাইন-৫ প্রকল্প বাস্তবায়নে। আর লাইন-১ বাস্তবায়নে কিলোমিটারে খরচ হচ্ছে ১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। অবশ্য মেয়াদ বৃদ্ধি পেলে প্রকল্প সমাপ্তিতে এই বাস্তবায়ন খরচ আরো বৃদ্ধি পাওয়ারও আশঙ্কা করেছে বিশেষজ্ঞ ও পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সংশ্লিষ্টরা। একই সাথে প্রকল্পের জন্য নেয়া জাইকার ঋণের সুদ পরিশোধের পরিমাণও বাড়ছে। মেট্রোরেলের নতুন এই দুইটি লাইন বাস্তবায়নে ব্যয় হবে মোট ৯৩ হাজার ৭৯৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। আর পরামর্শক খাতে ব্যয় হবে ৩ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা। আগামী মঙ্গলবার অনুষ্ঠিতব্য একনেক সভার জন্য পাঠানো প্রস্তাবনা থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রকল্পের যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলছে, রাজধানী ঢাকা বিশে^র অন্যতম ঘন বসতিপূর্ণ শহর। যেখানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ৪৪ হাজার ১০০ জন মানুষ বসবাস করে। ঢাকা মহানগরী ও পাশের এলাকায় প্রতিদিন প্রায় ৩ কোটি ট্রিপ তৈরি হয়। আর আগামী ২০২৫ সালে এই ট্রিপের পরিমাণ ৪ কোটি ২০ লাখ এবং ২০৩৫ সালে ৫ কোটি ২০ লাখে উন্নীত হবে। এই বিশাল পরিবহন চাহিদা মেটানোর জন্য সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনাতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি প্রকল্প গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রকল্প প্রস্তাবনার তথ্য অনুসারে, ঢাকা শহরে ২০০১ সালে যেখানে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ছিল মাত্র ২০ হাজার ৬০০। সেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এখন নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা এক লাখ ৯৫ হাজার ৪০০-এ দাঁড়িয়েছে। সে তুলনায় রাস্তা তেমন বাড়েনি। ফলে যানজট দুর্বিষহ আকার ধারণ করেছে। ওই পরিকল্পনার আওতায় পাঁচটি মাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি), দুইটি বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি), তিনটি রিংরোড, আটটি রেডিয়ার সড়ক, ছয়টি এক্সপ্রেসওয়ে, ২১টি ট্রান্সপোর্টেশন হাব নির্মাণ করা হবে। তারই অংশ হিসেবে রাজধানী ঢাকার যানজট কমাতে এবং যাতায়াত ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করতে মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।

ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) প্রস্তাবনার তথ্যানুযায়ী, মেট্রো রেলের লাইন-১ এর মাধ্যমে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর রেলস্টেশন এবং নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল ডিপো পর্যন্ত ৩১.২৪১ কিলোমিটার এবং লাইন-৫ এর মাধ্যমে হেমায়েতপুর-আমিনবাজার-গাবতলী-মিরপুর-১ ও ১০, কচুক্ষেত-বনানী-গুলশান-২ হয়ে ভাটারা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার লাইন নির্মাণ করা হবে। এসব রুটের কোথাও পাতাল, আবার কোথাও এলিভেটেড লাইন হবে। এজন্য সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ মোট ৯৩ হাজার ৭৯৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ব্যয়ে দু’টি পৃথক প্রকল্প প্রস্তাবনা পরিকল্পনা কমিশনের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে অনুমোদনের জন্য পেশ করতে যাচ্ছে। এই দু’টি মেট্রোরেল রুট বাস্তবায়নে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) মোট ৬৮ হাজার ৫৬৭ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ঋণ সহায়তা দিচ্ছে। এই ঋণে শুধু সুদই দিতে হবে হবে ২ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা।

মেট্রোরেল লাইন-৬ : প্রকল্পের ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, বর্তমানে মেট্রোরেল লাইন-৬ এর কাজ চলমান আছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লাইন-৬ এর অগ্রগতি ৩০ দশমিক ০৫ শতাংশ বলে সর্বশেষ তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পটি (লাইন-৬) ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নের জন্য ২০১২ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে অনুমোদন পায়। উত্তরা থেকে পল্লবী, সোনারগাঁও হোটেল হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক করিডোর পর্যন্ত ২০.১ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল স্থাপনের কাজ চলছে। প্রায় ৭৬ শতাংশ অর্থ তথা ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকার জোগান দেবে জাপান সরকার। বাকি ব্যয় সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে মেটানো হবে। তিনটি স্তরে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থায়নে এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২০২৪ সালের জুন। এই প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হচ্ছে এক হাজার ৯৩ কোটি ৭৮ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। আর লাইন-৫ এ প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে ২ হাজার ৬১ কোটি ৯২ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। এখানে রেলওয়ে ইনস্টলেশনে খরচ ধরা হয়েছে প্রতি কিলোমিটারে ২৩৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। ২০ কিলোমিটারে মোট ব্যয় ৪ হাজার ৭৯৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এতে লাইন-১ এ প্রতি কিলোমিটারে নির্মাণ ব্যয় হবে এক হাজার ৬৮২ কোটি ৪৮ লাখ ২৩ হাজার টাকা। এখানে রেলওয়ে ইনস্টলেশনে খরচ ধরা হয়েছে প্রতি কিলোমিটারে ১৬১ কোটি ৬২ লাখ টাকা। ৩১.২৪১ কিলোমিটারে মোট ব্যয় ৫ হাজার ৩৬ কোটি টাকা।
লাইন-৫ : ২০ কিলোমিটার : মেট্রোরেল লাইন-৫ বাস্তবায়নের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১ হাজার ২৩৮ কোটি ৫৪ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। এই রুট হলোÑ হেমায়েতপুর, আমিনবাজার, গাবতলী, মিরপুর-১, মিরপুর-১০, মিরপুর-১৪, কচুক্ষেত, বনানী, গুলশান-২, নতুনবাজার, ভাটারা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার। এটার নাম দেয়া হয়েছে নর্দান রুট। আগামী মঙ্গলবার প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে ২০২৮ সালের ডিসেম্বরে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই ব্যয়ের মধ্যে ২৯ হাজার ১১ কোটি ৪৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা ঋণ দিচ্ছে জাইকা। বাকি ১২ হাজার ১২১ কোটি ৪৯ লাখ ৬৭ হাজার টাকা বাংলাদেশ সরকারকে দিতে হবে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে জাইকার সাথে এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়। যাতে তারা ৩৭ হাজার ৪২৯ কোটি ৯০ লাখ জাপানিজ ইয়েন ঋণ হিসেবে দেবে। আর এই রুটের জন্য প্রকৌশল ঋণ চুক্তি হয় গত ২০১৮ সালের ১৪ জুন ৭৩৫ কোটি ৮০ লাখ ইয়েনের।

এই রুটে সাড়ে ১৩ কিলোমিটার হবে পাতাল এবং সাড়ে ৬ কিলোমিটার হবে এলিভেটেড। এখানে ১৪টি স্টেশনের মধ্যে ৯টি মাটির নিচে আর পাঁচটি হবে এলিভেটেড। এখানে কোচ কেনা হবে ১৯৮টি। যেখানে প্রতি সেটে থাকবে ছয়টি করে। ৮ হাজার ৮৪৩ জনমাস পরামর্শক খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৪৪ কোটি ৪৫ লাখ ২২ হাজার টাকা। এখানে প্যানেল সম্মানী আলাদা করে রাখা হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা। সেমিনার ও কর্মশালার জন্য দেড় কোটি টাকা। স্থানীয় ও বিদেশী প্রশিক্ষণের জন্য সাড়ে ৪ কোটি টাকা। ১০০ জনমাস কারিগরি পরামর্শকদের জন্য ব্যয় হবে ৯৬ কোটি ২২ লাখ টাকা। আর সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে ৮৫৭ কোটি ২ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। ভ্যাট ও সিডি খাতে ব্যয় হবে ২ হাজার ৩১ কোটি ৭০ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। এই অংশে ৪২ দশমিক ৩১ হেক্টর জমি অধিগ্রহণে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২৪০ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ফলে প্রতি হেক্টর জমির দাম হচ্ছে ৭৬ কোটি ৫৯ লাখ ১৮ হাজার টাকা।

লাইন-১: ৩১.২৪১ কিলোমিটার : মেট্রোরেল লাইন-১ বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এই রুট হলো : বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর স্টেশন এবং নতুনবাজার থেকে পূর্বাচল ডিপো পর্যন্ত মোট ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটার। এখানে পাতাল রেল হবে ১৯ দশমিক ৮৭২ কিলোমিটার এবং এলিভেটেড ১১ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার। এখানে ২০০টি কোচ কেনা হবে। যেখানে প্রতিটি সেটে আটটি করে কোচ থাকবে। এই অংশে ১৯টি স্টেশনের মধ্যে পাতালে ১২টি এবং এলিভেটেডে সাতটি থাকছে। এই অংশে জাইকার ঋণ ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি ৩২ লাখ টাকা। আর বাংলাদেশ সরকারকে দিতে হবে ১৩ হাজার ১১১ কোটি ১১ লাখ টাকা। এই অংশ বাস্তবায়নেও জাইকার সাথে চুক্তি হয়েছে গত ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। তারা ঋণ দেবে ৫ লাখ ১২ হাজার ৯০৭ কোটি জাপানিজ ইয়েন। জাইকা বিভিন্ন পর্যায়ে এই ঋণ সহায়তা দেবে। আর কারিগরি চুক্তি অনুযায়ী ৫৫৯ কোটি ৩০ লাখ ইয়েন দেবে তারা। চলতি বছর মে মাসে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে লাইন-১ এর জন্য প্রথম কিস্তি হিসেবে ৫ হাজার ২৫৭ কোটি ইয়েনের ঋণ চুক্তি হয়।

প্রকল্পটি আগামী একনেকে অনুমোদিত হলে আগামী ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে সমাপ্ত হবে বলে প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে। এই অংশে ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। যেখানে প্রতি হেক্টর জমির দাম পড়ছে ৫৯ কোটি ৮৭ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। আর লাইন-১ এর বিপরীতে নেয়া ঋণের জন্য সুদ দিতে হবে ১ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। যা সরকারি খাত থেকেই নির্বাহ করতে হবে। এখানে ২২ হাজার ৬৭১ জনমাস পরামর্শকের জন্য ১ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। সেমিনারের জন্য ব্যয় হবে ৩ কোটি টাকা, প্যানেল বিশেষজ্ঞদের জন্য দেড় কোটি টাকা এবং বিভিন্ন কমিটির সম্মানীতে ৩ কোটি ২০ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
এই প্রকল্পের ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক লাইন-১ মো: সাইদুল হকের সাথে গতকাল যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তার সাথে কথা বলেন। কিন্তু কয়েক দফা ফোনেও পিআরও মো: আবু নাছেরকে পাওয়া যায়নি।

এই প্রকল্পের ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের পরামর্শক ড. জাহিদ হোসেনের সাথে আলাপকালে তিনি নয়া দিগন্তকে জানান, যানজট নিরসনের জন্য অবশ্যই এসব ভালো ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে চলমান লাইন-৬ এর কাজ শেষ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পর পরবর্তী রুটগুলোর কাজ নেয়া উচিত ছিল। এই প্রকল্পগুলো অনেক বড়মাপের কমপ্লেক্স প্রজেক্ট। সব কাজ একসাথে হাতে নিলে পুরো প্রকল্পই ধীর গতি হয়ে পড়বে। এমনকি লেজেগোবরে হয়ে যেতে পারে। তার মতে, নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়ন শেষ করার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ফলে শুরু থেকে শেষ এবং ট্রেন পরিচালনা পর্যন্ত সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে এখন থেকেই কার্যকর উদ্যোগ থাকতে হবে। সেই সাথে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877