ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী: বুনো হাতির সঙ্গে যুদ্ধে আহত হয়েছিল সিংহ। নিস্তেজ শরীরে ক্ষুধার যন্ত্রণায় প্রতিবেশী শিয়ালের সাহায্য চেয়েছিল শিকার ধরে আনার জন্য। শিয়াল তার নানা মন্ত্রে ধোঁকায় ফেলে এক গাধাকে এনেছিল সিংহের কাছে। কিন্তু নাগালে আসার আগেই ক্ষুধার্ত সিংহ হামলা করেছিল গাধার ওপর। গাধা প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হয় জমদূতের সম্মুখ থেকে। শিয়াল সিংহকে বলল, শিকার বাগে আসার আগে কেন হামলা করলেন? তাড়াহুড়া তো শয়তানের কাজ। ধৈর্যের সঙ্গে হিসাব-নিকাশ করে চলাই তো বুদ্ধিমানের নীতি।
মাকরে শয়তান আস্ত তাজীল ও শেতাব
লুতফে রহমান আস্ত সাবরো এহতেসাব
শয়তানের ধোঁকা সে তো তাড়াহুড়া অস্থিরতা
রহমানের দয়া আনে ধৈর্য ও আত্মজিজ্ঞাসা।
শয়তান মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার সুযোগ পায় কোনো কাজে তাড়াহুড়া করলে, অস্থিরতা দেখালে। পক্ষান্তরে রহমান আল্লাহ তায়ালার দয়ার প্রকাশ ঘটে বান্দা ধৈর্যের সঙ্গে হিসাব-নিকাশ করে পদক্ষেপ নিলে। মওলানা রুমি শিয়ালের জবানিতে এ উপদেশ শুনানোর পর সিংহকে সামনে আনছেন গল্পের ধারা বর্ণনায়। সিংহ নিজের দুর্বলতা অকপটে স্বীকার করে শিয়ালের কাছে অনুরোধ জানায়, যেভাবেই হোক গাধাটি আবার কাছে আনার ব্যবস্থা কর। শিয়াল বলে, আল্লাহর সাহায্য আমার সহায় হলে সে যে সিংহের থাবা থেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে সে কথা ভুলে যাবে। আমি তাকে আবার নিয়ে আসব। কিন্তু একেবারে গায়ের কাছে আসার আগে হামলা করবেন না। শিয়াল আরও বলল, গাধাকে ফের ধরে আনা আমার জন্য মোটেও কঠিন নয়। গাধা তো গাধা। দুনিয়ার ভোগ-বিলাসিতায় মত্ত, তাকে ধোঁকা দেওয়া একেবারেই সহজ কাজ। যাদের স্বভাব গাধার মতো, শুধুই খাওয়া-পরার চিন্তায় বেঘোর, তাদের জ্ঞানবুদ্ধি হরণ করে প্রতিজ্ঞা-প্রতিশ্রুতি ভুলিয়ে দিতে আমি ওস্তাদ। আমার চালবাজিতে তাদের আকল গোমরাহ হয়ে যায়। যারা দুনিয়া নিয়ে মত্ত, ধর্মের ধার ধারে না, আখেরাতের চিন্তা নেই, তারা গাধার প্রতিচ্ছবি। এসব গাধার মাথা নিয়ে আমার (শয়তানের) ছেলেপেলেরা ফুটবল খেলে। আমাদের ছলচাতুরীর কাছে তাদের চিন্তা ও চেতনা খেলনার বস্তু। আমাদের চালবাজিতে তারা তওবা ভেঙে ফেলবে, প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে যাবে। কিন্তু আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়াদা ও তওবা ভাঙা বড় মারাত্মক। ইতিহাসে এমন গর্হিত কাজ যার করেছে তাদের ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হতে হয়েছে।
বনি ইসরাইলের ইতিহাসে এ ধরনের দুটি ঘটনার উল্লেখ আছে কোরআনে। ঈসা (আ.) এর অনুসারীরা চরম বেয়াদবির পরিচয় দিয়ে বলেছিল, ঈসা! তোমার প্রতিপালক কি আমাদের জন্য খাবার পাঠাতে পারেন? মুসার নবুয়তকে চ্যালেঞ্জ করা ও আল্লাহর কুদরত পরীক্ষা করার মতলব ছিল তাদের মাথায়। কোরআন মজিদের ভাষায়Ñ ‘স্মরণ কর, হাওয়ারীরা বলেছিল, হে মরিয়ম পুত্র ঈসা! তোমার প্রতিপালক কি আমাদের জন্য আসমান থেকে খাদ্য পরিপূর্ণ খাঞ্চা প্রেরণ করতে সক্ষম? ঈসা বলেছিলেন, ‘যদি তোমাদের ঈমান থাকে, তাহলে আল্লাহকে ভয় কর (এমন ধৃষ্টতা দেখিও না)।’ (সূরা মায়িদা : ১১২)।
এমন বেয়াদবির কারণে তারা চরম পরিণতির সম্মুখীন হয়েছিল। মওলানা বলেনÑ
নকযে মীছাক ও শেকাস্তে তাওবেহা
মুজেবে লা’নত শওয়াদ দর এন্তেহা’
প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন ও তওবা ভঙ্গ করা
অবশেষে নিয়ে আসে লানতের বোঝা।
আরেকটি ঘটনা ছিল হজরত মুসা (আ.) এর জমানায়। সম্প্রদায়টি ‘আসহাবুস সাবত’ নামে পরিচিত। আসহাবে সাবতের শাব্দিক অর্থ ‘শনিবার ওয়ালা’। এক শনিবারে ইহুদিদের একটি সম্প্রদায়ের ওপর আল্লাহর লানত ও গজব নেমে এসেছিল এবং সবার আকৃতি বিগড়ে গিয়ে শূকর-বানরে পরিণত হয়েছিল। ইতিহাসে তারা আসহাবুস সাবত নামে পরিচিত। কোরআন মজিদে এরশাদ হয়েছেÑ ‘বলুন, আমি কি তোমাদের এর চেয়ে নিকৃষ্ট পরিণামের সংবাদ দেব, যা আল্লাহর কাছে আছে? যাকে আল্লাহ লানত করেছেন, যার ওপর তিনি ক্রোধান্বিত, যাদের কতককে তিনি বানর ও কতককে শূকর করেছেন এবং যারা তাগুতের ইবাদত করে, মর্যাদায় তারাই নিকৃষ্ট এবং সরলপথ থেকে সর্বাধিক বিচ্যুত।’ (সূরা মায়িদা : ৬০)।
মওলানা রুমি (রহ.) এর মূল্যায়ন হলোÑ
নাকযে তাওবাও আহদে আন আসহাবে সাবত
মওজেবে মাসখ আমদ ও এহলাক ও মাকত
সাবাত ওয়ালাদের তওবা ও প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন
হলো আকৃতি বিকৃতি, ধ্বংস ও দুর্ভাগ্যের কারণ।
আসহাবে সাবতের ওপর শূকর-বানরে পরিণত হওয়ার গজব কীভাবে নেমে এসেছিল তার বিস্তারিত বিরবরণ আছে ইতিহাস ও তাফসির গ্রন্থগুলোতে। আমরা এখানে তার সারসংক্ষেপ উল্লেখ করছি।
আল্লাহর নবী হজরত দাউদ (আ.) এর জমানার কথা। বনি ইসরাইল বংশের একটি সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল সাগর তীরে। সম্ভবত লোহিত সাগর। তাদের বসতির নাম ছিল ঈলা। এখনও লোহিত সাগরের একটি বন্দরের নাম ঈলাত। সাগর তীরে বসবাসের কারণে ঈলার লোকদের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল ছিল মাছ ধরার ওপর। ইহুদিদের কাছে সাবাত বা শনিবার ধর্মীয় পবিত্র দিন। শনিবারের ছুটির দিনে রুজি-রোজগার, কাজকর্ম বা আয়-উপার্জন করা নিষেধ ছিল। স্বভাবতই সাগরে মাছ ধরাও নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু তারা ছিল চরম স্বার্থবাদী, মুনাফালোভী। যে কোনো কারণে শনিবার নদীর কূলে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ভেসে উঠত। লোভাতুর আসহাবুস সাবত শনিবার মাছ ধরার জন্য নানা কৌশল বের করল। তারা সাগরের সঙ্গে লাগোয়া খাল ও খাড়ি খনন করল। মাছগুলো সারাদিন ভাসতে ভাসতে খালে-খাড়িতে প্রবেশ করলে সন্ধ্যায় তারা খাল-খাড়ির মুখটা বন্ধ করে দিত। ফলে মাছগুলো সাগরে ফিরে যেতে পারত না। এ কৌশলে তারা শনিবারে মাছ আটকে রেখে সপ্তাহের অন্যদিনে ধরত। কিছু লোক ভিন্ন কায়দায় জাল, বড়শি, চাঁই শনিবারে সাগরে ফেলে রাখত আর পরদিন তুলে আনত। তাদের বক্তব্য ছিল আমরা শনিবারের পবিত্রতা লঙ্ঘন করছি না। মাছ তো শিকার করি শনিবার বাদে অন্যদিনেই। কেউ কেউ রসিয়ে যুক্তি সাজাত, আমাদের তো শনিবার মাছ খেতে নিষেধ করা হয়েছে। শিকার করতে নিষেধাজ্ঞা নেই।
আল্লাহর বিধান নিয়ে এমন মশকরা, ছলচাতুরী ও বেয়াদবির কারণে তাদের ওপর গজব নাজিল হয়। একদিন ভোরবেলা চেঁচামেচি শুনে প্রতিবেশীদের ঘুম ভাঙে। দেখে যে, ওই পাড়ার লোকদের আকৃতি বদলে শূকর-বানর হয়ে গেছে। সন্ধ্যা নাগাদ কিংবা এক দুই দিনের ব্যবধানে শূকর-বানরে পরিণত নাফরমান সম্প্রদায়টি মরে শেষ হয়ে যায়। তাদের এমন ভয়াবহ পরিণতির কারণ ছিল আল্লাহর সঙ্গে কৃত তওবা তারা ভঙ্গ করেছিল। প্রশ্ন হলো, উম্মতে মুহাম্মদির মধ্যে যারা আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করে, শরিয়তের বিধিবিধান লঙ্ঘন করে তাদের পরিণতি কী হবে?
আন্দরীন উম্মত নবুদ মাসখে বদন
লেকে মসখে দিল বুয়াদ আই যুল ফেতন
এই উম্মতের হবে না শরীরের বিকৃতি
তবে অন্তরের বিকৃতি হবে হে বুদ্ধিমান।
নবীজি (সা.) এর উম্মতের মাঝে দেহের আকার-আকৃতি-বিকৃতির আজাব হবে না। নবীজির সম্মানে এ আজাব রহিত। নবীজির উম্মত দুই ধরনের। উম্মতে এজাবত আর উম্মতে দাওয়াত। উম্মতে এজাবত মানে সাড়াদানকারী জাতি। যারা নবীজির আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুসলমান হয়েছে তারা উম্মতে এজাবতের অন্তর্ভুক্ত। আর যাদের নবীজির আহ্বান জানানো হয়েছে, এখনও আহ্বানে সাড়া দেয়নি তারা নবীজির উম্মতে দাওয়াত। অর্থাৎ ইসলামের ছায়াতলে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে, এমন উম্মত। সে হিসেবে সমগ্র দুনিয়ার সব মানুষই নবীজির উম্মতের মধ্যে শামিল। এ কারণেই নবীজির আবির্ভাবের পর থেকে দুনিয়ার বুকে কোনো জাতি বা সম্প্রদায়ের ওপর আকৃতি-বিকৃত হওয়ার মতো গজব নাজিল হয়নি।
মওলানা বলেন, আল্লাহর নাফরমান, আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়াদা বেমালুম ভুলে যায় যারা, তাদেরও বিকৃতি ঘটবে; তবে এ বিকৃতি প্রকাশ্যে দৃশ্যমান হবে না। হবে অন্তরে, অভ্যন্তরে, মনে ও আচরণে। হজরত আলী (রা.) এর ভাষায় তাদের আকৃতি মানুষের থাকবে বটে, অন্তর হবে জানোয়ারের। ‘সুরত হবে মানুষের সুরত আর কলব হবে জানোয়ারের কলব।’
এর কারণ হলো, মানুষের মনে অন্তরে কোনো মন্দ স্বভাবে যদি বসে যায়, তা সেই স্বভাবের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ জানোয়ারের প্রতিচ্ছবি ধারণ করে। কখনওবা এর উদ্ভাস তার চেহারায় ও আচরণে প্রকাশ পায়। যে তার অন্তরে বাননের স্বভাব লালন করবে সেই স্বভাব তার আচরণে প্রকাশ পাবে। একইভাবে যে নিজের মনকে শূকর ও কুকুরের মতো নোংরা হিংস্র করবে তার দেহ ও চরিত্রে এর প্রকাশ ঘটবে। পক্ষান্তরে মন যদি পবিত্র হয় বাহ্যিক সুরত কদাকার হলেও মনের ঔজ্জ্বল্য কদাকার চেহারায় নুরের উদ্ভাস ছড়িয়ে দেবে। এর উদাহরণ আসহাবে কাহাফের কুকুর। কুকুর হয়েও মনের পবিত্রতার কারণে এ কুকুরের প্রশংসা কোরআনে এসেছে। বেহেশতেও আসহাবে কাহাফের সাথি হবে। এক কথায় দুনিয়ায় গোপন থাকলেও কেয়ামতের দিন সবার অন্তর্গত স্বরূপ প্রকাশ হয়ে যাবে। তখন প্রত্যেকের বাতেনি সুরত জাহেরি সুরত ধারণ করবে। (তথ্যসূত্র:মওলানা রুমির মসনবি শরিফ
৫খ. বয়েত-২৫৬৪-২৫৯৯)।