স্বদেশ ডেস্ক:
ছাত্রত্ব শেষ দুই বছর আগে। তবু বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) আবাসিক হলে কক্ষ দখল করে রেখেছেন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। সুশৃঙ্খল ক্যাম্পাসের নির্ধারিত আসনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হলে সিট
মেলে না। তাদের স্থলে বছরের পর বছর ছাত্রলীগ নেতাদের বদৌলতে আশ্রয় পায় বহিরাগতরাও। এ নিয়ে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করা যায় না। উপরন্তু সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে কেউ ফেসবুকে ভিন্ন মত বা দৃষ্টির পোস্ট তুলে ধরলে কিংবা কোনো শিক্ষার্থী তবলিগে গেলে তাকে পড়তে হয় ছাত্রলীগ নেতাদের জেরার মুখে। জেরাকালে কোনো কথায় সন্দেহ হলে শুরু হয় নির্যাতন। এভাবেই এত দিন বুয়েট ক্যাম্পাসে রাজত্ব চালিয়ে এসেছেন ছাত্রলীগের নেতারা। জেরার সময় ‘সন্তোষজনক’ জবাব না পেলে সংগঠনটির নেতারা তাদের ‘নিজস্ব আদালতে’ বিচার বসাতেন এবং তাৎক্ষণিক ‘রায়’ও দিতেন। রায় মানে হচ্ছে অমানুষিক নির্যাতন। ক্ষেত্রবিশেষে নির্যাতিতদের আখ্যায়িত করা হতো শিবির হিসেবে।
অভিশপ্ত সেই আদালত, রায় এবং তা কার্যকরের অন্যতম স্থান ছিল বুয়েটের শেরেবাংলা আবাসিক হলের ২০১১ নম্বর কক্ষ। বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাসেলের নেতৃত্বাধীন সংগঠনটির নেতারা এ বিচারকাজ চালাতেন, রায় কার্যকর করতেন। বুয়েটের একাধিক শিক্ষার্থী জানান, বিচারকক্ষের নামে ছাত্রলীগের এই টর্চারসেলটিতে বাস করতেন বুয়েট ছাত্রলীগের উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল, উপদপ্তর সম্পাদক মোস্তফা রাফিক, আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা ও প্রত্যয় মবিন। প্রথম তিনজন বুয়েটের ১৬ ব্যাচের আর প্রত্যয় মবিন ১৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী। যে কাউকে ডেকে ২০১১ নম্বর কক্ষে এনে বিচার বসাতেন রাসেলের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের নেতারা। উপস্থিত ছাত্রলীগ নেতাদের সম্মতিতে রায়ের নামে করা হতো অমানুষিক নির্যাতন। গত সোমবার প্রথম প্রহরে এখানেই শিবির আখ্যা দিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয় মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে।
শেরেবাংলা হলের বেশ কয়েকজন আবাসিক শিক্ষার্থী জানান, এর আগে, কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন এতে যোগ দেওয়ার অভিযোগে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র তাইয়্যান নাফিজ প্রধানকে ডেকে ওই রুমে মারধর করেন ছাত্রলীগ নেতারা। ওই সময় মেহেদী হাসান রবিন, অমিত সাহা, রফিক, প্রত্যয় মবিনসহ ১০-১২ জন উপস্থিত ছিলেন।
বুয়েটের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই সাধারণত পড়াশোনার পাশাপাশি ধর্মীয় আচার পালন করে থাকেন; ছুটি পেলে তবলিগ জামাতেও যান তাদের কেউ কেউ। কিন্তু তবলিগে গেলে শিবিরের কর্মী আখ্যায়িত করে তাদের নির্যাতন করতেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এক শিক্ষার্থী জানান, এহতেশাম নামে এক ছাত্র তবলিগে যাওয়ায় জঙ্গি-শিবির বলে তাকে নির্যাতন করা হয়। এমন আরও অনেকেই আছেন ভুক্তভোগী। ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে যোগ না দিলে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের ওপর নির্যাতনের রোল চাপিয়ে দেওয়া হতো।
জানা গেছে, নিয়মিত ছাত্রদের চারজনের নামে একটি কক্ষ বরাদ্দের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু ছাত্রত্ব হারানো ২০১৩-১৪ বর্ষের শিক্ষার্থী ও বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল শেরেবাংলা হলের তৃতীয় তলার ৩০১১ নম্বর রুমটি দখল করে একাকী থাকতেন। একই ভাবে পাশের দুটি রুম দখল করে সেখানে বহিরাগতদের নিয়ে আড্ডা দিতেন তিনি। ২০০৫ নম্বর রুমে থাকতেন ইশতিয়াক মুন্নাসহ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা। এসব রুমে গাঁজা, মদ সেবনসহ গভীর রাতে উচ্চৈঃস্বরে গানবাজনা চলত।
একাধিক শিক্ষার্থী জানান, শেরেবাংলা হলের ২০১১ নম্বর কক্ষটি ছিল খোদ শাখা ছাত্রলীগ ঘোষিত টর্চারসেল। জুনিয়রদের র্যাগ দেওয়া হতো এখানে। আবরার ফাহাদ হত্যার পর এ কক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আলামত হিসেবে স্ট্যাম্প, চাপাতি ও মদের বোতল উদ্ধার করেছেন। মদ্যপ অবস্থায় অনিক সরকার ও রবিনই আবরার ফাহাদকে বেশি মারধর করেন বলে সূত্রের খবর।
শিক্ষার্থীরা জানান, ২০১৮ সালের মাঝামাঝি ১৭ ব্যাচের ছাত্র সাখওয়াত অভিকে জোরপূর্বক সমাবেশে যেতে বাধ্য করেন অমিত সাহা। সমাবেশে যেতে দেরি করলে অমিত তাকে মারধর করেন। এতে অভির হাত ভেঙে যায়। তাকে বলতে বাধ্য করা হয় যে, মারধরে নয়, সিঁড়ি থেকে পড়ে হাত ভেঙেছে। এ রকম নির্যাতন চললেও শিক্ষার্থীরা কেউ ভয়ে প্রতিবাদ করেননি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল এ হলের ছাত্র হওয়ায় সবকিছুতেই প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে।
এসব ঘটনায় নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একাধিক ছাত্র বিভিন্ন সময় হলের প্রভোস্টের কাছে অভিযোগ করেন। এ নিয়ে সহকারী প্রভোস্ট শাহীনুর রহমান ছাত্রলীগ নেতাদের সংযত হতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তাকেও হকিস্টিক দেখিয়ে শাসিয়ে দেন ছাত্রলীগ নেতারা। আর এসবের মূলে ছিলেন রাসেল, ফুয়াদ, রবিন, সকাল, জেমি, অমিত, রাফাত, হোতা। অমিত সাহা আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) সমর্থক। একাধিক ছাত্রের অভিযোগ, আবরার ফাহাদকে নির্যাতন করার আগে কক্ষে ডেকে নেন অমিত শাহ। তবে মামলায় তাকে আসামি করা হয়নি। গ্রেপ্তারেও তার নাম নেই।
তবে পুলিশ বলছে, ঘটনার সময় অমিত শাহ হলের বাইরে পূজার ছুটিতে ছিলেন। ফুটেজ যাচাইসহ আবরারের বাবা মামলা দায়ের করেছেন; সেখানে অমিতের নাম নেই। তবে আবরারের বাবা বলেছেন, পুলিশ মামলার এজাহার টাইপ করে দিয়েছেন। এর পর তিনি শুধু স্বাক্ষর করেছেন। কে জড়িত আর কে নির্দোষ সেটা তার জানা নেই। খুনিদের ফাঁসি চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য কামনা করেন তিনি।
ছাত্রদের ভাষ্য, আবরার হত্যার পর সংক্ষিপ্ত ফুটেজে বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদ মুহতাসিম ফুয়াদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মো. অনিক সরকার, ক্রীড়া সম্পাদক মিফতাহুল ইসলাম জিয়ন, উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশারফ সকাল, গ্রন্থ ও প্রকাশনা সম্পাদক ইশতিয়াক আহমেদ মুন্না, উপদপ্তর সম্পাদক মোস্তফা রাফিক, মুনতাসির আল জেমি, তানভীর খন্দকার, রাফাত, হোসাইন মোহাম্মদ তোহার উপস্থিতি দেখা গেছে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ছাত্রলীগের টর্চারসেলে (২০১১) সব সময় ১০-১২ জন আড্ডা জমাতেন। গতকাল সরেজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, ২০১১ নম্বর রুমের সামনে ১২ জোড়া জুতা পড়ে আছে। আবরার যে কক্ষে থাকতেন, সেই ১০১১ নম্বর কক্ষটিও এদিন তালাবদ্ধ দেখা গেছে।
এক ছাত্র জানান, রাত আড়াইটা-পৌনে তিনটার দিতে তিনি নিচে নামেন চা পান করতে। ওই সময় দেখেন হলে পুলিশ। তিনি জানতে পারেন, ক্যান্টিনে আবরারের মরদেহ পড়ে আছে। এর পর ধীরে ধীরে ছাত্রলীগের ছেলেরা হল ছেড়ে চলে যান। তদন্তসংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, ছাত্রলীগ সেক্রেটারি রাসেলের নেতৃত্বে আববারকে হত্যা করা হয়। নির্যাতনের সময় রবিন ও অনিক মাহমুদ সরকার সবচেয়ে বেশি আগ্রাসী ছিলেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চকবাজার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কবির হাওলাদার বলেন, এই মামলায় এজাহারনামীয় ১৯ জনের মধ্যে ৯ জনসহ এজাহারের বাইরে আরও একজনসহ মোট ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।