স্বদেশ ডেস্ক:
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাস্টমসের সুরক্ষিত গুদাম থেকে স্বর্ণ লুটকাণ্ডে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক সদস্য এবং সাবেক এক কাস্টমস কমিশনারসহ (বর্তমানে ঢাকার বাইরে কর্মরত) পদস্থ সাত কর্মকর্তার যোগসাজশ পাওয়া গেছে তদন্তে। প্রভাবশালী এসব কর্মকর্তা এখন নিজ নিজ গা-বাঁচাতে ধরনা দিচ্ছেন সরকারের ওপরের মহলসহ বিভিন্ন সংস্থায়।
এদিকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) দাবি করছে, তদন্তের ক্ষেত্রে তাদের ওপর কোনো চাপ নেই। কিন্তু চাঞ্চল্যকর এ লুটকাণ্ডের জেরে কাস্টমসের ৪ সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা এবং ৪ সিপাহীকে ধরে আনার পর সাত দিন পেরিয়ে গেলেও গতকাল শনিবার পর্যন্ত কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি। এ ছাড়া এ আটজনের বাইরে আরও অনেকে স্বর্ণলুটে জড়িত বলা হলেও তাদের ছাড়া আর কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। এমন তথ্য পাওয়া গেছে তদন্ত কর্মকর্তাদেরই বরাতে।
ডিবি পুলিশের পাশাপাশি ঢাকা কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষও স্বর্ণ লুটের কাণ্ডে ১২ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এ অপকর্মে কাস্টমসের নিম্নপদস্থদের পাশাপাশি উচ্চপদস্থদেরও সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি খুঁজে দেখা হচ্ছে। স্বর্ণ লুটের ঘটনায় তারা ৭ কর্মকর্তার যোগসাজশের তথ্য পেয়েছেন। এ সাতজনের মধ্যে এনবিআরের একজন সদস্য এবং বর্তমানে অন্যত্র কর্মরত ঢাকা কাস্টম হাউসের সাবেক এক কমিশনার ছাড়াও রয়েছেন- ঢাকা কাস্টম হাউসের এক যুগ্ম কমিশনার, এক উপকমিশনার, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম, শহিদুল ইসলাম এবং সিপাহী নিয়ামত হাওলাদার। তারা পরস্পরের যোগসাজশে কাস্টমসের গুদাম থেকে স্বর্ণ লুট করেছেন। এখন তাদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের কাজ চলছে। সন্দেহভাজন এসব কর্মকর্তাকে দ্রুতই জিজ্ঞাসাবাদ ও আইনের আওতায় আনা হবে বলে পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তারা জানান।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ গুদামের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারাই জড়িত নাকি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কেউ জড়িত তাও খোঁজার চেষ্টা চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিমানবন্দর কাস্টম হাউসের গুদাম ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে যেসব কর্মকর্তা ছিলেন তাদের জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা হবে। তাদের মধ্যে রয়েছেন- স্বর্ণ চুরির সময় ঢাকা কাস্টম হাউসের বিচার শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত কমিশনার ফরিদ উদ্দিন, তার আগে দায়িত্ব পালন করা যুগ্ম কমিশনার সিপাহী মরিয়মসহ অন্তত ৬-৭ জন। বিচার শাখার দায়িত্বই ছিল স্বর্ণের গুদামের নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা।
এদিকে ৫৫ কেজি স্বর্ণ লুটের পর বিমানবন্দরস্থ ঢাকা কাস্টমসের গুদামের নিরাপত্তা ঢেলে সাজানো হচ্ছে। গুদামে চোর ধরার অ্যালার্মসহ বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে সিলগালা করে দেওয়া বিমানবন্দর কাস্টমসের গোডাউন খুলে দিতে ডিবিকে চিঠি দিয়েছে ঢাকা কাস্টম হাউস।
এ ব্যাপারে গতকাল ঢাকা কাস্টম হাউসের উপকমিশনার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, গুদামে কে ঢুকছে এবং বের হচ্ছে তাদের শতভাগ শরীর তল্লাশি নিশ্চিত করতে হবে। গুদামের দায়িত্বে থাকা যুগ্ম কমিশনারের অনুমতি ছাড়া কেউ ভেতরে ঢুকতে পারবে না। কমিশনার ঢুকতে চাইলেও তার শরীর তল্লাশিসহ সব ধরনের পদ্ধতি মানতে হবে। এ জন্য চারজন দেহতল্লাশি কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। গুদামে কে ঢুকবে এবং কী জন্য ঢুকবেÑ একটি রেজিস্ট্রারে তার লিখিত থাকতে হবে। আর বের হওয়ার পর নিরাপত্তাকর্মী তল্লাশির পর নির্দিষ্ট খাতায় স্বাক্ষর করতে হবে। নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে নতুন করে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হচ্ছে। কয়েক দিনের মধ্যেই চোর ধরতে ‘অ্যান্টি থিফ’ অ্যালার্ম স্থাপন করা হবে। গুদামে কেউ ঢুকলে অ্যালার্ম বেজে উঠবে।
তিনি আরও জানান, কাস্টমসের গোডাউনের হেফাজত ও নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল কাস্টম হাউসের বিচার শাখার। এখন বিচার শাখা থেকে আলাদা করে বিমানবন্দর কাস্টমস শাখায় গুদামের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। গোডাউন সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনাগুলো বিমানবন্দর কাস্টমস দেখবে। যেমনÑ নিরাপত্তা থেকে শুরু করে মালামাল আটক করা, বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানোসহ সব কাজ বিমানবন্দর কাস্টমস করবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি) আকরাম হোসেন গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় আমাদের সময়কে বলেন, স্বর্ণ চুরির ঘটনায় এখনো কাউকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি। আটজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। প্রযুক্তির সহায়তাসহ আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তদন্ত করছি। নিশ্চিত হওয়ার পর জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হবে। প্রথম দিন ধরে আনা আটজনের বাইরে আর কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ কিংবা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য নিয়েছি এবং যাচাই-বাছাই করছি। তবে আটজনের বাইরে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করব।
পুলিশ বলছে, কাস্টম হাউসের গুদামে স্বর্ণসহ মূল্যবান জিনিসপত্র থাকলেও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় চরম অব্যবস্থাপনা ছিল। আর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল। ঘটনার পর কাস্টমসের পক্ষে দাবি করা হয়, গুদামে থাকা সিসি ক্যামেরাগুলো নষ্ট। এমনকি সেখানে তাদের কোনো ক্যামেরা নেই। পরে তদন্তে জানা যায়, কাস্টমসেরই ক্যামেরা রয়েছে। তা মনিটরিং করা হতো একজন কাস্টমসের শীর্ষ কর্মকর্তার কক্ষ থেকে। গত ৩ সেপ্টেম্বর স্বর্ণ চুরির বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় ১৮ দিনের আগ থেকে সিটি ক্যামেরার সব ফুটেজ গায়েব করা হয়েছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ কীভাবে গায়েব করা হলো সেটিও কর্তৃপক্ষের জানার কথা। একটি বৃহৎ চক্র সমন্বিতভাবেই এই চুরির ঘটনা ঘটিয়েছে। আর সিসি ক্যামেরা ফুটেজ তারাই গায়েব করেছে। এখানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও দায় এড়াতে পারেন না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাঁচ দফায় তদন্ত কমিটি করলেও সেই কমিটি এ পর্যন্ত কাস্টমসের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর দায়িত্বে অবহেলা নিশ্চিত করতে পারেনি। ঘটনায় দীর্ঘদিন পার হলেও কাউকে সাময়িক বরখাস্ত পর্যন্ত করেনি। এ ছাড়া কাস্টমসের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা এনবিআর দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এ কাণ্ডের জেরে কোনো তদন্ত কমিটি করেনি। উপরন্তু এ লুটকাণ্ডে এনবিআরের এক প্রভাবশালী সদস্যের নাম এলেও সংস্থাটির কর্মকর্তারা মুখে কুলুপ এঁটেছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চক্রটি কাস্টম হাউস থেকে দীর্ঘদিন ধরে দফায় দফায় সুকৌশলে স্বর্ণ গায়েব করেছে। এর নেপথ্যে একটি বড় ও শক্তিশালী চক্র রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২০ সাল থেকে লকারে রক্ষিত স্বর্ণ গায়েব হওয়া শুরু হয়।
ঢাকা কাস্টমসের সুরক্ষিত ভল্ট থেকে স্বর্ণ লুটের বিষয়টি ৩ সেপ্টেম্বর জানাজানি হলে বিমানবন্দর থানায় চুরির মামলা দায়ের করা হয়।