স্বদেশ ডেস্ক:
ভারতের হরিয়ানায় দাঙ্গাবিধ্বস্ত নূহতে প্রশাসন আজ নিয়ে টানা চার দিন ধরে বুলডোজার দিয়ে বহু বাড়িঘর ও দোকানপাট ভেঙ্গে দিচ্ছে।
সরকার যদিও দাবি করছে এর সাথে সাম্প্রতিক দাঙ্গার কোনো সম্পর্ক নেই, তবে ঘটনা হল বেছে বেছে তাদেরই দোকানপাট ভাঙা হচ্ছে যারা ওই হিংসায় জড়িত ছিল বলে অভিযোগ।
যেমন, আজ (রোববার) সকালেই নূহতে ‘সাহারা ফ্যামিলি হোটেল’ নামে একটি মুসলিম মালিকানাধীন চারতলা হোটেল ভবন বুলডোজার দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
গত সোমবার (৩১ জুলাই) নূহতে সহিংসতার দিন ওই হোটেল ভবনের ছাদ থেকেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ধর্মীয় শোভাযাত্রায় পাথর ও ইট ছোড়া হয়েছিল বলে অভিযোগ।
নূহ জেলার সরকারি টাউন প্ল্যানার ভিনেশ কুমার অবশ্য আজ দাবি করেছেন, ওই হোটেলটির স্থাপনা পুরোপুরি অবৈধ ছিল এবং সেটিকে ভাঙার ব্যাপারে অনেক আগেই তারা নোটিশ দিয়েছিলেন।
গত বেশ কয়েক বছর ধরে ভারতে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, আসামসহ বিভিন্ন বিজেপিশাসিত রাজ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় কেউ জড়িত বলে অভিযোগ উঠলেই তাদের সম্পত্তি-বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলার একটা প্রবণতা শুরু হয়েছে।
আইন-আদালতে কেউ দোষী বলে প্রতিপন্ন হওয়ার আগেই তাদের বাড়িঘর ভেঙে দিয়ে এভাবে শাস্তি দেয়ার প্রথা ভারতে ‘বুলডোজার জাস্টিস’ নামেও পরিচিতি পেয়েছে।
তবে বুলডোজার দিয়ে যাদের বাড়িঘর বা দোকানপাট ভাঙা হয়েছে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই মুসলিম। এরা কেউ নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন, কেউবা ছিলেন সাধারণ খেটে-খাওয়া গরিব মানুষজন।
বুলডোজার দিয়ে এভাবে ‘বিচার’ দেয়ার জন্য উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের তো নামই হয়ে গেছে ‘বুলডোজার বাবা’।
এখন দেখা যাচ্ছে, উত্তরপ্রদেশের পাশের রাজ্য হরিয়ানাতেও বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খাট্টারও ঠিক একই পথে হাঁটছেন।
তবে নূহ’র পাশাপাশি দাঙ্গা ছড়িয়েছে লাগোয়া অভিজাত এলাকা গুরগাঁওতেও, কিন্তু মুসলিম-অধ্যুষিত নূহতে বুলডোজার নামানো হলেও হিন্দু-প্রধান গুরগাঁওতে কিন্তু কোনো বুলডোজার নামেনি।
‘ডিমোলিশন ড্রাইভ’
সোমবার (৩১ জুলাই) বিকেল থেকে হরিয়ানার নূহতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের একটি মিছিলকে ঘিরে যে সহিংসতার সূত্রপাত হয় তাতে নূহ ও সংলগ্ন গুরগাঁওতে কম করে ছয়জনের প্রাণহানি হয়েছে।
নিহতদের মধ্যে দুজন সরকারি রক্ষী বা হোমগার্ড এবং একজন মসজিদের ইমামও ছিলেন।
এখনো ওই অঞ্চলে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়েছে, কারফিউ জারি করা হচ্ছে দফায় দফায়।
বৃহস্পতিবার পরিস্থিতি একটু নিয়ন্ত্রণে আসতেই নূহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে জেলা প্রশাসন বুলডোজার নিয়ে ব্যাপক অভিযান শুরু করে দেয়।
মুসলিম অধ্যুষিত ওই এলাকাটিতে বহু স্থায়ী ও অস্থায়ী দোকানপাট, খাবারের স্টল, বেশ কয়েকটি ওষুধের দোকান মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়।
প্রশাসন জানায়, যেগুলো ভাঙা হচ্ছে তার সবই ছিল অবৈধ স্থাপনা আর সে কারণেই এই ‘ডিমোলিশন ড্রাইভ’ চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
নূহ জেলার এসডিএম অশ্বিনী কুমার আরো বলেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মনোহর খাট্টারই ওই এলাকাতে এই অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রশাসন যদিও মুখে বলেছে, এ সপ্তাহের দাঙ্গার সাথে এই অভিযানের কোনো সম্পর্ক নেই, তারা কিন্তু বেছে বেছে সেই সব এলাকাতেই দোকানপাট ভাঙচুর করেছে যেসব রাস্তা দিয়ে সোমবারের মিছিল গিয়েছিল এবং যেখানে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয়েছিল।
গতকাল (শনিবার) আবার নূহ থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে তাউরু নামে একটি জায়গায় একটি অস্থায়ী বস্তি বুলডোজার দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়।
পুলিশ সূত্রে বলা হয়েছে, এই বস্তির বাসিন্দাদের অনেকেই সোমবার পাথর ছোঁড়ায় ও দাঙ্গা-হাঙ্গামায় জড়িত ছিলেন।
তবে স্থানীয়দের বক্তব্য, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা গরিব অভিবাসী মুসলিমরা ওই বস্তিতে থাকতেন ও দিনমজুরের কাজ করে পেট চালাতেন। বুলডোজার অভিযানের পর তারা মাথার ওপর পলিথিন বা ত্রিপলের সেই ছাদটুকুও হারিয়েছেন।
অনেকে বাধ্য হয়ে দেশে ফেরার ট্রেন ধরেছেন, যাদের সেই পয়সাটুকুও নেই তারা অসহায়ভাবে পথে বসেছেন।
তবে এদিন সকালে যেভাবে নূহর সাহারা ফ্যামিলি হোটেলটি ভেঙে দেয়া হযেছে তাতে একেবারে স্পষ্ট যে অভিযুক্ত দাঙ্গাকারীদের শাস্তি দিতেই হরিয়ানা সরকার এই বুলডোজার অভিযানে নেমেছে।
ওই হোটেলের মালিককে যোগাযোগ করার জন্য বিবিসি বাংলা এদিন তাকে বারবার ফোন করেছিল – কিন্তু তার ফোন আগাগোড়াই সুইচড অফ পাওয়া গেছে।
ভারতে বুলডোজার রাজনীতি
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে উত্তরপ্রদেশে যারা দেশের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, তাদের অনেকের সম্পত্তি ভাঙতে বুলডোজার ব্যবহার করেছিল ওই রাজ্যের সরকার।
এরপর উত্তরপ্রদেশে বিকাশ দুবে নামে কুখ্যাত এক অপরাধীর বাড়িঘর ভাঙতেও ২০২০ সালে বুলডোজার ব্যবহার করা হয়, বুলডোজার দিয়ে বাড়ি ভাঙার সেই ভিডিও জাতীয় টেলিভিশনেও সম্প্রচারিত হয়।
এভাবেই ক্রমে ক্রমে বুলডোজার ভারতের রাজনীতিতে ‘কঠোর প্রশাসনে’র একটা প্রতীকে পরিণত হয়।
২০২১ সালে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে যোগী আদিত্যনাথের নির্বাচনী জনসভাগুলোর বাইরেও সত্যিকারের বুলডোজার দাঁড় করানো থাকত। তার সমর্থকরা সেখানে আসতেন খেলনা বুলডোজার নিয়ে।
ক্রমে ক্রমে অন্যান্য বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোও প্রতিবাদীদের দমন করতে বুলডোজারের রাস্তা বেছে নেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবশ্য বুলডোজার অভিযানের ভিকটিমরা ছিলেন মুসলিম।
গত বছর উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদে জাভেদ মোহামেদ নামে একজন সুপরিচিত অ্যাক্টিভিস্ট ও রাজনীতিবিদের পারিবারিক বাড়িও অবৈধ বলে বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেয় প্রশাসন।
জাভেদ মোহামেদ ঠিক তার আগেই মহানবী হজরত মোহাম্মদ সা:-কে নিয়ে করা তখনকার বিজেপি মুখপাত্র নূপুর শর্মার বিতর্কিত মন্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলেন।
ওই ঘটনার পর দেশের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতিরা ও বিশিষ্ট নাগরিকরা এক খোলা চিঠিতে বিচারব্যবস্থার প্রতি আর্জি জানিয়ে বলেছিলেন, বুলডোজার ভারতের মুসলিম নাগরিকদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এবং এটা দেশে আইনি শাসনের লঙ্ঘন ছাড়া কিছুই নয়।
কিন্তু বুলডোজার ব্যবহারের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে প্রশাসন বরাবরই বলে এসেছে, এগুলো শুধু অবৈধ স্থাপনা ভাঙতে কিংবা সরকারি জমির জবরদখল ঠেকাতেই ব্যবহার করা হচ্ছে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টও বলেছে, ‘প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ’ হিসেবে বুলডোজারকে কখনোই ব্যবহার করা যাবে না।
কিন্তু নূহ’র সাম্প্রতিকতম ঘটনা আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, প্রশাসন যাদের দাঙ্গাকারী বলে মনে করছে আদালতের রায়ের অপেক্ষা না করেই তাদের বিরুদ্ধে বুলডোজার চালিয়ে দেয়া হচ্ছে – আর এই প্রবণতা এখন ছড়িয়ে পড়েছে হরিয়ানাতেও।
সূত্র : বিবিসি