স্বদেশ ডেস্ক:
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আপন কৌশলে এগোচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এক দিকে বিএনপি ও তার মিত্রদের সরকার পতনের টানা এক দফা আন্দোলন মোকাবেলার চিন্তা, অপর দিকে নির্বাচন কেন্দ্রিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউসহ বিদেশী রাষ্ট্র ও সংস্থাগুলোর তৎপরতার কূটনৈতিক জবাব দেয়ার বিষয়। দেশী-বিদেশী দুটো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কিভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায় সেটার নিজস্ব কৌশল নিয়েই মূলত চিন্তাভাবনা করছে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা এ দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব।
জানা গেছে, অভ্যন্তরীণ বিরোধী শক্তির এক দফা আন্দোলন মোকাবেলা ও নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী নির্বাচনের জন্য জোরালো প্রস্তুতি নিতে আজ রোববার সকাল সাড়ে ১০ টায় বিশেষ বর্ধিত সভায় বিশেষ বার্তা দেবেন আওয়ামী লীগ প্রধান। এ জন্য তৃণমূলের নেতাদের গণভবনে ডাকা হয়েছে। বিশেষ বর্ধিত ওই সভায় আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটি, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যবৃন্দ, জেলা ও মহানগর এবং উপজেলা, থানা ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা, জাতীয় সংসদের দলীয় সদস্যবৃন্দ, জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের দলীয় চেয়ারম্যানরা, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার দলীয় মেয়ররা এবং সহযোগী সংগঠনসমূহের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা উপস্থিত থাকবেন।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের অন্যতম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে সারা দেশ থেকে তৃণমূল নেতারা গণভবনে আসবেন এটা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ। এই সভায় নির্বাচন কিভাবে সুষ্ঠু করা যায়, কিভাবে দলকে আবারো ক্ষমতায় আনা যায়, জনগণকে কিভাবে ভোটে অংশগ্রহণ করানো যায় এসব বিষয়সহ আগামী নির্বাচনের কৌশল, প্রস্তুতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৃণমূল নেতাদের কাছে তুলে ধরবেন। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা আন্দোলন ও নির্বাচন নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তিতে মাঝে মধ্যে পড়ে যান সেগুলোও নিরসন করা হবে। তিনি বলেন, এছাড়াও বিএনপি-জামায়াত অতীতের মতো নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করছে। সেই ষড়যন্ত্র মোকাবেলার জন্য কিছু নির্দেশনা থাকবে। এককথায় জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সার্বিক প্রস্তুতি নেয়ার জন্য যে দিকনির্দেশনা আছে নেত্রী সেগুলো দেবেন এবং নির্বাচন বানচাল করার জন্য বিএনপি যে ষড়যন্ত্র করছে তা কিভাবে মোকাবেলা করা যায় সে বিষয়টি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনাও দেবেন। এ সভা তৃণমূল নেতাকর্মীদের জন্য একটা মাইল ফলক হয়ে থাকবে।
আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় টিকে থাকা বা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে নির্বাচনের ওপর। বিদেশীদের ওপর ভর করে বা ষড়যন্ত্র করে কেউই ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না বা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারে না। রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র সিঁড়িই হলো নির্বাচন। সেই নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে যদিও নানা শঙ্কা রয়েছে। তার পরও সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন যথাসময়ে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে। সরকারবিরোধীদের আন্দোলনের মুখে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলে মাঠে গড়াবে নির্বাচনী কার্যক্রম। একবার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলেই বিএনপি ও তার মিত্ররা তাদের নেতাকর্মীদের আন্দোলনমুখী রাখাটা অনেকটা কঠিন হবে। এ দিকে উকিল আব্দুস সাত্তারের মতো বিএনপি ও তাদের জোটের কিছু নেতাও আছেন যারা নির্বাচন করতে আগ্রহী। ওই সব নেতাদের নির্বাচনমুখী করানোর জন্য বিশেষ কিছু কৌশল নির্ধারণ করে কাজ করা হচ্ছে। নির্বাচন একবার মাঠে গড়াতে পারলে তাদের আন্দোলন ফিকে হয়ে যাবে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, সংবিধান অনুযায়ী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এ বছরের শেষের দিকে বা আগামী বছরের জানুয়ারিতে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে অতীতের মতো আগামী নির্বাচনও যথাসময়ে অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের তরফ থেকে জোরালোভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করা হচ্ছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার বিষয়টি জানিয়ে নির্বাচনকে কমিশনকেও সেভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ দিকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানোর জন্য বিএনপি ও তার মিত্ররা কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। কিন্তু শেষমেশ বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় মনোভাবের কারণে তারা সফল হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি বাস্তবায়ন না হলেও বিএনপি ও তার মিত্ররা ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। শেষমেশ তারা ভোট বর্জন করলেও কিন্তু আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদের জন্য সরকার গঠন করে মেয়াদের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। ফলে এবারও বিএনপি ও তার মিত্ররা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক বা না করুক সে বিষয়টি নিয়ে ভাবছে না আওয়ামী লীগ সরকার।
সূত্র আরো বলছে, আওয়ামী লীগের মনোযোগ বিদেশীদের তাগিদ অনুযায়ী আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানের দিকে। এ জন্য সরকার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের বিষয়টি সামনে রেখে কিভাবে বিদেশীদের ম্যানেজ করে নির্বাচনের আয়োজন করা যায় সে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বিদেশীরা সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ায় সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যে নেই সেটা তাদের বোঝানো হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউভুক্ত যে দেশগুলো রয়েছে সেখানে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সাম্প্রতিক অনুষ্ঠিত বৈঠকগুলোতে এসব বিষয়ে দল ও সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কাছে তুলে ধরা হয়েছে এবং এ বিষয়টি তারা ইতোমধ্যে বুঝতে সক্ষম হয়েছে। এ জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নেই। যদিও মানবাধিকার ইস্যুতে তারা কিছুটা চাপে রেখেছে। এ বিষয়টিও তাদের বোঝানো হচ্ছে। তবে মূল ফোকাস হলো সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে আগামী অনুষ্ঠান।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনকে রেখে প্রতিবারই তৃণমূল নেতাদের ডাকা হয়। তৃণমূল থেকে নেতারা আসবেন নেত্রীর বক্তব্য শুনবেন, তারা শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করবেন। তিনি বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে নেত্রী নির্দেশনামূলক যে বক্তব্য রাখবেন ওই নির্দেশনার আলোকে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেবেন। আওয়ামী লীগের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন বলেন, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে তৃণমূলের নেতাদের গণভবনে ডাকা হয়েছে। আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর যে বক্তব্য দেবেন তা শুনে নতুন প্রেরণা নিয়ে যাবেন তৃণমূলের নেতারা। তারা নতুন উদ্যমে সংগঠন শক্তিশালী করার জন্য কাজ করবেন। তিনি আরো বলেন, বিএনপি-জামায়াত নির্বাচন বানচাল করার জন্য যে অপচেষ্টা চালাচ্ছে, আন্দোলন করছে তা মোকাবেলা করার জন্যও তৃণমূল নেতাদের জন্য কিছু দিকনির্দেশনা থাকবে।
বিদেশীদের তৎপরতার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন বলেন, বিদেশীরা তাদের মতো করে তৎপরতা চালাচ্ছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা তাদের কথা শুনছি। তবে এ দেশের নির্বাচন হবে এ দেশের সংবিধান অনুযায়ী। আমরা সেই লক্ষ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করছি। আমরা সংবিধানের বাইরে যাব না। তিনি আরো বলেন, বিদেশীরা চায় আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হোক। এটাও আওয়ামী লীগ সরকারের কমিটমেন্ট আছে। তাদের সাথে আমাদের এ বিষয়ে মিল রয়েছে। তারা তো বলছে না তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করতে, সরকারকে পদত্যাগ করতে, সংসদ বিলুপ্ত করতে। ফলে আমরা সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছি।