স্বদেশ ডেস্ক:
ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপি-বিরোধী দলগুলি ‘ইন্ডিয়া’ নাম দিয়ে যে জোটের ঘোষণা দিয়েছে, তা পশ্চিমবঙ্গে বাস্তবায়িত করা সম্ভব নয় বলেই জোটের দুই অংশগ্রহণকারী দল জানিয়েছে। রাজ্যের বাস্তবতা মেনেই সেখানে এই জোট গড়া সম্ভব হবে না বলে তারা মনে করছে।
তবে তাদের সবারই মূল লক্ষ্য যে ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজেপিকে পরাজিত করা। সে লক্ষ্য থেকে তারা কেউ সরে আসবে না বলেও জানাচ্ছে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের অংশগ্রহণকারী দলগুলো।
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট, জাতীয় কংগ্রেস এবং ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট বা আইএসএফ নামে একটি দলের জোট রয়েছে।
বামফ্রন্ট ও জাতীয় কংগ্রেস বলছে সর্বভারতীয় স্তরে রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে মিলে বিজেপিকে হারানোর জন্য জোট বাঁধলেও পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে হাত মেলানো বা আসন ভাগের কোনো প্রশ্নই নেই। কোনো জোট তারা করবে না। রাজ্যে যেভাবে তারা তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতা করে আসছে, সেই ধারা বজায় রাখবে বামফ্রন্ট এবং জাতীয় কংগ্রেস।
অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেস বলছে যে সিপিআইএম তথা বামফ্রন্টের বিরোধিতা থেকেই তাদের দলের জন্ম, তাই জোটের কোনো প্রশ্নই নেই। আর কংগ্রেসও তো শূন্য হয়ে গেছে রাজ্যে, তাদের সাথে জোট করে তৃণমূল কংগ্রেসের কোনো লাভ হবে না।
রাজ্যে সম্প্রতি যে পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়ে গেল, তার আগে-পরে তৃণমূল কংগ্রেস আর বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোটের মধ্যে তীব্র এবং রক্তাক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। ওই ভোট প্রক্রিয়ার মধ্যে ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। মৃতদের মধ্যে সব দলের কর্মী-সমর্থকরাই আছেন।
মমতা-সোনিয়া-রাহুল একসাথে
পাটনা আর বেঙ্গালুরুতে বিজেপি-বিরোধী দলগুলির যে দু’টি জোট বৈঠক হয়েছে, সেখানে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জীকে দেখা গেছে সনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী আর কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলতে। আবার ওই বৈঠক দু’টিতেই হাজির ছিলেন সিপিআইএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিও।
ওই বৈঠকগুলিতে ঘনিষ্ঠতার ছবি উঠে এলেও রাজ্য রাজনীতির বাস্তব অবস্থাটা একেবারেই বিপরীত।
রাজ্যে সম্প্রতি যে পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়ে গেল, তার আগে-পরে তৃণমূল কংগ্রেস আর বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোটের মধ্যে তীব্র এবং রক্তাক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। ওই ভোট প্রক্রিয়ার মধ্যে ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। মৃতদের মধ্যে সব দলের কর্মী-সমর্থকরাই আছেন।
বামফ্রন্ট আর কংগ্রেস বলছে রাজ্যের বাস্তব পরিস্থিতি মমতা ব্যানার্জীর দলের সাথে জোট বাঁধার কোনো প্রশ্নই নেই। বিজেপি-বিরোধী জোটে মমতা ব্যানার্জীর দল কেন শামিল হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বামফ্রন্টের প্রধান শরিক সিপিআই এম।
দলের নেতা শতরূপ ঘোষ বিবিসিকে বলছিলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে যাদের একসাথে থাকার কথা, তারা তো জোটবদ্ধ আগে থেকেই রয়েছে। কংগ্রেস, বাম আর আইএসএফের জোট তো আছেই। মমতা ব্যানার্জী তো এই জোটের অংশ নন, তিনি এই জোটে কখনই থাকতে পারবেনও না।’
তার কথায়, মমতা ব্যানার্জীর দল আসলে বিজেপির হয়েই কাজ করে, তাই বিজেপি-বিরোধী জোটে তৃণমূল কংগ্রেসের কোনো জায়গা পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে থাকবে না।
শতরূপ ঘোষ বলছিলেন, ‘ইন্ডিয়া জোটে, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে আমরা উনার দলকে নেব না, সম্ভবত তৃণমূল কংগ্রেস একাই লড়বে, আর আমরা ইন্ডিয়া জোটের হয়ে লড়ব।’
‘কংগ্রেস করার লোক থাকবে না’
জাতীয় স্তরে মমতা ব্যানার্জীর সাথে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠতা থাকলেও রাজ্যে দু’টি দল চরম বিরোধী অবস্থানে রয়েছে।
কংগ্রেস নেতারা বলছেন যদি এর পরেও শীর্ষ নেতৃত্ব পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জীর দলের সাথে জোট করতে চায়, তাহলে রাজ্যে কংগ্রেস দলটাই উঠে যাবে।
পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতা কৌস্তভ বাগচী বলছিলেন, ‘পাটনা বা বেঙ্গালুরুতে যা হচ্ছে, তার সাথে পশ্চিমবঙ্গের কোনো সম্পর্ক নেই। যেভাবে তৃণমূল কংগ্রেস আমাদের কর্মীদের ওপরে অত্যাচার করেছে, দল ভেঙ্গেছে, বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তারপরে ওই দলের সাথে কোনো কংগ্রেস কর্মীর সম্পর্ক রাখার প্রশ্নই নেই, জোট তো দূরের কথা।’
তিনি এও জানান যে পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস কর্মীদের ওপরে যদি কোনও সিদ্ধান্ত শীর্ষ স্তর থেকে চাপিয়ে দেয়া হয়, তাহলে রাজ্য থেকে দলটাই উঠে যাবে, কংগ্রেস করার লোক থাকবে না।
জাতীয় কংগ্রেস অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করে যে ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মমতা ব্যানার্জী কংগ্রেস ভেঙ্গে নিজের দলকে বড় করেছেন, কংগ্রেস নেতাদের ভাঙ্গিয়ে নিয়ে গিয়ে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ইত্যাদি করেছেন, ভেঙ্গে দিয়েছেন কংগ্রেসের সংগঠনও। ক্ষমতায় আসার সময়ে তৃণমূল কংগ্রেস আর কংগ্রেসের জোট ছিল, তা সত্ত্বেও তৃণমূল কংগ্রেস জোট সঙ্গীর দল ভাঙ্গিয়েছে, এই অভিযোগও ওঠে।
‘শূন্য থেকে মহাশূন্যে’
বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস বলছে যে তারা ‘ইন্ডিয়া’ জোটে তৃণমূল কংগ্রেসকে কোনোভাবেই সাথে নেবে না। অন্যদিকে মমতা ব্যানার্জীর দল প্রশ্ন তুলছে, যারা এমনিতেই “শূন্য হয়ে গেছে, এখন মহাশূন্যের দিকে এগোচ্ছে, তাদের সাথে কীসের জোট?”
তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম মুখপাত্র অধ্যাপক মনোজিত মণ্ডলের কথায়, “পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে সিপিআইএমের সাথে জোট বা আঁতাতে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। কারণ, তারা তো নেই কোথাও আর থাকলেও কোনও আঁতাতের সম্ভাবনা থাকতই না। এটা তৃণমূল কংগ্রেসের মতাদর্শের বিরোধী।
তার কথায়, ‘আমাদের দলের জন্মই হয়েছিল সিপিআইএমের কুশাসন আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষকে বাঁচানোর লক্ষ্য নিয়ে। অন্যদিকে কংগ্রেসও কিছু নেই এখানে, প্রায় ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। তৃণমূল কংগ্রেস তো কংগ্রেসের ওপরে নির্ভর করে চলে না এ রাজ্যে। ওই দুটো দলের নেতাদের বক্তব্য বা তাদের কাজকর্মে তো দেখাই যাচ্ছে যে তারা বিজেপিকেই সুবিধা করে দিচ্ছে।’
অধ্যাপক মণ্ডল বলছিলেন, ‘তবে মাথায় রাখতে হবে ইন্ডিয়া জোটটা তৈরি হয়েছে জাতীয় রাজনীতিকে মাথায় রেখে। যে দল যেখানে শক্তিশালী, সেখানে তারা লড়বে। ভোটের পরে সবার আসনগুলো এক জায়গায় হবে বিজেপির বিরুদ্ধে।’
‘বিজেপিকে তারা হারাতে চায়’
জাতীয় স্তরে ইন্ডিয়া জোটে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস আর সিপিআইএম তথা বামফ্রন্ট একজায়গায় এল, অথচ পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস-আম একদিকে আর তৃণমূল কংগ্রেস অন্যদিকে, এটা কেমন জোট?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক শিখা মুখার্জী বলছিলেন, ‘জাতীয় স্তরে বিজেপি-বিরোধী যে জোট হয়েছে, তাদের কথা শুনে বোঝা যাচ্ছে যে তারা সবাই একটা বিষয়ে একমত যে বিজেপিকে তারা হারাতে চায়। আবার পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বাস্তবতা যা, তাতে তৃণমূল কংগ্রেস, জাতীয় কংগ্রেস আর বামফ্রন্ট এক জায়গায় আসা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে তারা যদি একে অপরের বিরুদ্ধে ভোটে লড়ে আর তারপরে জাতীয় স্তরে যদি তৃণমূল কংগ্রেস, জাতীয় কংগ্রেস-বামফ্রন্ট জোটের সব আসনগুলো যদি এক জায়গায় আসে, অর্থাৎ ইন্ডিয়া জোটের পক্ষে দাঁড়ায় তাহলে তো সেই বিজেপি বিরোধী অবস্থানকেই মজবুত করা হবে।’
এর আগে, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে দেখা গিয়েছিল যে তৃণমূল কংগ্রেসের ওপরে বিদ্বেষ থেকে কংগ্রেস আর বামফ্রন্ট সমর্থকদের একটা বড় অংশ, যারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী, তারা বিজেপিকে সমর্থন দিয়েছিলেন।
বাম ভোটারদের বিজেপির দিকে ঝুঁকে পড়ার সেই প্রবণতাকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ‘বামের ভোট রামে’ বলে অভিহিত করতেন।
কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পর থেকে রাজ্যে যতগুলো নির্বাচন, উপনির্বাচন হয়েছে, তাতে দেখা গেছে শতাংশের হিসাবে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট কমেছে আর বাম-কংগ্রেস জোটে প্রায় ততটাই ভোট বেড়েছে।
এই প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষকরা ব্যাখ্যা করেন ‘রামের ভোট বামে ফিরছে’ বলে।
আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনেও সেই প্রবণতা জারি থাকে কী না, সেটাই দেখার এমনটাই মত বিশ্লেষকদের।
ওই প্রবণতা যদি জারি থাকে, তাহলে যতই ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিক তৃণমূল কংগ্রেস আর বাম-কংগ্রেস জোট একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করুক পশ্চিমবঙ্গে, জাতীয় স্তরে গিয়ে তা বিজেপি-বিরোধী আসনই দলভারী করবে।
সূত্র : বিবিসি