শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৫ পূর্বাহ্ন

শিষ্টাচার : ইসলামের সৌন্দর্য

শিষ্টাচার : ইসলামের সৌন্দর্য

স্বদেশ ডেস্ক:

ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য হলো আদব বা শিষ্টাচার। মানুষের হৃদয় জয় করার অন্যতম মাধ্যম এটি। আর এর মাধ্যমেই সারা পৃথিবীতে ইসলাম বিজয় লাভ করেছে। এ আদব বা শিষ্টাচারকে সহজভাবে বলা যায় ভদ্রতা। ইসলামে ভদ্রতার মর্যাদা ও গুরুত্ব অত্যধিক।
আল্লাহ তায়ালা পরস্পরের সাথে ভদ্রতা বা শিষ্টাচার প্রকাশে সালামের বিধান দিয়েছেন। এ কারণেই মু’মিন মুসলমান পরস্পরের সাথে সাক্ষাৎ হলেই প্রথমে অভিবাদন প্রদান ও দোয়াস্বরূপ সালাম দেন। আর এ সালামের উত্তর আরো উত্তমভাবে দেয়ার জন্য পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘যখন তোমরা সালাম ও অভিবাদনপ্রাপ্ত হও, তখন তোমরা তার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর সম্ভাষণ করো অথবা একইভাবে অভিবাদন করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব বিষয়ে হিসাব গ্রহণকারী।’ (সূরা নিসা-৮৬)
শিষ্টাচারের গুরুত্ব সম্পর্কে নবী সা: ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই উত্তম চরিত্র, ভালো ব্যবহার ও পরিমিত ব্যয় বা মধ্যপন্থা অবলম্বন করা নবুওতের ২৫ ভাগের ১ ভাগ।’ (আবু দাউদ-৪৭৭৬)

হজরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা: বলেন, ‘তুমি আদব অন্বেষণ করো। কারণ আদব হলো বুদ্ধির পরিপূরক, ব্যক্তিত্বের দলিল, নিঃসঙ্গতায় ঘনিষ্ঠ সহচর, প্রবাসজীবনের সঙ্গী এবং অভাবের সময়ে সম্পদ।’ (ইছবাহানি, মুনতাখাব, সাফারিইনি, গিজাউল আলবাব-১/৩৬-৩৭)
হজরত ওমর রা: বলেন, ‘তোমরা আগে সুসভ্য হও, তারপর জ্ঞান অর্জন করো।’ বিশিষ্ট ফকিহ আহনাফ আল-কায়েস বলেন, ‘আদব বা শিষ্টাচার বিবেকের জ্যোতি, যেমন আগুন দৃষ্টিশক্তির জ্যোতি।’ (ফাতাওয়া আল মিসরিয়া-১০/৩৫৯)

কোনো মুসলিম কাক্সিক্ষত মানের ও সুসভ্য মানুষরূপে গড়ে উঠবে এবং নিজেকে অন্যান্য জাতি অপেক্ষা ভিন্ন বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করতে সক্ষম হবে তখনই, যখন ইসলামী শিষ্টাচারের সুষমাকে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও পার্থিব জীবনের সবদিক ও বিভাগে ফুটিয়ে তুলতে পারবে।
শিষ্টাচার হচ্ছে ভদ্র, মার্জিত ও রুচিসম্মত আচরণ। শিষ্টাচার মানুষকে সংযমী ও বিনয়ী করে তোলে। শিষ্টাচারের বীজ মূলত বপিত হয় শিশুকালে। আর এ ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা প্রধান। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। পরিবারের বড়রা যে রকম ব্যবহার করে শিশুরা তাই অনুকরণ করে। বাল্যকালে শিশুদের সংযম, বিনয় ও উন্নত রুচির চর্চা ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে শিষ্টাচার গড়ে তোলে।

সমাজজীবনের ভারসাম্য, শৃঙ্খলা, উন্নতি ও অগ্রসরতা অব্যাহত রাখতে পারস্পরিক সৌজন্যতা, মূল্যবোধ ও শিষ্টাচারের গুরুত্ব অপরিসীম। কোনো জাতিকে সুসভ্য ও সফলরূপে প্রতিষ্ঠিত হতে এর বিকল্প নেই। আমাদের বিদ্যমান অশান্ত সমাজে শান্তি ও স্থিতি আনতে হলে সবাইকে শিষ্টাচারসম্পন্ন হতে হবে। কারণ শিষ্টাচারসম্পন্ন মানুষ কোনো তুচ্ছ বিষয়ে নিজেকে জড়ায় না, কারো সাথে শত্রুতা করে না বা কারো স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটানোর চেষ্টা করে না। শিষ্টাচার হচ্ছে ভদ্র, মার্জিত ও রুচিসম্মত আচরণ। একজন মানুষ ভালো না মন্দ তা বিবেচিত হয় মূলত সে ব্যক্তির আচরণ দেখেই। এ গুণ মানুষকে সংযমী ও বিনয়ী করে তোলে। শিষ্টাচারসম্পন্ন ব্যক্তি তার ভদ্র ও সংযত ব্যবহার দিয়ে যেকোনো পরিস্থিতিতে যেকোনো পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে। এমন মানুষকে সবাই শ্রদ্ধা করে; হোক সে ব্যক্তি অসুন্দর কিংবা গরিব। ইসলামও আদব, শিষ্টাচার ও সৌজন্যতাকে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছে।

পৃথিবীতে যারা মানুষ হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন, তারা শিষ্টাচার ও মার্জিত ব্যবহারের মাধ্যমেই মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন। প্রত্যেক ধর্মে আদব ও শিষ্টাচারের গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নবী সা: ছিলেন শিষ্টাচারের মূর্ত প্রতীক। উন্নত ব্যবহারের জন্য তিনি ছোট-বড় সবার কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। সংযম, বিনয়, ভদ্রতা তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কখনো তিনি কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করেননি, উদ্ধত আচরণ করেননি। এ কারণেই যুগে যুগে মানুষের কাছে তিনি এত শ্রদ্ধার পাত্র। তবে এ গুণ হঠাৎ করে কারো মধ্যে গড়ে ওঠে না। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ প্রস্তুতি পর্ব।

সালাম বা সম্ভাষণ : ইসলামে পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সম্ভব হলে মুসাফাহা করা এবং কুশল বিনিময় করা যায়। নবী সা: ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রথমে সালাম দেয়, আল্লাহর কাছে লোকদের মধ্যে সেই উত্তম।’
সবার সাথে উত্তম ব্যবহার : জাতি, ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে সবার সাথে সুন্দর আচরণ করা ও ভালো কথা বলা, ভদ্র ও মার্জিত রুচির পরিচায়ক। সদাচরণ মানুষকে কাছে টানে। সদাচরণের বাস্তব উদাহরণ ছিলেন নবী সা:। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা, ‘আর আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের প্রতি (অর্থাৎ স্বীয় উম্মতের প্রতি) কোমল হৃদয় হয়েছেন। যদি আপনি কর্কশভাষী ও কঠোর হৃদয়ের হতেন তাহলে তারা আপনার পাশ থেকে সরে যেত।’ (আল ইমরান-৩/১৫৯)
সুন্দর কথা বলা : অসুন্দর কথা ও খারাপ ভাষা প্রয়োগ করে কোনো আদর্শ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীতে যত আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা সুন্দর কথা দিয়েই হয়েছে। ভালো কথা দিয়ে সহজেই মানুষের মন জয় করা যায়। শ্রেষ্ঠ মনীষীরা সুভাষী ছিলেন।

পাপ ও হারাম কথা থেকে জিহ্বাকে সংযত রাখা : কথাবার্তায় জিহ্বাকে সংযত ও নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। কেননা কোনো গোনাহের কথা বা হারাম কথা বললে তার জন্য পরকালে শাস্তি পেতে হবে। নবী সা: ইরশাদ করেন, ‘কোনো বান্দার ঈমান ততক্ষণ পর্যন্ত সঠিক হবে না যতক্ষণ না তার অন্তর সঠিক হবে। আর অন্তর ঠিক হবে না যতক্ষণ না তার জিহ্বা ঠিক হবে।’
অন্যের আমানত রক্ষা করা : কোনো ব্যক্তি কোনো কথা আমানত হিসেবে বললে তা রক্ষা করা মু’মিনের জন্য অবশ্য কর্তব্য। নবী সা: ইরশাদ করেন, ‘যার আমানতদারি নেই, তার ঈমান নেই’। অন্যের বলা কথার গোপনীয়তা রক্ষা করা জরুরি। সে ব্যক্তি মুখে গোপনীয়তা রক্ষার কথা না বললেও যখন সে ওই কথা অন্যের সামনে বলতে চাইবে না কিংবা অন্য কেউ শুনুক সেটিও পছন্দ করবে না, তখন বুঝে নিতে হবে যে, সেটি গোপনীয় কথা- যা গোপন রাখাই জরুরি। নবী সা: বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি কোনো কথা বলার পর মুখ ঘুরালে (কেউ শুনছে কি না তা দেখলে) তা আমানতস্বরূপ।’

মানুষের বোধগম্য ভাষায় কথা বলা : কথা বলার ক্ষেত্রে মানুষের বোধগম্য ভাষায় কথা বলা উচিত। দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলা সমীচীন নয়। কারণ এতে মানুষ কথা বুঝতে না পেরে কষ্ট পায়। হজরত আলী রা: বলেন, ‘মানুষের কাছে সেই ধরনের কথা বলো, যা তারা বুঝতে পারে। তোমরা কি পছন্দ করো যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি মিথ্যা আরোপ করা হোক?’

তিনজন থাকলে দু’জনে কানে কানে কথা না বলা : কোথাও তিনজন লোক থাকলে একজনকে বাদ দিয়ে দু’জনে কানে কানে কথা বলা যাবে না। কারণ এতে তৃতীয় ব্যক্তি মনে কষ্ট পায়। নবী সা: ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তিনজন একত্র হলে একজনকে বাদ দিয়ে যেন দু’জনে কানে কানে কথা না বলে। কেননা তাতে সে চিন্তিত হতে পারে।’
হেয় করার মানসিকতা ত্যাগ করা : কাউকে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করা এবং হেয় করার চিন্তা মন থেকে দূরে সরিয়ে দিতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীরা! কোনো সম্প্রদায় যেন কোনো সম্প্রদায়কে উপহাস না করে। হতে পারে তারা তাদের চেয়ে উত্তম। আর নারীরা যেন নারীদের উপহাস না করে। হতে পারে তারা তাদের চাইতে উত্তম। তোমরা পরস্পরের দোষ বর্ণনা করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। বস্তুত ঈমান আনার পর তাকে মন্দ নামে ডাকা হলো ফাসেকি কাজ। যারা এ থেকে তাওবাহ করে না, তারা সীমালঙ্ঘনকারী।’ (সূরা হুজুরাত-১১)

একাই কথা বলার মানসিকতা পরিহার করা : অনেকে আছেন কেবল নিজেই অধিক কথা বলতে বেশি পছন্দ করেন। অন্যকে কথা বলার সুযোগ কম দেন। এরূপ মানসিকতা পরিহার করা আবশ্যক; বরং অন্যের কথা শুনতে হবে ও তাদেরকে বলার সুযোগ দিতে হবে। আর কোনো মজলিসে কথা বলার ক্ষেত্রে বয়োজ্যেষ্ঠকে প্রাধান্য দিতে হবে। (আগামীকাল সমাপ্য)

লেখক :

  • মোহাম্মদ রেজাউল মোস্তফা ইব্রাহিম

কলামিস্ট, ইসলামী গবেষক

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877