স্বদেশ ডেস্খ: ব্যাংকগুলোয় চলছে নগদ টাকার সংকট। প্রয়োজন মেটানোর মতো পর্যাপ্ত অর্থ ভল্টে না থাকায় রেপোর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে এবং কলমানির মাধ্যমে টাকা নিতে বাধ্য হচ্ছে ব্যাংকগুলো। অর্থ সংকটের কারণে ঋণ বৃদ্ধির হার গত ৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। এরই মধ্যে ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) সীমা ৮৩ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮৫ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে ভল্টে আমানত হিসেবে ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশের পরিবর্তে ১৫ শতাংশ জমা রাখা যাবে। আর এ কারণে ব্যাংকগুলোর ভল্ট আরও খালি হয়ে যাওয়ার ভয় রয়েছে। এতে সাময়িকভাবে ঋণ বিতরণ বৃদ্ধি পাবে বলে ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে আমানতকারীদের।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে চলতি বছরে জুলাইয়ে ব্যাংকগুলোয় আমানতের পরিমাণ ১০ লাখ ৭১ হাজার ২৪ কোটি টাকা। এডিআর ৮৩ দশমিক ৫০ শতাংশ হলে ব্যাংকগুলো ৮ লাখ ৯৩ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করতে পারত। কিন্তু এডিআর ৮৫ শতাংশ হওয়ার ফলে ব্যাংকগুলো ৯ লাখ ১০ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা বিতরণ করতে পারবে। অর্থাৎ আমানত না বাড়লে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্ট থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকা নিয়ে এসে ঋণ বিতরণ করতে পারবে।
গত জুলাইয়ে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ বেড়েছে ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ। এটি গত ৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ব্যাংকাররা জানান, অর্থ সংকটের কারণেই ঋণ বিতরণ বাড়ানো যাচ্ছে না। অন্যদিকে অধিকাংশ ব্যাংক এডিআর সীমার কাছাকাছি চলে এসেছে। ফলে তারা চাইলেও ঋণ দিতে পারছে না। এর বাইরে বেশকিছু ব্যাংক নিজেদের প্রয়োজন মেটাতেই বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ ধার করছে।
গতকালের সার্কুলারে বলা হয়েছে, সম্পদ-দায় ব্যবস্থাপনা (এএলএম) নীতিমালা অনুসারে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর দ্বি-সাপ্তাহিক
গড় ভিত্তিতে রক্ষিতব্য সিআরআর দৈনিক ভিত্তিতে এসএলআর বাদে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল দাঁড়ায় ৮১.৫০ শতাংশ এবং ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর জন্য তা দাঁড়ায় ৮৯ শতাংশ। সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতের মূলধন ভিত্তি, তারল্য পরিস্থিতি, আন্তঃব্যাংক নির্ভরশীলতা এবং সর্বোপরি ব্যাসেল-৩ অনুসারে নির্ধারিত মাত্রা সংরক্ষণের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত প্রচলিত ধারার ব্যাংকের জন্য অগ্রিম-আমানত হার (এডিআর) সর্বোচ্চ ৮৫.০ শতাংশ (৮১.৫ শতাংশ + সার্বিক আর্থিক সূচকগুলো বিবেচনায় ব্যাংকের পর্ষদের সিদ্ধান্ত ক্রমে অতিরিক্ত ৩.৫ শতাংশ) এবং ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর জন্য বিনিয়োগ-আমানত হার (আইডিআর) সর্বোচ্চ ৯০.০ শতাংশ (৮৯.০ শতাংশ + সার্বিক আর্থিক সূচকগুলো বিবেচনায় ব্যাংকের পর্ষদের সিদ্ধান্তক্রমে অতিরিক্ত ১.০ শতাংশ) নির্ধারণ করা হলো।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সিআরআর ও এসএলআর নীতিমালার কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সংগৃহীত আমানতের সাড়ে ১৮ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জমা রাখতে বাধ্য ছিল। অর্থাৎ ৮১ দশমিক ৫০ শতাংশ আমানত বিতরণের জন্য ব্যাংকগুলোর কাছে থাকে। এডিআর সীমা বাড়ানোর ফলে ব্যাংকগুলো তাদের মূলধন বা অন্য কোনো উৎস থেকে অর্থ এনে আরও সাড়ে ৩ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে পারবে। অর্থাৎ তহবিল জোগাড় না করেই ব্যাংকের ভল্ট থেকে এ অর্থ নিয়ে তারা ঋণ বিতরণ করতে পারবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গত বছরের জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এডিআর সীমা কমানোর নির্দেশ দেয়। ব্যাংকের মালিকাদের চাপে এটি কমানোর সময়সীমা অন্তত ৪ দফা বাড়াতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরও সব ব্যাংক এডিআর সীমা নামিয়ে আনেনি। অন্তত ১০ থেকে ১২টি ব্যাংকের এডিআর নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি রয়েছে। সরকারি ব্যাংক ছাড়া অন্যান্য বেসরকারি ব্যাংকের এডিআর নির্ধারিত মাত্রার কাছাকাছি রয়েছে। ফলে তারা নতুন করে ঋণ দিতে পারছে না। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, যেহেতু বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আদেশ মেনে এডিআর কমিয়েছে, তাই পুরস্কারস্বরূপ তাদের বেশি ঋণ দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলো। এতে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণের গতি বাড়বে। কেননা বেসরকারি খাতে ঋণ বৃদ্ধি না হলেও বিনিয়োগ বাড়বে না, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশেন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) প্রেসিডেন্ট ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, এডিআর সীমার কারণে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করতে পারছে না, অন্যদিকে বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করছে। ফলে ঋণের সুদহারও বেড়ে যাচ্ছে। এখন এডিআর সীমা বাড়ানোর ফলে ব্যাংক অতিরিক্ত দেড় শতাংশ আমানত ঋণ বিতরণ করতে পারবে।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে ব্যাংকগুলো আগ্রাসীভাবে ঋণ বিতরণ করে অর্থ শেষ করে ফেলে। আগ্রাসী ঋণ বিতরণের ফলে ব্যাংকের তারল্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। এটি কাটাতে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে এডিআর সীমা দেড় শতাংশ কমিয়ে ৮৩ শতাংশ ৫০ শতাংশ (ইসলামি ব্যাংকিংয়ের জন্য ৯০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮৯ শতাংশ) করা হয়। ওই বছরের জুনের মধ্যে এডিআর সীমা কমানোর সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়।