শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৫৯ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গ্রুপ লায়ন্স ডেন কাদের নিয়ে গঠিত?

সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গ্রুপ লায়ন্স ডেন কাদের নিয়ে গঠিত?

স্বদেশ ডেস্ক:

চলতি বছরের শুরু থেকে অধিকৃত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুসালেমে ইসরাইলি বাহিনীর সাথে ফিলিস্তিনিদের উত্তেজনা ও সহিংসতা বেড়ে গেছে, বিশেষ করে লায়ন্স ডেন নামের একটি ফিলিস্তিনি গ্রুপের সাথে। আরবিতে গ্রুপটির নাম ‘আরীন আল উসুদ’।

সশস্ত্র আন্দোলনকারী নতুন এ গ্রুপটির উত্থান হয়েছে পশ্চিম তীরের উত্তরাঞ্চলীয় নাবলুস শহরের পুরনো অংশ থেকে।

ইসরাইলি সৈন্য ও বসতি স্থাপনকারীদের ওপর সম্প্রতি যে সব হামলা পরিচালিত হয়েছে, এই গ্রুপ তার পেছনে রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

এই গ্রুপের সদস্য ও সমর্থকরা মূলত তরুণ ফিলিস্তিনি এবং তারা দাবি করে গত কয়েক দশক ধরে যেসব দল বা গোষ্ঠী ফিলিস্তিনি রাজনীতিকে পরিচালনা করছে সেগুলোর সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

তাহলে এরা কারা এবং তাদের এই আবির্ভাব কতটা তাৎপর্যপূর্ণ?

‘ক্ষুদ্ধ ফিলিস্তিনি তরুণ’
পশ্চিম তীরের রামাল্লাহ শহর-ভিত্তিক হরাইজন সেন্টার ফর পলিটিক্যাল স্টাডিজ নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক ইব্রাহিম জিবরিল দালালশা বলেন, ‘লায়ন্স ডেন হচ্ছে একদল ক্ষুদ্ধ ফিলিস্তিনি তরুণের একটি গ্রুপ। এদের বেশিরভাগেরই বয়স ২০ বছর। পশ্চিম তীর অথবা গাজায় যে সব রাজনৈতিক দল আছে তারা এগুলোর কোনোটির সাথে জড়িত নয়। তারা হচ্ছে এমন একটি গ্রুপ যারা মূলত ইসরাইলি দখল দারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করার ওপর জোর দিচ্ছে।’

সশস্ত্র এ গ্রুপটি প্রধানত নাবলুস শহরে সক্রিয়, বিশেষ করে আল-ইয়াসমিনা এলাকায়।

গত কয়েক মাসে এই গ্রুপের সাথে যোগ দিয়েছে বহু ফিলিস্তিনি তরুণ।

যদিও বর্তমান কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে এই গ্রুপের আনুষ্ঠানিক কোনো সম্পর্ক নেই, তবে এর কিছু কিছু সদস্যের আগে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় রিচমন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দানা এল কুর্দ বলেন, ‘এটি একটি নির্দলীয় গ্রুপ, তারা একটি একক মিলিশিয়া বাহিনীর জন্য কাজ করছে, যদিও তাদের কেউ কেউ লায়ন্স ডেনে যোগ দেয়ার আগে বিশেষ কিছু গ্রুপের সাথে জড়িত ছিল। যেমন ইসলামিক জিহাদ অথবা আল-আকসা মার্টার্স ব্রিগেডস, হামাস অথবা ফাতাহ।‘

এই গ্রুপের শুরু যেভাবে
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথমে গ্রুপটির নাম ছিল ‘নাবলুস ব্যাটালিয়ন’। ওই সময় গ্রুপে ২০ জনের বেশি সদস্য ছিল না।

জেনিন শরণার্থী শিবিরে গড়ে ওঠা একটি সামরিক গ্রুপ জেনিন ব্যাটালিয়ন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গঠিত হয় এই নাবলুস ব্যাটালিয়ন।

ওই বছরের আগস্ট মাসে নাবলুসের একটি বাড়িতে ইসরাইলি সৈন্যদের অভিযানের সময় এই গ্রুপের শীর্ষস্থানীয় একজন যোদ্ধা ইব্রাহিম আল-নাবলুসিসহ তিনজন যোদ্ধা নিহত হন।

আল-নাবলুসিকে হত্যার পর এই গ্রুপের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

ধারণা করা হয়, গত বছরের গ্রীষ্মকালে লায়ন্স ডেন গ্রুপটি প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে। ইসরাইলি বাহিনীর হাতে নিহত যোদ্ধাদের স্মরণে নাবলুস শহরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই নামে গ্রুপটির আবির্ভাব ঘটে।

২০২৩ সালের শুরুর দিকে ইসরাইলি সেনাবাহিনী এই গ্রুপের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করে এবং হত্যা করে। ইসরাইলের পক্ষ থেকে এসব ফিলিস্তিনি যোদ্ধার বিরুদ্ধে তাদের টার্গেট করে হামলা পরিচালনার অভিযোগ আনা হয়।

এর পরেই এ সব যোদ্ধার ছবি ও ভিডিও সোশাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে টিকটকে।

এর কয়েক মাস পরে মুখোশ পরিহিত কয়েকজন বন্দুকধারী নাবলুসের ওল্ড সিটির অলিগলিতে সশস্ত্র মিছিল বের করে।

এই ঘটনায় ইসরাইল নিরাপত্তা বাহিনী ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।

দানা এল কুর্দ বলেন, ‘দণ্ড থেকে ইসরাইলিদের ধারাবাহিক অব্যাহতি, ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়ন, ইহুদি বসতিতে ইসরাইল তৎপরতা বেড়ে যাওয়া, এসব বিষয়ে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ভূমিকা দুর্বল হয়ে পড়া, অব্যাহত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অচলাবস্থা- এসব কিছুর কারণে এই গ্রুপের জন্ম হয়েছে।’

গ্রুপটির প্রতি কি জনসমর্থন আছে?
এল কুর্দ আরো বলেন, ‘গ্রুপটি ফিলিস্তিনি তরুণদের স্বপ্নকে ধরতে পেরেছে যারা বর্তমান অচলাবস্থা এবং ফাতাহ ও হামাস যে ধরনের পুরনো ধাঁচের রাজনীতি করে আসছে তাকে প্রত্যাখ্যান করে।’

ফিলিস্তিনিদের পক্ষ থেকে গ্রুপটির প্রতি যে উল্লেখযোগ্য সমর্থন রয়েছে তার কিছু প্রমাণও রয়েছে।

প্যালেস্টিনিয়ান সেন্টার ফর পলিসি অ্যান্ড সার্ভে রিসার্চ নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গত ডিসেম্বর মাসে পশ্চিম তীর ও গাজা ভূখণ্ডের বাসিন্দাদের ওপর যে জরিপ পরিচালনা করে তাতে দেখা যায় যে জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৭০ ভাগ লায়ন্স ডেনের মতো একটি স্বাধীন সশস্ত্র গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করাকে সমর্থন করে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বয়স্ক ফিলিস্তিনি নেতৃত্বও এর পেছনে একটি কারণ যার ফলে ফিলিস্তিনি তরুণরা সশস্ত্র এই প্রতিরোধ গ্রুপটির দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে।

এই গ্রুপের অনেক সদস্য ঘোষণা করেছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

ইব্রাহিম দালালশা বলেন, ‘তারা বিশ্বাস করে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। তারা এটাও বিশ্বাস করে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবে না। এ কারণে তারা প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিতে চায়, এই সঙ্ঘাতের সমাধান নিয়ে আসবে।’

গ্রুপটি সামাজিক মাধ্যমেও জনপ্রিয়। লায়ন্স ডেনের টেলিগ্রাম চ্যানেলে তারা যখনই কোনো আহ্বান জানায়, শত শত ফিলিস্তিনি তাতে সাড়া দিয়ে থাকে। এই চ্যানেলের ফলোয়ারের সংখ্যা এক লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি।

এই চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবারদের আহ্বান জানানো হয় ইসরাইলি টার্গেটে হামলার প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে বাড়ির ছাদে গিয়ে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে তাকবির দেয়ার জন্য।

এর পর পশ্চিম তীর এবং অধিকৃত পূর্ব জেরুসালেমে তরুণ ফিলিস্তিনিরা ‘ডেন অপরাজিত’ বলে স্লোগান দেয়।

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সাথে সম্পর্ক কেমন?
ইসরাইল ও প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও’র মধ্যে স্বাক্ষরিত অসলো শান্তি চুক্তির অংশ হিসেবে গঠিত স্বায়ত্তশাসিত ফিলিস্তিনি অঞ্চল পশ্চিম তীর পরিচালনা করে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ।

ফিলিস্তিনি শহর ও গ্রামগুলো মূলত তারাই শাসন করে থাকে। এই ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষে রয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ ফাতাহ গ্রুপের আধিপত্য।

এর বাইরে আরেকটি গ্রুপ হামাস গাজা ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে এবং পশ্চিম তীরে তাদের তেমন একটা প্রাধান্য নেই।

১৯৯৩ সালে যখন অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তখন নবগঠিত এই সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গ্রুপ লায়ন্স ডেনের বহু সদস্যের জন্মই হয়নি।

দালালশা বলেন, ‘ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এবং শাসক ফাতাহ দলের মূলধারার নেতৃত্ব নানা কারণেই এই গ্রুপটির ব্যাপারে খুশি নয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমার মনে হয় শক্তি প্রয়োগ করে গ্রুপটিকে ভেঙে দেয়ার পরিবর্তে, তাদের সাথে সহযোগিতার কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’

বেসরকারি সূত্রগুলো বলছে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গ্রুপটিকে বোঝাতে চেষ্টা করছে তারা যেন সশস্ত্র সংগ্রাম বাদ দিয়ে ফিলিস্তিনি নিরাপত্তা বাহিনীতে যোগ দেয়।

লায়ন্স ডেনের কিছু কিছু সদস্যকে তারা বোঝাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এই গ্রুপের নেতারা তাদের অস্ত্র সমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। বরং বলেছে শেষ পর্যন্ত তারা তাদের লড়াই অব্যাহত রাখবে।

ইব্রাহিম দালালশা বলেন, ‘লায়ন্স ডেনের কিছু সদস্য হয়তো সমালোচনা করবে, কিন্তু তারা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সাথে সঙ্ঘাতে জড়িত হওয়া থেকে বিরত থাকবে। আপনি যদি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে চলে যান, তাহলে আপনি সমগ্র ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে না হলেও, এর বড় একটা অংশের সাথে সরাসরি সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়বেন। আমার মনে হয় তারা এই পরিস্থিতি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।’

ইসরাইল কী বলছে?
ইসরাইল লায়ন্স ডেন গ্রুপটিকে দেখে একটি ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে।

এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ইসরাইল নিরাপত্তা বাহিনী নাবলুস শহরে ঢুকে ১১ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে, যাদের ছয়জন এই লায়ন্স ডেন গ্রুপে সদস্য বলে গ্রুপটির টেলিগ্রাম চ্যানেলে করা এক পোস্টে দাবি করা হয়েছে।

চার ঘণ্টা ধরে চলা এই অভিযানের পর ইসরাইল প্রতিরক্ষা বাহিনী বলেছে, ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীরা তাদের সৈন্যদের ওপর গুলি চালানোর পর তারা এই অভিযান চালিয়েছে।

ইসরাইল প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) একজন মুখপাত্র লে. কর্নেল রিচার্ড হেক্ট সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা হুমকি দেখতে পাই এবং আমাদের ভেতরে গিয়ে কাজ শেষ করতে হয়েছে।’

ইসরাইল সম্প্রতি নাবলুস এবং পূর্ব জেরুসালেমের চারপাশের কিছু এলাকায় বালির বস্তা ও সিমেন্টের ব্লক ফেলে যাতায়াত বন্ধ করে দেয়।

দানা এল কুর্দ বলেন, ‘ইসরাইল যেভাবে সাড়া দিয়েছে সেটা বেশ গুরুতর, তবে তারপরেও লায়ন্স ডেনের প্রভাব থাকবে এবং এই গ্রুপে যোগ দেয়ার ব্যাপারে তারা উৎসাহ যোগতে পারবে।’

ইব্রাহিম দালালশা মনে করেন, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের রাজনীতিতেও তারা হয়তো প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

তিনি মনে করেন, ‘তারা যে বড় উদ্দেশ্য অর্জন করতে চাচ্ছে সেটা হয়তো সহজ হবে না, তারা তো দখল দারিত্বের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে চায়। তবে আমি মনে করি তাদের অস্তিত্ব এবং তৎপরতা বিশৃঙ্খলার পাশাপাশি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও ইসরাইলের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।’

সূত্র : বিবিসি

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877