স্বদেশ ডেস্ক:
ভারতের অন্যতম বৃহৎ কোম্পানি আদানি গ্রুপের সাথে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক আর সমালোচনার মধ্যেই পরীক্ষামূলকভাব বাংলাদেশে আদানির বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয়েছে। ভারতের ঝাড়খণ্ডে নির্মিত আদানি পাওয়ার লিমিটেডের এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ প্রায় দেড় হাজার মোগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করবে।
আদানি চুক্তি বিরোধিতাকারীরা বলছেন, ২৫ বছর মেয়াদি এ চুক্তির মাধ্যমে মুনাফা বৃদ্ধির বিশেষ সুযোগ নিয়েছে ভারতীয় কোম্পানিটি। এই বিদ্যুৎ চুক্তিকে দেশের ‘স্বার্থবিরোধী’ হিসেবে উল্লেখ করে এটি সংশোধন, এমনকি বাতিলেরও দাবি তোলা হয়েছে।
আদানির বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে কয়লার মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি নিয়ে একটি সমস্যা চিহ্নিত হলে আদানি বিতর্ক সামনে আসে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড বা বিপিডিবি আপত্তি জানালে সেটি সমাধানে দুই পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনার কথা জানা গেছে।
আদানি ক্রয় চুক্তির এই সমস্যা কিভাবে সমাধান চাইছে বিপিডিবির ওই বিষয়ে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে আদানি পাওয়ার বিবিসিকে জানিয়েছে, বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি সংশোধনের জন্য বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড আদানির কাছে কখনো কোনো অনুরোধ করেনি।
চুক্তির সমস্যা কোথায়?
আদানির সাথে বিপিডিবির চুক্তি ২৫ বছরের। আদানির ক্রয় চুক্তির একটি কপি বিবিসির এই সংবাদদাতা দেখার সুযোগ পেয়েছে এবং একাধিক প্রকৌশলীর সাথে চুক্তির বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলা হয়েছে।
এই চুক্তি বিশ্লেষণ করে কয়েকটি বিষয় সামনে এসেছে, যেখানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরো সতর্ক হওয়া প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন বিদ্যুৎখাতের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা। এ চুক্তি সম্পাদনে বাংলাদেশের দিক থেকে ‘অভিজ্ঞতার ঘাটতি’ এবং ‘এক ধরনের চাপ’ থাকতে পারে বলেও বলছেন কেউ কেউ।
চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি হিসেবে আমদানি করা কয়লা ব্যবহার হবে। কিন্তু যে পদ্ধতিতে কয়লা আমদানি করা হবে, তাতে আমদানি খরচ বেশি দেখানোর সুযোগ রয়েছে।
পায়রা, রামপাল এবং এস আলম বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমদানি কয়লার সাথে তুলনা করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড আাদানির বিদ্যুতের কয়লার মূল্য নির্ধারণের পদ্ধতিতে আপত্তি তোলে। বিদ্যমান চুক্তি অনুযায়ী ইন্দোনেশিয়ার ইনডেস্ক আর অস্ট্রেলিয়ার নিউ ক্যাসল ইনডেস্ক গড় মূল্যে কয়লার দাম নির্ধারণ হবে।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম তামিম বিবিসিকে বলেন, এ পদ্ধতি মেনে নেয়া সম্ভব নয়। দীর্ঘমেয়াদী চুক্তিতে কেউ কখনো এত দাম দিয়ে কয়লা কেনে না। আমরা সেটা পায়রার ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি, আমরা রামপাল এবং এস আলম তিনটা ক্ষেত্রেই দেখতে পাচ্ছি। আমি মনে করি, আমাদের একটা বড় ভুল হয়ে গেছে। এটা আরো স্পেসিফিক হওয়া উচিৎ ছিল এবং দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির ব্যাপারটা ওখানে উল্লেখ করা দরকার ছিল।’
’কিন্তু সেটা খুব সিম্পল ভাষায় নিউক্যাসলের কয়লা ধরে আমাদের এই চুক্তিটা করা হয়েছে। এটা একটা বড় ধরনের ভুল হয়েছে। বাট দ্যাট ওয়াজ ও মিসটেক ডান ইন গুড ফেইথ। সেটা যদি আমরা চিন্তা করি সেটা কোনো অবস্থায় বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে আমি মনে করি।”
আদানিকে বাড়তি সুবিধা?
প্রথমত: বিনা দরপত্রে একতরফা সিদ্ধান্তে আদানির সাথে এ চুক্তি করা হয়েছে। এ চুক্তির ফলে আমদানি করা কয়লার মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি, ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ ও বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেশি হবে বলেই সমালোচনা হচ্ছে।
এই চুক্তির বিভিন্ন ধারা বিশ্লেষণ করতে বিদ্যুৎখাতের একাধিক প্রকৌশলীদের সাথে কথা বলেছেন বিবিসির সাংবাদিক। প্রকৌশলীদের মতে, ক্রয় চুক্তির বেশ কিছু ধারায় ‘সুক্ষভাবে’ আদানি মুনাফা বৃদ্ধির সুযোগ রেখেছে।
যেমন কয়লার মানের সাথে মূল্য নির্ধারণ ফর্মুলায় দাম বৃদ্ধির সুযোগ আছে। এছাড়া কয়লার হিট রেট বা তাপ উৎপাদন ক্ষমতা প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর ভেদে ২৩৯৬-২৬৯৩ পর্যন্ত আছে। এই হিট রেট দেশের অন্যান্য আমদানি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ একই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে আদানি বেশি কয়লা ব্যবহারের সুযোগ পাবে।
এছাড়া তৃতীয় পক্ষের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রির সুযোগ থাকলেও তার সুবিধা পিডিবি পাবে কিনা চুক্তিতে ওই বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন ক্ষমতার অন্তত ৩৪ ভাগ বিদ্যুৎ না নিলে কয়লার মূল্য পরিশোধ করতে হবে পিডিবিকে। এমন সুযোগ দেশের আমদানি করা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নেই বলেই জানা গেছে।
ক্রয় চুক্তির এসব শর্ত ও ধারাগুলো বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা হয়নি বলেই মনে করা হচ্ছে। এসব কারণে ক্যাপাসিটি চার্জ যেটি নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ মিলিয়ে বিদ্যুতের দামে যুক্ত হবে, সেটি কিভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, তা নিয়েও অস্পষ্টতা ও সন্দেহ করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ জ্বালানি খাত নিয়ে বাংলাদেশে ভোক্তাদের পক্ষে দীর্ঘ দিন কাজ করছেন এম শামসুল আলম। এ বিষয়ে আলম বলেন, ‘সরকার চাক আমরা আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিদর্শন করি, আমরা সেটি অনুসন্ধান করি। করে দেখাই। আমরা খুঁজে দেখি যে এসব অভিযোগের মেরিট আছে কি নেই। অভিযোগ উঠেছে। সেটা নিস্পত্তি হবে না কেন?
’অভিযোগ যে সব জায়গায় আদানি অস্বীকার করেছে, তাও নয়। ওই ব্যাপারগুলো নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ কোনো কনসার্ন দেখায়নি। দেখাচ্ছে না। এই বিষয়গুলো ধামাচাপা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।’
তিনি মনে করেন, চুক্তির দর কষাকষিতে বাংলাদেশ মোটেও লাভবান হয়নি। বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক পায়রা ও রামপাল বা এস আলমের সাথে চুক্তিও সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখা যায় না উল্লেখ করে আলম বলেন, পায়রা বা রামপালের চুক্তির চেয়েও আদানির চুক্তির শর্ত ‘দেশের স্বার্থ পরিপন্থী’।
কী বলছে আদানি?
বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি, এর সংশোধন ও বিতর্কের বিষয়ে আদানি পাওয়ারের সাথে যোগাযোগ করা হলে ইমেইলের মাধ্যমে বিবিসিকে জবাব দিয়েছে কোম্পানিটি। আদানি পাওয়ার দাবি করেছে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড আদানির সাথে চুক্তি সংশোধনের জন্য কখনো অনুরোধ করেনি। আদানি দাবি করছে, গণমাধ্যমে আদানির বিদ্যুৎ ও কয়লার দাম নিয়ে একটি মহল ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে। আদানি মনে করে, এ চুক্তি স্বচ্ছ ও তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশের জন্য লাভজনক।
আদানি জানিয়েছে, গোড্ডা থেকে বাংলাদেশের পায়রা, রামপাল ও এস আলমের চেয়ে প্রতিযোগিতামূলক দামে বিদ্যুৎ পাবে। যে দাম এসব কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের দামের সমান বা কম হবে।
মার্চ মাসে বাংলাদেশে যে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করছে, ওই দাম সম্পর্কেও একটি ধারণা দিয়েছে আদানি পাওয়ার। তাদের হিসেবে বর্তমান বাজারদর ও কয়লার মান অনুযায়ী প্রতি টন কয়লার মূল্য হবে ১৩৯ ডলার।
এতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জ্বালানি খরচ হবে ৯ দশমিক ৩৯ ইউএএস সেন্ট। এর সাথে ক্যাপাসিটি চার্জ ৪ দশমিক ২৪ ইউএস সেন্ট যোগ হবে। এই হিসেব করলে মার্চে আমদানি করলে আদানির প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে ১৫ টাকার মতো।
গণম্যাধ্যমে আসা তথ্যের কথা উল্লেখ করে আদানি পাওয়ার দাবি করছে যে তারা কখনোই পিডিবির কাছে কয়লার মূল্য টন প্রতি ৪০০ ডলার দাবি করেনি।
মার্চ মাসের কয়লার দাম নির্ধারণের ব্যাপারে বলা হয়েছে, কয়লার প্রকৃত কিলো ক্যালোরি বা মান অনুযায়ী দাম নেবে আদানি। বৈশ্বিক কয়লা মূল্যের সাথে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবহৃত কয়লার মান অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করা হবে।
উদাহারণ হিসেবে মার্চ মাসের কয়লার টন প্রতি দাম হিসেবের পদ্ধতি বিবিসিকে জানিয়েছে আদানি পাওয়ার। মার্চ ২০২৩-এ ৬৩৩২ কিলো ক্যালরি কয়লার ইন্দোনেশিয়ার (এইচবিএ) বেঞ্চমার্ক মূল্য ১৯৭ ডলার ঘোষণা করা হয়। আদানির বয়লারের জন্য ৪,৬০০ কিলো ক্যালোরি ভ্যালুর কয়লা প্রয়োজন। তাই মার্চে আদানির বিদ্যুতের কয়লার দাম পড়বে প্রতি টন ১৪৩ ডলার।
আদানির সাথে পিডিবি ক্রয় চুক্তি নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনার কথা জানা গেলে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ কী চাইছে, এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেয়নি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। তবে কয়লার মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতির সমস্যা স্বীকার করে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বিবিসিকে বলেছেন, দু’পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতার ব্যাপারে আশাবাদি বাংলাদেশ।
তিনি আরো বলেন, ‘এটা তো ব্যবসায়িক সম্পর্ক। সব সময় সংশোধন করা যায়, বদলানো যায়। এটা নিয়ে পাবলিকলি আমি খুব আলাপ করতে চাই না যে কী করব না করব। কিন্তু আমাদের মধ্যে আশা করি, অবশ্যই একটা সমঝোতা হবে, যেটা আমাদের দেশের জন্য ভালো হবে এবং যে কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে তাদের জন্য গ্রহণযোগ্য হবে। এটা আমি বিশ্বাস করি।’
সূত্র : বিবিসি