স্বদেশ ডেস্ক:
দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যে সংস্থার দায়িত্ব, সেই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তিন শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। ২০০৪ সালে কমিশন প্রতিষ্ঠার পর গত ১৮ বছরে এসব বিভাগীয় মামলা হয়। অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ায় এ সময়ের মধ্যে ৮০ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৪৪ জনকে গুরুদণ্ড ও ৩৬ জনকে লঘুদণ্ড দিয়েছে দুদক। একই সময়ে অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় প্রায় ২০০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
গুরুদণ্ডের (কঠোর সাজা) মধ্যে রয়েছে চাকরি থেকে অপসারণ, বাধ্যতামূলক অবসর, বেতনক্রমের নিম্নস্তরে বা ধাপে অবনতিকরণ ইত্যাদি সাজা। লঘুদণ্ডের মধ্যে রয়েছে তিরস্কার, পদোন্নতি বা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখা ইত্যাদি।
দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, কেউ যদি অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে যায় তার বিরুদ্ধে কমিশন আইন অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, সেটা সবার কাম্য। তবে চাকরি বিধির ৫৪(২) ধারায় কাউকে অপসারণ করা হলে তার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকে না, যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই বিধি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন তারা। দুদক সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ গত ২০২২ সালে দুদকে বিভাগীয় মামলা হয়েছে ১৮টি। একই বছর মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ৫টি। এতে ১ জনকে গুরুদণ্ড এবং ৩ জনকে লঘুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরও ১টি বিভাগীয় মামলা বিকল্পভাবে নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এর আগে ২০২০ ও ২০২১ সালে বিভাগীয়
মামলায় হয় ৩০টি। নিষ্পত্তি হয়েছে ৯টি। ওই দুই বছর কোনো গুরুদণ্ড দেওয়া না হলেও ২ জনকে লঘুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাকি ৭টি বিভাগীয় মামলা অন্যভাবে নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
এর আগের বছর ২০১৯ সালে বিভাগীয় মামলা হয়েছে ৩৬টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ৯টি। এর মধ্যে গুরুদণ্ড ২টি, লঘুদণ্ড ১টি এবং অন্যভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে বাকি ৬টি। ২০১৮ সালে বিভাগীয় মামলা হয়েছিল ১৬টি, একই বছর নিষ্পত্তি হয় ৮টি। এর মধ্যে ৩ জনের কঠোর সাজা, ১ জনের স্বল্পমাত্রার সাজা। অন্যভাবে নিষ্পত্তি হয় বাকি ৪টি অভিযোগ।
২০১৭ সালে বিভাগীয় মামলা হয়েছিল ২৫টি। একই বছর নিষ্পত্তি হয়েছে ১৩টি অভিযোগের, এর মধ্যে ১ জনের গুরুদণ্ড, ২ জনের লঘুদণ্ড হয়। এ ছাড়া বাকি ১০টি অভিযোগ অন্যভাবে নিষ্পত্তি হয়। এর আগের বছর ২০১৬ সালে ২৬টি বিভাগীয় মামলা হয়েছিল। একই বছর নিষ্পত্তি হয়েছিল ৪৬টি। এর মধ্যে গুরুদণ্ড ২ জনের এবং লঘুদণ্ড হয়েছিল আরও ২ জনের। বাকিগুলো অন্যভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে।
দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ‘যে কোনো দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে এমনকি অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন সচেষ্ট। কমিশনের একটি স্থায়ী অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি দমন কমিটি রয়েছে। দুদকের কোনো কর্মী আইনসম্মত আদেশ পালনে ব্যর্থতা বা অন্য কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার মতো অভিযোগ এলে কমিশন গুরুত্বের সঙ্গে নির্ধারিত আইনি পন্থায় ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। এ ধরনের অভিযোগ এলে বা কমিশনের নিজস্ব উদ্যোগে জানতে পারলে সেসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে।’
দুদক জানায়, গোয়েন্দা তথ্য ও আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হয়ে থাকে। ‘দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা-২০০৮’-এ বলা আছে, দুদকের কর্মীরা বিশ^স্ততা, সততা ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে কমিশনের চাকরি করবেন এবং ক্ষমতার কোনোরূপ অপব্যবহার করবেন না।’ বিধিমালায় আরও বলা হয়েছে, ‘কোনো কর্মচারীর আইনসম্মত আদেশ পালনে ব্যর্থতা বা অনীহা এবং চারিত্রিক স্খলন (ঘুষ গ্রহণ, অনৈতিক বা অসামাজিক কার্যকলাপ ইত্যাদি) বিষয়ক আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না এবং এসব ক্ষেত্রে কঠোরতম ও দ্রুততম শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
তবে দুদক (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালার ৫৪(২) ধারাকে বিতর্কিত বিধি হিসেবে অবহিত করেছেন সংস্থাটির কর্মকতা-কর্মচারীরা। দুদক প্রতিষ্ঠান পর এখন পর্যন্ত বিতর্কিত বিধি ৫৪(২) তে তিনজনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এই বিধিতে বলা হয়েছে, এই বিধিমালার ভিন্নরূপ যা থাকুক না কেন, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কোনো কারণ না দর্শিয়ে কোনো কর্মীকে ৯০ দিনের নোটিশ প্রদান করে বা ৯০ দিনের বেতন নগদ পরিশোধ করে তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করতে পারবে। এই বিতর্কিত ধারায় সর্বশেষ গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করে কমিশন। ওই সময় এ ঘটনায় সারাদেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
চাকরি থেকে অপসারণের পেছনে শরীফের দাবি, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রভাবশালীদের রোষানলে পড়ে তাকে চাকরি হারাতে হয়েছে। তবে তখন দুদক অভিযোগ করেছিল, শরীফ উদ্দিনকে ‘শৃঙ্খলা ও সুষ্ঠু কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থে’ বিধি মোতাবেক চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। শরীফকে চাকরিচ্যুত করার পরের দিন কমিশনের সেই আদেশ প্রত্যাহার ও ৫৪(২) বিধি বাতিলের দাবিতে দুদক সচিবকে স্মারকলিপি দেন কমিশনের কর্মকর্তারা। পাশাপাশি দুদকের প্রধান কার্যালয়সহ সংস্থাটির অন্যান্য দপ্তরে মানববন্ধন হয়। সারাদেশে আলোচনার মধ্যে গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে ‘দুদক সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি সংগঠন গঠিত হয়।
এরপর দুদক কর্মচারী বিধিমালার ৫৪(২) বিধি এবং এ বিধির ক্ষমতাবলে চাকরিচ্যুতির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে গত ১৩ মার্চ শরীফ হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট রিটের শুনানি নিয়ে গত বছরের ২৪ মে শুনানি মুলতবি করে আদেশ দেন।
এর আগে ২০০৮ সালের দুদক (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালার ৫৪(২) বিধি অনুসারে দুদকের উপপরিচালক মো. আহসান আলীকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছিল। এরপর ৫৪(২) বিধির বৈধতা নিয়ে আহসান আলী রিট করেন। চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ২০১১ সালের ২৭ অক্টোবর হাইকোর্ট এ বিধি বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে দুদক লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করে, যা ২০১৬ সালের নভেম্বরে খারিজ হয়। এর বিরুদ্ধে পরের বছর দুদক পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করে। এর শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগ ২০২১ সালের ২৮ নভেম্বর দুদককে আপিল করার অনুমতি দেন। আর এই আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করা হয়। গত বছর দুদক আপিল করে।
অন্যদিকে শরীফের করা রিটের শুনানিতে দুদকের আপিলের প্রসঙ্গ ওঠে। শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট ওই আপিলের (দুদকের করা) নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ৫৪(২) বিধি চাকরিচ্যুতির বৈধতা নিয়ে শরীফের করা রিটের শুনানি মুলতবি করেন। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে শরীফ গত বছরের ১৬ জুন আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করেন। এরপর শরীফের লিভ টু আপিল ও দুদকের করা আপিল একসঙ্গে শুনানির সিদ্ধান্ত নেয় আপিল বিভাগ। গত ৯ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে শুনানি জন্য নির্ধারিত থাকলে সেদিন শুনানি হয়নি। আগামী সপ্তাহে এ বিষয়ে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
চাকরি বিধিমালার ৫৪(২) বিধি বাতিলে দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, ‘এ বিষয়টি এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। বিচারাধীন বিষয়ে নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। তবে আদালত যে নির্দেশনা দেবেন তা কমিশন অবশ্যই পালন করতে বাধ্য। আমরা এখন উচ্চ আদালতের নির্দেশনার দিকে তাকিয়ে আছি।’ দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনার দিকে তাকিয়ে আছেন।