স্বদেশ ডেস্ক:
রেন্টাল, কুইকরেন্টালসহ বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরা বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) নিকট ২০ হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এ ছাড়াও পিডিবির নিকট সরকারের অন্যান্য কোম্পানিরও প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বকেয়া আছে। সময়মতো বকেয়া পরিশোধ করতে না পারলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে প্রতিবছর মার্চ থেকে জুনে কৃষি সেচ ও রমজানে বিদ্যুতের চাহিদা থাকে সর্বোচ্চ। ফলে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের পাওনা টাকা এবং জ্বালানি তেল আমদানি নিশ্চিত করতে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বিদ্যুৎ বিল বাবদ অগ্রিম টাকা আদায় করছে পিডিবি।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ইতোমধ্যে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির কাছ থেকে এপ্রিল মাসে বিদ্যুৎ বিল বাবদ প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা অগ্রিম আদায় করেছে সংস্থাটি। সম্প্রতি বিদ্যুৎ সচিবের সভাপতিত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আন্তঃসংস্থা দেনা-পাওনা নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আইপিপি ও সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোর উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে জ্বালানির জোগান নিশ্চিত করা জরুরি। বিশেষ করে চলতি মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় জ্বালানির আমদানি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না আর্থিক সংকটের কারণে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এপ্রিল-২০২২ সালের সমপরিমাণ ৬৪৩ কোটি টাকার বিলের বিপরীতে এ পর্যন্ত ৩২৭ কোটি টাকা পিডিবিকে অগ্রিম দিয়েছে ডিপিডিসি, ডেসকো ৪১২ কোটি টাকার বিপরীতে দিয়েছে ৩০০ কোটি টাকা, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বাপবিবো) ১৯৫৩ কোটি টাকার বিপরীতে দিয়েছে ১৩৪৮ কোটি টাকা, ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) দিয়েছে ২০৫ কোটি টাকা, নর্দার্ন ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) ২০৮ কোটি টাকা দিয়েছে।
ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান আমাদের সময়কে বলেন, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা অগ্রিম টাকা পরিশোধ করছি। এ টাকা পরবর্তী সময়ে বিদ্যুৎ বিলের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. কাওসার আমীর আলী আমাদের সময়কে বলেন, বিশ্বে জ্বালানির বাজারে অস্থিরতা চলছে। আমরা পিডিবির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনে গ্রাহকের কাছে বিক্রি করি। আসন্ন গ্রীষ্মে প্রয়োজনীয় জ্বালানির জোগান নিশ্চিত করতে পিডিবিকে আমরা অগ্রিম অর্থ পরিশোধ করেছি।
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বিতরণ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমাদের সময়কে বলেন, পিডিবির প্রচণ্ড আর্থিক সংকট চলছে। বেসরকারি গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিলের টাকা পরিশোধ করতে অগ্রিম টাকা গ্রহণ করছে। তবে সামনের দিনগুলোতে যখন বিতরণ কোম্পানিগুলো তাদের উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ করবে, তখন হিমশিম খাবে। সাময়িক হয়তো অগ্রিম টাকা পরিশোধ করতে পেরেছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। তবে এটা সামনে কঠিন হবে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বিক্রির মধ্যে ফারাক থাকায় বছরের পর বছর লোকসান গুনছে পিডিবি। এ লোকসানের অজুহাতে গত ১৪ বছরে পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ১১ বার, আর খুচরা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে অন্তত ১২ বার। দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েও পিডিবির লোকসান কমানো যাচ্ছে না। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির দায় এখন ক্রেতাসাধারণের ওপর পড়ছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবারও খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে।
দফায় দফায় দাম বৃদ্ধি নিয়ে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে একটি ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বিশেষ আইন’ করেছে। এই আইনের অধীনে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। বিদ্যুতের ক্রয়প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন হচ্ছে। সাধারণ মানুষ মনে করে, এই আইনের অধীনে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া বিদ্যমান। যার কারণে বেশি ব্যয়ে কেনাকাটা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে। যার দায়ভার মানুষের ওপর পড়ছে। এ প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে আসা উচিত। স্বচ্ছ ক্রয়প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত না হলে পিডিবিও তাদের লোকসান থেকে বের হতে পারবে না। দামও বাড়তেই থাকবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, আমরা অনেক আগেই বলেছি যে, ভুল পরিকল্পনা এবং নানা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। ফলে বারবার দাম বাড়ানো হচ্ছে। মানুষের ওপর বোঝা চাপানো হচ্ছে। পিডিবি বারবার লোকসানের অজুহাতে দাম বাড়াচ্ছে। আর পিডিবির দাম বাড়ানোর অজুহাতে বিতরণ কোম্পানিগুলো দাম বাড়াচ্ছে। তিনি বলেন, এই দফাই শেষ নয়। এ দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে।