শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪৯ অপরাহ্ন

ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে যেভাবে জড়িয়ে গেছে পুতিনের ভাগ্য

ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে যেভাবে জড়িয়ে গেছে পুতিনের ভাগ্য

স্বদেশ ডেস্ক:

এক বছর আগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন ইউক্রেনে তার বাহিনী পাঠান, তখন অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করেছিলেন— অল্প সময়ের মধ্যে লক্ষ্য অর্জন করবে মস্কো। এমনকি পুতিন প্রশাসনও প্রত্যাশা করেছিল— এক সপ্তাহ কিংবা সর্বোচ্চ এক মাসের মধ্যে ইউক্রেনে তাদের লক্ষ্য অর্জিত হবে।

রাশিয়ার সাফল্যের ব্যাপারে প্রাথমিক সেই ভবিষ্যদ্বাণীগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। এর পেছনে ইউক্রেনীয়দের উচ্চতর মনোবল এবং সামরিক কৌশলসহ বিভিন্ন কারণ, বিশেষ করে পশ্চিমা অস্ত্র সরবরাহকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিবিসি জানিয়েছে, ইউক্রেনের ওপর ভ্লাদিমির পুতিনের চালানো হামলা প্রতিবেশি দেশটিতে মৃত্যু ও ধ্বংস ডেকে এনেছে। এমনকি তার নিজের দেশের সেনাবাহিনীতেও ব্যাপক প্রাণহানি হয়েছে। কেউ কেউ অনুমান করে, হাজার হাজার রুশ সৈন্য এই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে।

কয়েক লাখ রুশ নাগরিককে সে দেশের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছে এবং রুশ বন্দিদের, এমনকি দোষী সাব্যস্ত সাজাপ্রাপ্তদেরও ইউক্রেনে যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়েছে।

ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী জ্বালানি ও খাদ্যদ্রব্যের দামের ওপর এই যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে। এছাড়াও এই যুদ্ধ ইউরোপ এবং বিশ্ব নিরাপত্তার প্রতি হুমকি তৈরি করেছে।

তাহলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট কেন এই যুদ্ধে জড়ালেন? কেন ওই অঞ্চলে তার বিজয় পতাকা তুলতে তিনি এত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন? এ নিয়ে বিশ্লেষনমূলক একটি আর্টিকেল লিখেছেন বিবিসির রাশিয়া সম্পাদক স্টিভ রোজেনবার্গ।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী একাতেরিনা শুলমান বলছেন, ২০২৪ সালে রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আসছে। ওই নির্বাচনের দুবছর আগে ক্রেমলিন চেয়েছিল কোন একটা বিজয়ের ঘটনা। তাদের লক্ষ্য ছিল ২০২২ সালে সেই বিজয় অর্জন। তারা চেয়েছিল ২০২৩ সালে রুশদের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল করে দিতে যে, রুশদের ভাগ্য কত ভাল যে পুতিনের মত সুদক্ষ একজন ক্যাপ্টেন জাহাজের স্টিয়ারিং হুইল নিজের হাতে ধরে রেখেছিলেন।

এই বিশ্লেষক বলেন, তিনি শুধু অসন্তোষের উত্তাল সমুদ্রই পাড়ি দেননি, তিনি তার জাহাজকে আরও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে গিয়ে নতুন এক বন্দরে সেই জাহাজ ভিড়িয়েছেন। এই কথার পর রুশ জনগণ তো তাকেই ভোট দেবে। ব্যস্! পাক্কা পরিকল্পনা। কোথাও ভুল হবার সুযোগ কি আছে?

কিন্তু সুযোগ আছে অনেক, মনে করেন এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। তিনি বলছেন, ভুল হিসাব আর ভুল অনুমানের ভিত্তিতে পরিকল্পনা তৈরি করা হলে সে পরিকল্পনা সফল না হবার অনেক সুযোগই থেকে যায়।

ক্রেমলিন আশা করেছিল, তাদের ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ বিদ্যুতগতিতে এগোবে। তারা আশা করেছিল, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই রাশিয়া ইউক্রেনকে কব্জা করে ফেলবে। ইউক্রেন যে প্রতিরোধ গড়ে তোলার এবং লড়াই করার ক্ষমতা দেখাবে, সেটা বুঝতে বড়রকমের ভুল করেছিলেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। তিনি এটাও আন্দাজ করতে পারেননি যে কিয়েভকে সমর্থন জোগাতে পশ্চিমা দেশগুলো এতটা বদ্ধপরিকর হবে।

রুশ নেতা অবশ্যও এখনও এটা স্বীকার করতে নারাজ যে ইউক্রেন আক্রমণ করে তিনি ভুল করেছেন। পুতিনের পথ হল এগিয়ে যাওয়া, আক্রমণের তীব্রতা বাড়ানো এবং একই সঙ্গে আরও ঝুঁকি নেওয়া।

এই পটভূমিতে দুটো প্রশ্ন এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এক বছর পর পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন পুতিন? আর দ্বিতীয়ত, ইউক্রেনে তার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে?

গত সপ্তাহে পুতিন এ বিষয়ে কিছু ইঙ্গিতও দিয়েছেন।

জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া তার বার্ষিক ভাষণের বেশিরভাগটা জুড়েই ছিল পশ্চিমের দেশগুলোর প্রতি তার বিষোদ্গার। তিনি ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য দায়ী করেছেন আমেরিকা এবং ন্যাটো জোটকে।

তিনি বলেছেন এই যুদ্ধে রাশিয়া নির্দোষী ভূমিকা পালন করেছে।

রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নিউ স্টার্ট নামে যে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি হয়েছিল তার বাকি মেয়াদকাল পুরো করার আগেই রাশিয়ার এই চুক্তি থেকে প্রত্যাহারের যে সিদ্ধান্ত পুতিন ঘোষণা করেছেন, তা থেকে মনে হচ্ছে প্রেসিডেন্ট পুতিনের এই যুদ্ধ বন্ধের কোন আকাঙ্ক্ষাই নেই অথবা পশ্চিমের সঙ্গে অচলাবস্থা নিরসনের কোন আগ্রহই তার নেই।

ওই ভাষণের পরদিন মস্কোর এক ফুটবল স্টেডিয়ামে, পুতিন ইউক্রেনের সম্মুখ রণাঙ্গন থেকে ফিরে আসা রুশ সেনাদের সঙ্গে এক মঞ্চে উপস্থিত হন।

ক্রেমলিনের সমর্থনে খুবই পরিকল্পনা মাফিক আয়োজন করা এক সমাবেশে জনতার উদ্দেশ্যে পুতিন বলেন, ‘রাশিয়ার ঐতিহাসিক সীমান্তে এই মুহূর্তে লড়াই চলছে’ এবং রাশিয়ার সাহসী যোদ্ধাদের তিনি প্রশংসা করেন।

ওই ভাষণের উপসংহার ছিল এরকম: ক্রেমলিন তার লক্ষ্য পাল্টাবে এমনটা আশা করো না। এই রুশ প্রেসিডেন্ট তার লক্ষ্যে অটল।

প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা আন্দ্রেই ইলারিওনফ মনে করেন, তাকে বাধা না দিলে, তিনি যতদূর যাওয়া সম্ভব যাবেন। সামরিকভাবে প্রতিহত করা ছাড়া অন্য কোনভাবে তাকে থামানো সম্ভব নয়।

কিন্তু ট্যাংক নিয়ে আলোচনার কোন সুযোগ কি আছে? পুতিনের সঙ্গে শান্তি আলোচনা কি সম্ভব?

আন্দ্রেই ইলারিওনফ বলেন, যে কারো সাথে আলোচনায় বসা সম্ভব। পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় বসার ঐতিহাসিক রেকর্ডও রয়েছে এবং তার সাথে নানা চুক্তিও হয়েছে।

কিন্তু ২০২৩ সালের পুতিন খুবই ভিন্ন এক মানুষ। ‘পশ্চিমা জোটের’ বিরোধিতায় সোচ্চার পুতিন নিজেকে এখন তুলে ধরছেন অবরুদ্ধ এক দুর্গের নেতা হিসাবে।

রাশিয়ার শত্রুরা তার দেশকে ধ্বংস করার উদ্যোগ নিয়েছে বলে অভিযোগ তুলে তিনি বলছেন রাশিয়া তা প্রতিহত করছে।

তার ভাষণ এবং বক্তব্যে পিটার দ্য গ্রেট বা ক্যাথরিন দ্য গ্রেট-এর মত সাম্রাজ্যবাদী রুশ শাসকদের কথা তিনি যেভাবে উল্লেখ করছেন, তার থেকে মনে হয় পুতিন বিশ্বাস করেন যে রুশ সাম্রাজ্যকে কোন না কোনভাবে আবার প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব তারই কাঁধে।

কিন্তু এর জন্য কী মূল্য দিতে হবে রাশিয়াকে? দেশে স্থিতিশীলতা আনার জন্য একসময় মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন পুতিন।

কিন্তু সেনা অভিযানে হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি, যুদ্ধে সৈন্য মোতায়েন এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার যাঁতাকলে পড়ে সেই জনপ্রিয়তা তিনি হারিয়েছেন।

ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে কয়েক লক্ষ রাশিয়ান দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন- এদের অধিকাংশই তরুণ, কর্মদক্ষ এবং শিক্ষিত: এই মেধাশক্তি হারানোর ফলে রুশ অর্থনীতি আরও ক্ষতির মুখে পড়তে চলেছে।

রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ওয়াগনার গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব থেকে বোঝা যায় ওপরের তলার মানুষদের মধ্যে কোন্দলের বিষয়টা এখন প্রকাশ্যে চলে আসছে।

একদিকে অস্থিতিশীলতা, অন্যদিকে বেসামরিক সেনাবাহিনীর উত্থান খুবই বিপজ্জনক একটা সংমিশ্রণ।

এ সপ্তাহে রুশ সংসদের নিম্ন কক্ষের স্পিকার ঘোষণা করেছেন, যতদিন পুতিন ক্ষমতায় থাকবেন, ততদিন রাশিয়া টিকে থাকবে।

এটা আনুগত্যের বক্তব্য। এর কোন তথ্যগত ভিত্তি নেই।

তবে রাশিয়া টিকে থাকবে। বহু শতাব্দী ধরেই রাশিয়া টিকে আছে। কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিন টিকে থাকবেন কিনা তা এখন প্রশ্নের মুখে। তার ভাগ্য এখন জড়িয়ে গেছে ইউক্রেন যুদ্ধের শেষ কোথায় এবং কীভাবে হয় তার সঙ্গে।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877