স্বদেশ ডেস্ক:
আগামী ২০২৪ শিক্ষাবর্ষে আরো চারটি শ্রেণীতে সংযোজন হচ্ছে নতুন পাঠ্যসূচি। এরই মধ্যে নতুন এই পাঠ্যসূচির পাণ্ডুলিপিও প্রস্তুত করা শুরু হয়েছে। তবে অনেকটা গোপনেই লেখা হচ্ছে পাঠ্যসূচির বিষয়বস্তু। ধারণা করা হচ্ছে চলতি বছরের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর নতুন পাঠ্যসূচির দু’টি বই নিয়ে যেভাবে বিতর্ক হয়েছে শিক্ষার্থী অভিভাবক ও শিক্ষাবিদদের অগোচরে নতুন পাঠ্যসূচি চালু হলে অনুরূপভাবে দেশজুড়ে বিতর্ক তৈরি হতে পারে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে অগোচরে বা কাউকে না জানিয়ে নতুন পাঠ্যসূচির পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করা হবে না । বরং সবাইকে জানিয়ে এবং সবার মতামত নিয়েই নতুন বছরের নতুন পাঠ্যসূচির বই শিক্ষার্থীদের হাতে দেয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রথম শ্রেণী এবং মাধ্যমিক বা হাইস্কুল পর্যায়ে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে নতুন পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা হয়। নতুন এই পাঠ্যসূচি নিয়ে শুরু থেকেই নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত তুমুল বিতর্কের মুখে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর দু’টি বই প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। অপরদিকে নবম শ্রেণীর দু’টি বইয়ের বেশ কিছু ভুল ও অসঙ্গতির বিষয়ে সংশোধনীও দিয়েছে এনসিটিবি।
এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, আগামী শিক্ষাবর্ষে (২০২৪ সালে) প্রাথমিকের দু’টি শ্রেণীতে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় এবং মাধ্যমিকের দু’টি শ্রেণী যথাক্রমে অষ্টম ও নবম শ্রেণীতে নতুন পাঠ্যসূচি নিয়ে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার জন্য পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করা হচ্ছে। এর আগে চলতি শিক্ষাবর্ষে (২০২৩ সালে) প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম এই তিনটি শ্রেণীতে নতুন পাঠ্যসূচি চালু করা হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকের সব শ্রেণীতেই নতুন পাঠ্যসূচি নিয়ে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে প্রথম বছরেই অর্থাৎ ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের দু’টি শ্রেণীর বিতর্কিত দু’টি বই নিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়েছে এনসিটিবি। এখন যদি আগামী শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যসূচি নিয়ে আগেই সব মহলের মতামত না নিয়ে বরং একতরফাভাবে চাপিয়ে দেয়া হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই এটি নিয়েও আগামীতে প্রশ্ন উঠবে বিতর্ক তৈরি হবে। কেননা এখনো কেউই জানেন না নতুন পাঠ্যসূচিতে কি কি বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে।
আগামী শিক্ষাবর্ষের নতুন পাঠ্যসূচির বিষয়ে গতকাল রোববার সন্ধ্যায় এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম নয়া দিগন্তের এই প্রতিবেদককে জানান, কাউকে না জানিয়ে পাঠ্যসূচির পাণ্ডুলিপি তৈরি করা হচ্ছে বিষয়টা এমন নয়। কেননা আমরা পাণ্ডুলিপির খসড়া তৈরি হওয়ার পর সেগুলো সবার মতামতের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করব। কোনো আপত্তি বা সংশোধন থাকলেও আগেই সেগুলো আমলে নিয়ে তারপরেই বই ছাপার কাজে হাত দেবো।
তিনি আরো জানান, আমরা প্রথমে দ্বিতীয় তৃতীয় এবং অষ্টম শ্রেণীর জন্য নতুন পাঠ্যসূচি দেয়ার চিন্তা করেছিলাম। এখন ভাবছি নবম শ্রেণীর জন্যও নতুন পাঠ্যসূচি দেয়া যায় কিনা। তবে একটি কথা পরিষ্কার এবার আর কোনো বিতর্কের সুযোগ থাকবে না। কারণ বই ছাপার কাজ শুরু করার আগেই পাণ্ডুলিপিতেই সবার মতামত নিয়ে সেটি আমরা চূড়ান্ত করব।
পাঠ্যক্রম বিতর্ক : ২০২৩ সালের পাঠ্যবই নিয়ে নানা ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এতে বলা হয়, ২০২৩ সালে চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে লেখা সপ্তম শ্রেণীর বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের কোনো কোনো অধ্যায়ের অংশবিশেষ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এডুকেশনাল সাইট থেকে নিয়ে হুবহু অনুবাদ করে ব্যবহার করা হয়। বইয়ের এই নির্দিষ্ট অংশের সাথে ওয়েবসাইটটির একই লেখা তুলনা করে অভিযোগটির সত্যতা পাওয়া যায়। একই বইয়ে মঙ্গলগ্রহের লাল রঙের বর্ণনায় ফেরিক অক্সাইডকে তুলে ধরা হলেও মঙ্গলগ্রহের সাথে যৌগিক পদার্থের সম্পর্ক ঠিক কী তা শিক্ষার্থীদের কাছে অস্পষ্টই রয়েছে। তবে নাসার বর্ণনা থেকে জানা যায়, মঙ্গল গ্রহকে লাল গ্রহ নামে ডাকার জন্য এর পারিপার্শ্বিক পরিবেশে আয়রন অক্সাইডের উপস্থিতি, অন্যান্য খনিজ উপাদানের প্রভাব গ্রহটিকে বর্ণিল করে তুলে।
নবম-দশম শ্রেণীর বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের ১৬ পৃষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান নিয়ে ভুল তথ্য দেয়া হয়। ঢাকার রাজারবাগকে পুলিশ ক্যাম্প ও পিলখানাকে ইপিআর ক্যাম্প বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং পিলখানা ইপিআরের সদর দফতর উল্লেখ করা হয়নি। আবার ৬ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয় চারটি দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল মূলত পাঁচটি দল নিয়ে। এখান থেকে বাদ পড়ে খেলাফতে রব্বানী পার্টির নাম।
নবম শ্রেণীর বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা বইয়ে রয়েছে অনেক তথ্যগত অসঙ্গতি। ১৮১ পৃষ্ঠায় বলা হয়, ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশজুড়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নির্যাতন, গণহত্যা আর ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে পাক হানাদার বাহিনী আক্রমণ শুরু করে ২৫ মার্চ রাত থেকেই। একই বইয়ে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে সময় প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের কাছে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। আসলে প্রধান বিচারপতি নয়, হওয়ার কথা প্রধানমন্ত্রীকে শপথ পড়ান রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। ২০২২ সালে মাধ্যমিকের ১০টি বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে ২৫টির মতো তথ্য ভুল, অসঙ্গতি, ইংরেজি শব্দের সাথে অর্থের অমিল ও বানান ভুল ধরা পড়ে।
মাধ্যমিকের পৌরনীতি ও নাগরিকতা বইয়ে আইনের প্রকারভেদের আলোচনায় ব্যক্তিগত আইন বলে এক ধরনের আইনের কথা বলা হয়েছে, যা নিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়নি। আবার বইয়ের ৬৩ পৃষ্ঠায় সচিবকে বলা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক প্রধান। প্রকৃতপক্ষে মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হলেন একজন মন্ত্রী।
ষষ্ঠ শ্রেণীর ইংরেজি বইয়ের ১৫ পৃষ্ঠায় ‘লিটল থিংস’ কবিতাটি দেয়া হলেও এতে কবির নাম দেয়া হয়নি। অথচ বহুল প্রচলিত এই কবিতাটি লিখেছেন আমেরিকান কবি জুলিয়া অ্যাবিগেল ফ্লেচার কার্নি। একইভাবে ১০১ পৃষ্ঠায় ‘মাই বুকস’ কবিতাতেও কবির নাম নেই। এছাড়া একই শ্রেণীর একাধিক বইয়ের অনেক জায়গায় একই শব্দের ভিন্ন ব্যবহার দেখা যায়। যেমন- কেন/কেনো, পড়/পড়ো, নিচে/নীচে, যে কোন/যেকোন ইত্যাদি। এছাড়া বইটির বিভিন্ন পৃষ্ঠায় বানান, বাক্য গঠন ও গ্রামারের ব্যবহারে অসংখ্য ভুল রয়েছে।
বছরের নতুন শিক্ষাক্রমে সপ্তম শ্রেণীর বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের একটি অংশে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক অ্যাডুকেশনাল সাইট থেকে বিষয়বস্তু নিয়ে হুবহু অনুবাদ করে ব্যবহার করার অভিযোগ উঠে। এ ছাড়া কয়েকটি বাক্য হুবহু ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ডট ওআরজি ওয়েবসাইট থেকে যান্ত্রিকভাবে অনুবাদ করে বাংলায় ভাষান্তর করার অভিযোগ উঠে। এ ঘটনার দায় স্বীকার করে যৌথ বিবৃতি দেন বইটির রচনা ও সম্পাদনার সাথে যুক্ত অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও অধ্যাপক ড. হাসিনা খান।
সপ্তম শ্রেণীর বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ এর নবম অধ্যায়ে নেপালের ভূমিকম্প, সুনামি, বন্যায় কিংবা জলোচ্ছ্বাসের ধ্বংসস্তূপসহ বিভিন্ন অধ্যায়ে ছবি ব্যবহার করা হয়েছে কোনোরূপ কৃতিত্ব দেয়া ছাড়াই। ওই অধ্যায়ে ৯০ পৃষ্ঠায় সংবেদনশীল ছবি ছাপানো হয়। যেখানে ‘বন্যায় আশ্রয়ের জন্য যাচ্ছে ছোট শিশু’ ছবি দেয়া হয়, আলোকচিত্রে শিশু দু’টির মুখাবয়ব স্পষ্ট দেখা যায় যেটি ইউনেস্কোর শিশু অধিকার আইন অনুযায়ী এক ধরনের অপরাধ।
নতুন কারিকুলামে মাদরাসার ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর বইগুলো প্রকাশের আগে থেকেই বিতর্কিত লেখা, ছবি বাদ দেয়ার দাবি উঠে। এ জন্য সারা দেশে স্মারকলিপি প্রদান, মানববন্ধন, সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করে বিভিন্ন সংগঠন। তাদের সে সময় আশ্বস্ত করা হলেও তাদের সেই দাবির কোনো তোয়াক্কা না করেই পাঠ্যপুস্তকে ডারউইনের বিতর্কিত মতবাদ, হিন্দুত্ববাদ, হাজার হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারী, নগ্ন ও অশ্লীল ছবি যুক্ত করা এবং বাংলাদেশের কৃষ্টিকালচার বিরোধী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার অভিযোগ ও তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। পাঠ্যবইয়ে বঙ্গবিজয়ী ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজিকে তুর্কি আক্রমণকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়, বাস্তবতার সাথে সাংঘর্ষিক।
মাদরাসার ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর বিভিন্ন বইসহ বিজ্ঞান বইয়ে ১১ জন উলঙ্গ নারী-পুরুষের ছবি, হিন্দুদের দেব-দেবীর নগ্ন ও অর্ধনগ্ন ছবি, হিন্দু মহিলার শাঁখা পরা ছবি রয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। এছাড়াও দুর্গাপূজা, গীতাঞ্জলিসহ মূর্তিপূজার সংস্কৃতি চর্চা শিক্ষা দেয়ার কথা বলা হয়। নবী ও সাহাবিদের নাম বাদ দিয়ে মন্দিরা, প্রিয়াংকা, মিসেল, ডেবিট, প্লাবন, চাকমার মতো অমুসলিম নাম সংযোজন করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে।