স্বদেশ ডেস্ক:
‘চালের দাম কমছেই না। আর চালের দামের চেয়ে চড়া হয়ে গেছে আটার দাম। খোলা আটা ৫৮ টাকা কেজি। আমরা কী খেয়ে বাঁচব, মসুর ডালের দাম ১০০ টাকা ছাড়াইয়া গেছে। খাইতাম অ্যাংকর ডাল। সেটাও কেজিতে ১০ টাকা বাড়ছে। সামান্য শাকসবজি কিনতেও হিসাব করা লাগছে। এইভাবে চললে পরিবার নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে।’খেদের সঙ্গে এটুকু বলে থামলেন মো. হেলাল মিয়া, মুখে রাজ্যের অস্বস্তি। পেশায় কারখানা শ্রমিক হেলালের সঙ্গে কথা হচ্ছিল রাজধানীর কদমতলীর সাদ্দাম মার্কেটের বাজারে।
সরকারি হিসাবে, গত কয়েকমাস ধরে মূল্যস্ফীতি ‘অল্প অল্প করে কমছে’। কিন্তু হেলাল মিয়াদের মতো ক্রেতারা তা বলছেন না; বাজারে সরেজমিন দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র দাম যেন সওয়ার হয়েছে পাগলা ঘোড়ার পিঠে। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকার প্রধান উপকরণ চাল কিনে খেতে এখনো কষ্ট হচ্ছে স্বল্পআয়ের মানুষের। নতুন আমন সেই কবে বাজারে এলেও চালের মূল্যে স্বস্তি মেলেনি। আটার দামও নাগালের বাইরে চলে গেছে। অ্যাংকর ডালের দামও ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় নিম্নআয়ের মানুষ দুবেলা অন্ন জোগাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। তেল, চিনি, মসলার সঙ্গে বেড়েছে লবণের দামও। অনেকেরই খাবারের পাত থেকে বাদ পড়েছে গরুর মাংস, অনেক আগেই। প্রোটিনের সহজলভ্য আরও দুটি উৎস ব্রয়লার মুরগি ও ফার্মের ডিম। সম্প্রতি এ দুটি পণ্যের দাম এক লাফে আকাশে উঠে গেছে। সব মিলিয়ে ভোগ্যপণ্যের বাজারে দুঃসংবাদ আছে, সুসংবাদ নেই। প্রতি সপ্তাহেই বাড়ছে দাম, যোগ হচ্ছে নতুন নতুন দুঃসংবাদ। নিম্নবিত্তরা তো আগে থেকেই যারপরনাই চাপে ছিল, এখন মধ্যবিত্তদের পক্ষেও চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তরিতরকারির দামও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে।
হেলাল মিয়ার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন পাশেই দাঁড়িয়ে শুনছিলেন মো. আনিস রহমান। বেসরকারি এই চাকরিজীবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, গরুর মাংসের দাম দেখে খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছি। বাসায় মেহমান এসেছে। বাজার করতে এসে দেখি- ব্রয়লারের দাম কেজি ২১০ টাকা হয়ে গেছে। মাত্র দুদিন আগেও কিনেছি ১৯৫ টাকায়! ডিমের ডজন ১২৫ টাকা থেকে ১৪০ টাকা হয়ে গেছে! সবকিছুর দাম শুধু বাড়ছে আর বাড়ছে। বেতনের সীমিত টাকায় দামবৃদ্ধির ঘোড়ার সঙ্গে দৌড়ে পারছি না।
আমিষের উচ্চমূল্যের কারণে অনেক পরিবারই নিরামিষভোজী হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। কেজি ৭০০ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়া গরুর মাংস মাসে একবারও খাওয়া হয় না, এমন পরিবারের সংখ্যাই বেশি। আমিষের শেষ আশ্রয় ছিল ব্রয়লার মুরগি। সেটির দাম এখন ২১০ টাকা। কোথাও কোথাও আরও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। অথচ, সপ্তাহ দেড়েক আগেও ১৫০-১৫৫ টাকায় পাওয়া গেছে। আর ফার্মের ডিমের ডজন হঠাৎ করেই ১২৫ টাকা থেকে বেড়ে ১৪০ টাকা হয়ে গেছে। ফলে অনেকের খাবারের মেনু থেকে বাদ পড়ছে ডিম।
মালিবাগ বাজারের ডিম ব্যবসায়ী রুহুল আমিন বলেন, এখন ১০০ পিস ফার্মের ডিম কেনা পড়ছে এক হাজার ৮০ টাকা। প্রতিপিসের দাম পড়ছে ১০ টাকা ৮০ পয়সা। সপ্তাহ দুয়েক আগে যা কিনেছি এক হাজার ২০ টাকায়। একই কথা জানান পোলট্রি খামারের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদারও। তিনি বলেন, করপোরেট কোম্পানিগুলো ডিম নিয়ে কারসাজি করছে। অপরদিকে একদিনের বাচ্চার দাম ইচ্ছামতো বাড়িয়ে দিচ্ছে। এক মাস আগেও প্রতি পিস বাচ্চা ৯ টাকা ছিল। এখন তা ৫৫ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর ফলেই দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে।
এদিকে মাছের বাজারেও আগুন। চাষের তেলাপিয়া সাধারণত ১৫০ টাকায় পাওয়া গেলেও এখন তা ২০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। একই অবস্থা পাঙাশেরও। অন্যান্য মাছে হাত ছোঁয়ানোই দায়। কুচো চিংড়ির দামও হাকা হচ্ছে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, ২০২২ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় ১০ দশমিক ০৮ শতাংশ বেড়েছে। ২০২১ সালে এ ব্যয় বেড়েছিল ৬ দশমিক ৯২ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে জীবনযাত্রার ব্যয় ৩ দশমিক ১৬ শতাংশ বেশি বেড়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে নিত্যপণ্যের বাজারে চলমান অস্থিরতায় জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি বিপদে রয়েছেন স্বল্প আয়ের ও খেটে খাওয়া জনগোষ্ঠী।
বাজারে সয়াবিন তেলের দাম নাগালের বাইরে গেছে অনেক আগেই। চিনি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা চিনির দাম বাড়িয়ে ১০৭ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও বাজারে তা আগের মতোই বাড়তি দাম অর্থাৎ ১১৫ থেকে ১২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ কারণে অনেক বিক্রেতা প্যাকেট চিনি ভেঙে খোলা বিক্রি করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৫ টাকা ওঠানামা করলেও রসুনের দাম কেজিতে দাম এক লাফে ৩০ টাকা বেড়েছে। আমদানিকৃত রসুনের কেজি এখন বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকায়, যা সপ্তাহ দুয়েক আগে বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা পর্যন্ত। আদা, হলুদের দামও বেড়েছে। এলাচের দাম অনেকটা অপরিবর্তিত থাকলেও জিরা, দারুচিনি, লবঙ্গের দামটা বেড়েছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশ অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে বেশিরভাগ পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চিত্র। সংস্থাটির হিসাবই বলছে, এক বছরে মোটা চালের দাম ৮.৭ শতাংশ, খোলা আটার দাম ৬৮.১২ শতাংশ, লুজ সয়াবিন তেল ১৩.৪৪ শতাংশ, খোলা চিনি ৪৭.০৬ শতাংশ, অ্যাংকর ডাল ৪০.৭৮ শতাংশ দাম বেড়েছে।
একই সঙ্গে দেশি পেঁয়াজে ১৬.৬৭ শতাংশ, আমদানিকৃত রসুনে ৬৯.০৫ শতাংশ, আমদানিকৃত আদায় ১৬২.৫ শতাংশ, দেশি শুকনা মরিচে ১২৭.৭৮ শতাংশ এবং আমদানিকৃত হলুদে ১৭.৬৫ শতাংশ দাম বেড়েছে। অর্থাৎ পেঁয়াজ, রসুন, আদা, শুকনা মরিচ ও হলুদে গড়ে খরচ বেড়েছে ৭৮.৭৩ শতাংশ।
অপরদিকে টিসিবির প্রতিবেদন অনুযায়ী গত এক বছরে জিরা, লবঙ্গ ও দারুচিনির দাম গড়ে ৩৭.২১ শতাংশ বেড়েছে। অপরদিকে একই সময়ে ব্রয়লার মুরগি ৩৬.৬৭ শতাংশ, ফার্মের ডিম ২৫ শতাংশ এবং খাবার লবণের দাম বেড়েছে ১০.৭৭ শতাংশ।
টিসিবির এ হিসাব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রয়োজনীয় এসব পণ্যের পেছনে এক বছরে ভোক্তার খরচ বেড়েছে গড়ে ৩৬.৬৪ শতাংশ, যা অনেক ভোক্তার পক্ষে সামাল দেওয়া কঠিন বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান আমাদের সময়কে বলেন, এমনিতেই মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে। এর মধ্যে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় এসব মানুষের সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। ডলার সংকট ও এলসি জটিলতায় আমদানিনির্ভর পণ্যের দাম বাড়তে পারে। তবে বেশিরভাগ পণ্যের ক্ষেত্রে দেখা যায় দাম অতিরিক্ত বাড়ানো হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের নৈতিকতা বোধ কমে গেছে। তাদের লোভ বেড়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির চেয়ে ব্যবসায়ীদের লোভস্ফীতিই এখন বড় সমস্যা।
তিনি আরও বলেন, দেশীয় বাজারে হাতেগোনা কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান আমদানিনির্ভর এসব প্রয়োজনীয় পণ্যের বড় একটি অংশ সরবরাহ করে থাকে। এতে এসব পণ্যের বাজার এদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। বাজারে সমান প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। সামনে রমজান মাস আসছে। এ সময় সাধারণ ভোক্তারা যাতে একটু স্বস্তি পেতে পারে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে সরকারকে। প্রয়োজনে অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক ছাড় দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি রোজাকে কেন্দ্র করে অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে কারসাজি না করতে পারে সেদিকেও কড়া নজর রাখতে হবে।