স্বদেশ ডেস্ক: উখিয়া ও টেকনাফের ৩২টি রোহিঙ্গা শিবির ঘিরে নানামুখী বাণিজ্য চালাচ্ছে একটি চক্র। রোহিঙ্গা থেকে শুরু করে সাহায্য পণ্য সরবরাহকারী ঠিকাদার এবং দেশি-বিদেশি ১৪৩টি এনজিওর কর্মী ও কর্মকর্তারা এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। এই চক্র রোহিঙ্গাদের জন্য সরবরাহ করা সাহায্যের বিভিন্ন পণ্য কম দামে কিনে তা বিক্রি করছে খোলাবাজারে। ফলে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
গত পাঁচ দিন ধরে উখিয়ার কুতুপালং, টিভি টাওয়ার ও টেকনাফের উনচিপ্রাংয়ের অন্তত ১০টি শিবির ও স্থানীয় বাজার ঘুরে, প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে ও এনজিও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এসব বিষয়ে জানলেও ওই চক্রের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গা পরিবারগুলোকে বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার সরবরাহ করা পণ্য কম দামে খোলা বাজারে বিক্রি করাই ওই চক্রের প্রধান কাজ। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির অধীনে প্রত্যেক রোহিঙ্গাকে একটি করে পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে। এক একটি পরিচয়পত্রের অনুকূলে প্রতিমাসে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা জমা হয়। সেই টাকার অনুপাতে তারা নিবন্ধিত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে এক মাসের খাদ্য ও অন্যান্য পণ্য নিতে পারে। মূলত এই পণ্য নিয়েই গড়ে উঠেছে বাণিজ্যের সিন্ডিকেট। আবার রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য দেওয়া হাইজিন কিট ও ডিগনিটি কিট খোলা বাজারে বিক্রি করছে আরেকটি চক্র। এর বাইরে ই-সপের নামে ইন্টারনেটেও চলে আরেক দফা বাণিজ্য।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির সাধারণ খাদ্য বিতরণে আওতায় একটি রোহিঙ্গা পরিবারকে এক মাসের জন্য চাল, ডাল, তেল, চা পাতা, পেঁয়াজ, লবণ, মরিচ, চিনি, মসলা, শুঁটকি মাছ থেকে শুরু করে ২২ পদের খাদ্যপণ্য সরবরাহ করা হয়। রোহিঙ্গারা কার্ড দেখিয়ে মাসের শুরুতে এসব পণ্য নেয়। এরপর যে টাকা কার্ডে অবশিষ্ট থাকে, সেই টাকার পণ্য কিনে সরাসরি খোলাবাজারে বিক্রি করে দেয়। প্রতিটি রোহিঙ্গা শিবিরের সামনেই এসব পণ্য কম দামে কিনতে শামিয়ানা টাঙিয়ে বসেন স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ী। শনি থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চলে এই পণ্যের বেচাকেনা।
গত মঙ্গলবার উখিয়ার বালুখালীতে অবস্থিত ১১ নম্বর ক্যাম্পের সামনে গিয়ে দেখা যায়, রোহিঙ্গারা পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত ওয়ার্ল্ড ভিশনের গুদাম থেকে খাবার নামাচ্ছে। নিচে টানানো শামিয়ানার ভেতরে স্থানীয় কিছু মানুষ বসে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে নগদ টাকায় চাল, ডাল, তেল, চা পাতা কিনে ট্রাকে ভরছে। ফখরুদ্দিন নামে এক ব্যক্তি এখানকার অন্যতম ব্যবসায়ী। তার কর্মচারী আছে অন্তত ১৫ জন। তাদের কেউ খাদ্যদ্রব্য কিনছে আবার কেউ টাকা পরিশোধ করছে। রোহিঙ্গাদের অনেকে ৫০ কেজি ওজনের চালের বস্তা সরাসরি ট্রাকে তুলে দিচ্ছে। কেউ কেউ আবার ১০-২০ কেজি করেও বিক্রি করছে। পুরো একটি বড় ট্রাক ভরতে সময় লাগে মাত্র ২০ থেকে ২৫ মিনিট। এর পর ট্রাকটি দ্রুত কক্সবাজারের পথে চলে যায়।
ব্যবসায়ী ফখরুদ্দিন বলেন, আমরা কয়েকজন মিলে এই ব্যবসা করছি। মাঝে মাঝে পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজন আসে। আমরা তাদের হাতে-পায়ে ধরে পার পেয়ে যাই। তিনি জানান, তারা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা চাল কেনেন মাত্র ৯০০ টাকায়। প্রতি লিটার সয়াবিন তেল কেনেন ৬০ টাকায়।
প্রতিটি শিবিরের সামনেই রয়েছে এ ধরনের ব্যবসা। এমনকি বালুখালি মরা গাছতলা নামক স্থানে গড়ে উঠেছে রোহিঙ্গা বাজার নামে একটি আলাদা বাজারই। সেখানে দুই শতাধিক দোকানে রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সাহায্য পণ্য বিক্রি করেন।
সুলতান আহমদ নামের তেমনই এক রোহিঙ্গা ব্যবসায়ী বলেন, `আমার দোকানে অন্তত পাঁচ লাখ টাকার পণ্য আছে। আমরা ক্যাম্পের ভেতরে-বাইরে বিভিন্ন স্থান থেকে এসব কিনে স্বল্প লাভে বিক্রি করি।’
স্থানীয় সূত্র বলছে, সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যবসা হয় ডিগনিটি কিট ও হাইজিন কিট নামে দুই ধরনের পণ্যের। ডিগনিটি কিট হলো একটি বালতিভর্তি আটটি পণ্য। প্রতিটি বালতিতে থাকে ছয়টি স্যানিটারি ন্যাপকিন, একটি ম্যাক্সি, একটি ওড়না কিংবা হিজাব, এক জোড়া চপ্পল, তিনটি প্যান্টি, দুটি কাপড় কাচার সাবান ও একটি সোলার লাইট। একাধিক এনজিও সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিটি বালতিভর্তি পণ্যের দাম অন্তত দেড় হাজার টাকা। কিন্তু ঠিকাদাররা এই পণ্য সরবরাহ করে ১ হাজার ৫০ টাকায়। এতে তারা কীভাবে লাভ করেন তা অনুসন্ধান করতে গিয়েই জানা গেল বিস্ময়কর তথ্য।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এনজিও রোহিঙ্গাদের ডিগনিটি কিটের বালতি হাতে দেওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যেই ৯৫ শতাংশ বালতি আবার সরবরাহকারী ঠিকাদারের হাতে চলে আসে। ঠিকাদাররা প্রতিটি বালতি তখন রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে মাত্র ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় কিনে নেন। পরদিন আবার সেই বালতি রোহিঙ্গাদের মধ্যে সরবরাহ করেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে কিনে নেন। এভাবে বাজার থেকে একবার কেনা পণ্য বারবার বিক্রি করে তারা তুলে নেন মোটা অঙ্কের টাকা। রোহিঙ্গা শিবিরে সরকার মনোনীত মাঝিরাই এগুলো সংগ্রহের কাজ করেন। বিনিময়ে তারা পান নগদ টাকা। ডিগনিটি কিটের মতো আছে হাইজিন কিটের বালতি। সেখানে আছে ডিসপোজেবল রেজার, টুটপেস্ট, টুথব্রাশ, বডিসোপ, কাপড় কাচার সাবান, শ্যাম্পু, গামছা, নেইল কাটার, চিরুনি, সুই-সুতা এবং কাপড়ের ক্লিপ। এই বালতি নিয়েও ঠিক একই বাণিজ্য চালান ঠিকাদাররা।
ঠিকাদারদের পাশাপাশি কিছু বেসরকারি সংগঠনও এই বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে জানা গেছে। জানা গেছে, উখিয়া-টেকনাফের শিবিরগুলোকে কেন্দ্র করে দেশি ও বিদেশি ১৪৩টি এনজিও এখন সক্রিয়। রোহিঙ্গা সংকটের শুরুর দিকে কিছু কিছু এনজিও চাকা না বসিয়ে গর্ত করে কেবল স্ল্যাব বসিয়ে পুরো সেনিটারি পায়খানা নির্মাণের টাকা নিয়েছে। এভাবে আরও কিছু কাজ কোনোমতে শেষ করেই টাকা তুলে নিয়েছে।
উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, `কিছু এনজিও, ঠিকাদার ও রোহিঙ্গারা ক্যাম্পকেন্দ্রিক বাণিজ্যে সক্রিয়। তাদের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের জন্য সরবরাহ করা চাল-ডালসহ অন্যান্য খাদ্য খোলাবাজারে চলে আসছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এখন খুবই অসহায়। স্থানীয় শ্রমবাজারও এখন রোহিঙ্গাদের দখলে।’
এ বিষয়ে কুতুপালং ওয়ান ইস্ট, ওয়ান ওয়েস্ট, থ্রি, ফোর ও ফোর এক্সটেনশন শিবিরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শামিমুল হক পাভেল বলেন, অনেক সময় দেখা যায় রোহিঙ্গারা চাল-ডাল বিক্রি করে মাংস কিংবা মাছ খেতে চায়। এসব তো আমরা সরবরাহ করি না। তাই এ নিয়ে খুব একটা কিছু বলা হয় না। তবে অন্য বাণিজ্যের ব্যাপারে নজরদারি করা হচ্ছে।