সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০২:১৮ পূর্বাহ্ন

জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান

জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান

স্বদেশ ডেস্ক:

আমরা কি জানি পৃথিবীর প্রথম নির্ভুল মানচিত্র অঙ্কনকারী ও বিশ্বের প্রথম স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের আবিষ্কারক কে ছিলেন? কিংবা গুটিবসন্তের আবিষ্কারক, স্ট্যাটিস্টিকের প্রতিষ্ঠাতা, আলোক বিজ্ঞান, রসায়ন, বীজগণিত ও ত্রিকোণমিতির জনক কে? কে-ই বা মিল্কিওয়ের গঠন শনাক্ত করেছিলেন? পদার্থ বিজ্ঞানে শূন্যের অবস্থান কে শনাক্ত করেছিলেন? ফাউন্টেন পেন, উইন্ডমিল, ঘূর্ণায়মান হাতল, পিন হোল ক্যামেরা, প্যারাসুট, শ্যাম্পু ইত্যাদি জিনিস বা বস্তু কারা আবিষ্কার করেছিলেন? এই প্রতিটি জিনিস বা বস্তুর আবিষ্কারক, গবেষক, উদ্ভাবক ছিলেন মুসলিম বিজ্ঞানীরা। যা আমরা খুব কম মানুষই জানি।

বর্তমানে যে মুসলিমরা জ্ঞান-বিজ্ঞান, আবিষ্কার ইত্যাদি দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়েছে তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এ নিয়ে অনেক মুসলিম শিশু, কিশোর বা সাধারণ মুসলিমরাই হীনম্মন্যতায় ভোগে। তারা দেখে সব বিজ্ঞানীরাই ইহুদি, খ্রিষ্টান বা অমুসলিম। তাদের মনে প্রশ্ন জাগে- কেন মুসলমানদের মধ্যে কোনো বিজ্ঞানী নেই?
এ পরিস্থিতির জন্য অনেকগুলো কারণই দায়ী-

মুসলিম বিজ্ঞানী নেই! মুসলিমদের উদ্ভাবনী মেধা নেই! মানবসভ্যতার সব বড় বড় আবিষ্কার করেছেন অমুসলিম বিজ্ঞানীরা- এই তত্ত্ব কে আমাদের দিয়েছে? বিজ্ঞানী হিসেবে গ্যালিলিও, আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল, লুই পাস্তুর, আলফ্রেড নোবেলদের কথা জানলেও জাবির ইবনে হাইয়ান, আল কিন্দি, আল খাওয়ারিজমি, আল ফরগানি, আল রাজী, ইবনে সিনা, আল ফারাবি, ওমর খৈয়ামদের কথা আমরা কয়জনই বা জানি? কেন এমনটা হলো?
এর কয়েকটি কারণ হলো-

১. ক্রুসেডারদের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ইসলামী স্বর্ণযুগ আড়াল করা বা মুসলিম বিজ্ঞানীদের পরিচয় লুকানো এবং তাদের পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা।

২. মুসলমানদের সরলতার সুযোগ নিয়ে অমুসলিমদের চাপিয়ে দেয়া শিক্ষাব্যবস্থার বিকৃত তত্ত্বগুলো মেনে নেয়া; মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, মুসলিম বিজ্ঞানী ও তাদের আবিষ্কারগুলো কৌশলে পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেয়া।

৩. বর্তমানে আমাদের এ বিষয়গুলো জানার ইচ্ছা থেকে পড়ালেখা না করা।

৭৫০ থেকে ১২৫৮ সাল পর্যন্ত ইসলামের স্বর্ণযুগ বা ইসলামিক রেনেসাঁ হিসেবে পরিচিত। এই সময় মুসলিম সভ্যতা জ্ঞান-বিজ্ঞান, আবিষ্কার, রাজনীতি, বাণিজ্য, ভূখণ্ড, দর্শন সব দিক থেকে স্বর্ণশিখরে আরোহণ করে এবং সেই সময় এই মুসলিম সভ্যতার সাথে অন্য কোনো সভ্যতার তুলনাই ছিল না। এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক জ্যাক লিখেছেন, ‘ইসলাম তার ক্ষমতা, শিক্ষা ও শ্রেষ্ঠতর সভ্যতার জোরে বিশ্বে ৫০০ বছর আধিপত্য করেছে।’

কিন্তু ক্রুসেডারদের পরবর্তী প্রজন্ম মুসলিমদের এই গৌরবোজ্জ্বল অর্জন ও ইতিহাস বিকৃত করার জন্য অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে নানা প্রচেষ্টা চালায়। তারা তাদের দুরভিসন্ধি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এই সময়টিকে অর্থাৎ মধ্যযুগকে অন্ধকার ও বর্বর যুগ হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছে। কিন্তু সত্য ইতিহাস কখনো মুছে ফেলা যায় না। হ্যাঁ, মধ্যযুগ অন্ধকারাছন্ন ও বর্বর ছিল তবে সেটি মুসলিম সভ্যতা নয়; বরং তখন গোটা ইউরোপই অন্ধকার ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিল।

অবাক করা বিষয় হচ্ছে- পশ্চিমারা স্বর্ণযুগের মুসলিম বিজ্ঞানীদের নানান বই ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে অত্যন্ত অদ্ভুত ও ঘৃণিত এক কাজ করে বসে। তারা ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অনুবাদের পাশাপাশি মুসলিম বিজ্ঞানীদের নাম পর্যন্ত পরিবর্তন করে ফেলে, যেটিকে তারা বলে ল্যাটিন ভাষায় নাম অনুবাদ। আচ্ছা নাম কি কখনো অনুবাদ করা যায়! বা নাম কি অনুবাদ করার মতো কোনো জিনিস? তারা মুসলিম বিজ্ঞানীদের এমন এমন নাম দেয়, যা শুনে বোঝার উপায় নেই যে, তারা আসলে মুসলিম।

মুসলিম লেখক ও বিজ্ঞানীদের নাম বেশ বড়সড় হলেও, ল্যাটিন ভাষায় তাদের নাম দেয়া হয়েছে একটি মাত্র শব্দে। যেমন- ইবনে সিনার পুরো নাম আবু আলী আল-হুসাইন ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সিনা হলেও পরিবর্তন করে তার নাম দেয়া হয়েছে আভিসিনা (আরপবহহধ), বীজগণিতের জনক আল খাওয়ারিজমির নাম দেয়া হয়েছে এলগোরিজম (অষমড়ৎরংস), প্রথম মানচিত্র অঙ্কনকারী আল-ইদ্রিসের নাম দেয়া হয়েছে দ্রেসেস (উৎবংংবং)। শুধু এই কয়েকজনের নাম নয়; বরং সব মুসলিম বিজ্ঞানীর প্রতিই তারা এই অবিচার করেছে।

তাদের দেয়া এই নামগুলো যখন কোনো শিক্ষার্থী বা যে কেউ প্রথমবার শুনবে, তারা কখনো চিন্তাও করবে না যে, তারা আসলে মুসলিম। নাম শুনে তাদেরকে অমুসলিম হিসেবে ভেবে নেবে। মানে ব্যাপারটি একবার ভেবে দেখেছেন, কত গভীর আর সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত। আব্দুল্লাহ, মোহাম্মদ, আবু বকর, আল-শরিফ এই সুন্দর ইসলামিক নামগুলো পর্যন্ত তাদের সহ্য হলো না। ইসলামিক স্বর্ণযুগের শুরুতেও তো মুসলিমরা প্রাচীন গ্রিক ও ভারত দার্শনিকদের নানা রচনা আরবি, সিরীয় ইত্যাদি ভাষায় অনুবাদ করেছে। কই তারা তো এমনটি করেনি। এই পুরো ব্যাপারটি আমাদের কাছে অত্যন্ত অদ্ভুত ঠেকেছে। লেখকের আসল নাম বদল করে নতুন নাম দেয়ার মতো এমন ঘটনা এর আগে বা পরে কখনো ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।

তারা শুধু নাম বিকৃত করা পর্যন্তই থেমে থাকেনি, এমনকি তাদের পরিচয় নিয়েও নানা বিভ্রান্তি ও ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছে। কারো ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে তিনি আদৌ মুসলিম নন, কারো অবদানকে খাটো করে দেখানো হয়েছে। রসায়নের জনক জাবির ইবনে হাইয়ান এমন এক চক্রান্তের শিকার। ইউরোপের এক ঐতিহাসিকের দাবি, জাবির ইবনে হাইয়ান ছাড়াও আরেকজন জাবির ছিলেন। তার নাম ‘জিবার’ এবং তিনি ইউরোপের অধিবাসী। এমন আরো অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।

এবার আমাদের অবস্থা নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। আমরা কি মুসলিম বিজ্ঞানী ও তাদের আবিষ্কার ও গবেষণাগুলো সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছি? তাদের নিয়ে আলোচনা কিংবা লেখালেখি করছি? আমাদের শিশু-কিশোররা কি গ্যালিলিও, নিউটনদের পাশাপাশি নাসিরুদ্দিন তুসি, আল-ফরগানি, আল-ফারাবিদের সম্পর্কে কখনো জেনেছে, তাদের সম্পর্কে কখনো পড়েছে? বিজ্ঞান-বিষয়ক শিশুতোষ বা কিশোর লেখাগুলোতে তারা কি কখনো মুসলিম বিজ্ঞানীদের অসাধারণ গবেষণা, আবিষ্কারগুলো সম্পর্কে জেনেছে? কেন এমনটি হলো? আসলে এ বিষয়ে পশ্চিমারা যে নীতি বা শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে, আমাদের পরাজিত মন-মানসিকতাও তা বিনা দ্বিধায় মেনে নিয়েছে।

জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান অন্যান্য ধর্ম ও জাতির তুলনায় অনেক অনেক বেশি। ইসলামের সূচনা থেকেই শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে মুসলমানদের যাত্রা শুরু হয়। মুসলিম দার্শনিকদের সৃষ্টিশীল প্রতিভার ফলেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অভাবনীয় সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। (আগামীকাল সমাপ্য)

লেখক : শিক্ষক, মাস্টার তালেব উল্লাহ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার

  • আলী ওসমান শেফায়েত

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877