স্বদেশ ডেস্ক:
শীতকালে আমাদের দেশের গ্রাম-গঞ্জ এমনকি শহরে ওয়াজ মাহফিলের ধুম পড়ে যায়। নিজেকে ঈমানী জজবায় চাঙ্গা করে তুলতে ওয়াজ-মাহফিলের ভূমিকা অনন্য। অন্য দিকে, ওয়াজ মাহফিল এ দেশের গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের অংশও। আবহমানকাল ধরে বাঙালি মুসলিম সমাজে এটি প্রচলিত। কুরআন কারিমের ৭৭টি নামের এক নাম হলো ‘ওয়াজ’ বা উপদেশ। মহান আল্লাহ হলেন প্রথম ওয়ায়েজ বা ওয়াজকারী। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সা: হলেন দ্বিতীয় ওয়ায়েজ, এই সূত্রে নবী করিম সা:-এর উত্তরাধিকারীরা ওয়ায়েজিন। এই উম্মতের দাওয়াতি কাজ পরিচালনা করবেন ওয়ারেসাতুল আম্বিয়া তথা নবীদের উত্তরাধিকারী ওলামায়ে কেরাম। আর ওলামায়ে কেরামের দায়িত্ব হলো এই দাওয়াতি কাজ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত রাখা।
ওয়াজ, নসিহত, বয়ান, খুতবা, তাফসির ইত্যাদি দাওয়াতের প্রচলিত মাধ্যম। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করো হিকমত ও সদুপদেশ দিয়ে এবং তাদের সাথে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়’ (সূরা নাহল-১২৫)।
‘ওয়াজ’ হলো- সুন্দর, আকর্ষণীয়, যুক্তিপূর্ণ ও হৃদয়স্পর্শী আবেদনময় আলোচনা। আর দেশ-বিদেশের সমকালীন খ্যাতিসম্পন্ন ওলামায়ে কেরাম তাতে উপস্থিত থেকে কুরআন-হাদিসের আলোকে সারগর্ভ নসিহত পেশ করেন। মুসলমানদের ঈমান-আকাইদ ও আমলি সংশোধন, আত্মিক পরিশুদ্ধি ও যুগসচেতন হওয়ার আহ্বান করেন। তাই সামাজিক সংগঠন কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগে আয়োজিত মাহফিলের উপকারিতা অনেক বেশি।
মদ-জুয়া, যাত্রা, নর্তকী ও গানের কনসার্টের বিপরীতে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন সত্যিই খুব প্রশংসার দাবি রাখে। তবে মাহফিলগুলো যাতে করে রেওয়াজ ও লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে না হয় সে দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। বক্তা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে। ইলম ও আমলওয়ালা ওলামা ও বুজুর্গানে কেরামদের মাহফিলে দাওয়াতের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শুধু সুন্দর সুর-কণ্ঠ, মাঠ কাঁপানো ও কন্টাক্টওয়ালা বক্তাদের দিয়ে আজীবন ওয়াজ করালে একজন মানুষেরও হিদায়াত হবে না। অযথা টাকা খরচ ও সময় নষ্ট এবং বিনোদন বৈকি।
এ কথা স্বীকার করতেই হয়, আমাদের বর্তমানের মাহফিলগুলো আগের মতো সে রকম প্রভাব ফেলার মতো হচ্ছে না। আগে বক্তাদের যেরকম ইলম ছিল, ছিল সেরকম আমলও। ইখলাস ও লিল্লাহিয়াতেরও কোনো ঘাটতি ছিল না। আর আজ অনেক জায়গায় ব্যতিক্রম। এখনকার অনেক ওয়াজ মাহফিলে বিশেষ অপচয় করা হয়। শ্রোতাদের নিবেদন রক্ষার্থে বেশির ভাগ মাহফিলে কন্টাক্টওয়ালা বক্তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। আসলে এটি সমাজেরই দোষ। সমাজ যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে তেমনি মানুষের ভেতরের খুলুছিয়াত ও লিল্লাহিয়াতে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।
ওয়াজের উদ্দেশ্য কী হবে, ওয়াজ কী ও কেন এটি অনেকেরই অজানা। ওয়াজের উদ্দেশ্য হবে মানুষকে ইহ-পরকালীন কল্যাণের পথনির্দেশ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল করা। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন শুধুই ওই আমল কবুল করেন, যা তার সন্তুষ্টির জন্য করা হয়’ (বাইহাকি)। হজরত আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘যে ভাষার প্রাঞ্জলতা শিখে মানুষের অন্তরকে তার প্রতি আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার কোনো ফরজ ও নফল ইবাদতগুলোকে কবুল করবেন না’ (মিশকাত-৪১০)। ইমাম গাজ্জালি রাহ: তার ‘আইয়্যুহাল ওয়ালাদ’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ওয়াজকারীদের ওয়াজ দ্বারা উদ্দেশ্য যেন হয় মানুষকে দুনিয়া থেকে আখিরাতের প্রতি, গোনাহ থেকে নেকির প্রতি, লোভ থেকে পরিতুষ্টির প্রতি আহ্বান করা। এরই ভিত্তিতে বক্তারা শ্রোতাদেরকে পরকালমুখী ও দুনিয়াবিমুখ করে গড়ে তোলার প্রয়াস পান। ইবাদত-বন্দেগি ও তাকওয়ার দীক্ষা দান করা, সর্বোপরি আত্মিক অবস্থা পরিবর্তনের সাধনা করাই হলো প্রকৃত ওয়াজ। আর যে বক্তা এরূপ উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে ওয়াজ করবে তার ওয়াজ মানুষের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। দ্বীনদার মুসলমানরা যেন এ রকম বক্তা ও ওয়াজ সম্পূর্ণরূপে পরিহার করে (মাজালিসুল আবরার-৪৮২)।
বক্তাদের জন্য পাঁচটি জিনিস অত্যাবশ্যক : সেগুলো হলো- ১. ইলম : কেননা ইলমহীন ব্যক্তি সঠিক ও বিশুদ্ধ বয়ান করতে অক্ষম; ২. আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তার দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্য; ৩. যা বয়ান করবেন তা আমল করা; ৪.বক্তা শ্রোতাদের ওপর দয়ার্দ্র ও বিনম্র হয়ে কথা বলা, ৫. বক্তা ধৈর্যশীল ও সহনশীল হওয়া (ফতোওয়ায়ে আলমগিরি-৪/১১০)।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে জানা গেল, আল্লাহর সন্তুষ্টি, দ্বীনের দাওয়াত ও মানুষের হিদায়াতকে লক্ষ্য না বানিয়ে যতই ওয়াজ হোক তা আল্লাহর কাছে কবুল হবে না এবং তা দিয়ে মানুষের কোনো উপকারও সাধিত হয় না। অর্থকড়ি, যশ-খ্যাতি ও দুনিয়াবি কোনো স্বার্থ হাসিলের জন্য যারা ওয়াজ করে বা ওয়াজের আয়োজন করে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ওয়াজকারী ব্যক্তির জন্য দু’টি গুণ থাকা অপরিহার্য। যদি দুই গুণ না থাকে তাহলে মানুষ হিদায়াত হবে না। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তাদেরকে অনুসরণ করো যারা দ্বীনি বিষয়ে কোনো পারিশ্রমিক চান না এবং তারা সুপথপ্রাপ্ত’ (সূরা ইয়াসিন-২১)।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেন, ‘শেষ জামানায় একদল লোক বের হবে, যারা হবে বয়সে অল্প, বিদ্যায় অপরিপক্ব। তারা কুরআনের কথা বলবে; কিন্তু এর প্রভাব নিজ কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। (অর্থাৎ বাস্তব জীবনে এর ওপর আমল করবে না) তারা দুনিয়াবাসীর মধ্যে সবচেয়ে চমৎকার চমৎকার কথা বলবে। অথচ ধনুক থেকে তীর ছোটার গতিতে তারা দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে’ (তিরমিজি)।
এ হাদিসে আমলহীন আলোচকের ব্যাপারে সতর্ক করার পাশাপাশি তাদের ভয়াবহ পরিণামের কথাও বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং, দ্বীনি আলোচক নির্বাচনে অবশ্যই তার ফিকহি প্রজ্ঞার সাথে সাথে আমলি হালচাল জেনে নেয়া আবশ্যক।
আর চারিত্রিক সৌন্দর্য এমন একটি বিষয় যা ছাড়া কেউ ইসলামের প্রকৃত দাঈ বা মুবাল্লেগ হতে পারে না। ওয়াজ মাহফিলের আলোচকও প্রকৃতপক্ষে একজন দাঈ ও মুবাল্লেগ। বাস্তবিক অর্থে যিনি ওয়াজ নসিহত করেন, হেদায়াতের কথা বলেন তিনি হলেন নবীওয়ালা কাজের উত্তরাধিকারী। সুতরাং অবশ্যই তাকে চারিত্রিক মাধুর্য ও আদর্শিক গুণাবলির অধিকারী হতে হবে।
রাসূল সা: বলেন, প্রশংসনীয় গুণাবলিতে পূর্ণতার রূপ দেয়ার জন্য আমি প্রেরিত হয়েছি। হজরত মুয়াজ রা: বর্ণনা করেন, আমি যখন উটের পাদানিতে পা রাখি তখন রাসূল সা: সর্বশেষ যে নসিহত করেছিলেন তা হলো, ‘হে মুয়াজ! তুমি মানুষের সাথে উত্তম আচরণ করবে’ (মুয়াত্তা মালেক)।
পরিশেষে বলতে চাই, কেউ নিজেকে রাসূলের অনুসারী ও উত্তরাধিকারী বলে দাবি করবে অথচ চারিত্রিক গুণাবলিতে তার আনুগত্য করবে না, তা হতে পারে না। সুতরাং ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক চলাফেরায় সর্বত্র নবী আদর্শের বাস্তবায়ন অপরিহার্য। আর ওয়াজ মাহফিলের আয়োজকদের কাছে প্রত্যাশা থাকবে, ওয়াজ মাহফিলে কুরআন-হাদিসভিত্তিক আলোচনার জন্য বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ আলেম নির্বাচন করবেন। তাহলে জাতি আরো বেশি উপকৃত হবে এবং ওয়াজ মাহফিলের উদ্দেশ্য হাসিল হবে। বস্তুত এমন ওয়াজের মাধ্যমে পরকালে নাজাতের আশা করা যায়।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি