বিনোদন ডেস্ক:
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর। তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর।
কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর গত জানুয়ারি মাসের শুরুতে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।
লতা মঙ্গেশকর ছিলেন এমন একজন কিংবদন্তীর প্লেব্যাক গায়িকা, যিনি ভারতের চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গীতকে অন্যরকম এক মাত্রা এনে দিয়েছিলেন।
সঙ্গীতনির্ভর বলিউডের চলচ্চিত্র জগতের শুরু থেকেই, প্লেব্যাক সিঙ্গার বা নেপথ্যের কণ্ঠ শিল্পীরা এই শিল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ- যেখানে পেশাদার শিল্পীরা গান গেয়ে থাকেন আর চলচ্চিত্রের পর্দায় সেসব গানের সঙ্গে মুখ মেলান অভিনয় শিল্পীরা।
‘নাইটিঙ্গেল অব ইন্ডিয়া’ বলে আখ্যা পাওয়া লতা মঙ্গেশকর অর্ধশত বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ভারতের ৩৬টি ভাষায় প্রায় ৩০ হাজার গান গেয়েছেন।
দশকের পর দশকজুড়ে তিনি ছিলেন ভারতের সবচেয়ে বেশি চাহিদাসম্পন্ন সঙ্গীত শিল্পী। বলিউডের প্রত্যেক শীর্ষ অভিনেত্রী চাইতেন, চলচ্চিত্রে তাদের গানটি যেন তাকে দিয়ে গাওয়ানো হয়।
মধ্য ভারতের শহর ইন্দোরে ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯২৯ সালে জন্ম গ্রহণ করেন লতা মঙ্গেশকর। তার বাবা ছিলেন একজন গায়ক, থিয়েটারের অভিনেতা এবং মারাঠি ভাষায় গীতিনাট্যের প্রযোজনা করতেন।
পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তার অন্য ভাইবোনেরাও তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন এবং তারাও ভারতের নামকরা গায়ক-গায়িকা হয়েছেন।
‘অত্যন্ত প্রশংসিত’
একটি সাক্ষাৎকারে লতা মঙ্গেশকর বলেছিলেন যে, তার পরিবার শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চা করতো এবং চলচ্চিত্রের গান বাড়িতে খুব একটা ভালো চোখে দেখা হত না।
তিনি কখনোই প্রথাগত আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পাননি। একজন গৃহকর্মী তাকে মারাঠি বর্ণপরিচয় শিখিয়েছেন এবং স্থানীয় একজন পুরোহিত তাকে সংস্কৃত শেখান। আত্মীয়স্বজন এবং শিক্ষকরা তাদের বাড়িতে এসে তাকে অন্যান্য বিষয় শেখাতেন। কিন্তু তাদের জন্য সময়টা কঠিন হয়ে ওঠে, যখন তারা বাবা স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ফলে তিনি চলচ্চিত্র আর তার থিয়েটার কোম্পানি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন।
মহারাষ্ট্রের সাঙ্গলিতে তাদের পারিবারিক বাসস্থানটি নিলাম হয়ে গেলে পরিবারটি পশ্চিমের শহর পুনায় (এখন পুনে) চলে আসতে বাধ্য হয়। বাবার মৃত্যুর পর পরিবারটি বোম্বাই (এখনকার নাম মুম্বাই) শহরে চলে আসে।
সেই সময়ে, উনিশশো চল্লিশের দশকে চলচ্চিত্রে তত বেশি গানের সুযোগ না থাকায় তরুণী লতা আয়-রোজগারের জন্য অভিনয় করতে শুরু করেন।
তিনি প্রায় আটটি মারাঠি আর হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।
১৯৪৩ সালে মারাঠি চলচ্চিত্র ‘গজাবাউ’-তে তিনি ‘কিছু কথা, কিছু শব্দ’ শিরোনামের একটি গান গেয়েছেন, যা ছিল চলচ্চিত্রে তার গাওয়া প্রথম গান।
১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চলচ্চিত্রে অভিনয় করে প্রতি মাসে তার আয় হতো দুই শ’ রূপি।
‘মেকআপ, লাইট এগুলো কখনোই আমার ভাল লাগেনি। মানুষজন আপনাকে আদেশ দিচ্ছে, এই কথা বলো, ওই কথা বলো, আমার খুব অস্বস্তি লাগতো।’ চলচ্চিত্রে তার সময় নিয়ে নাসরীন মুন্নী কবিরকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি এই মন্তব্য করেছিলেন।
যখন একজন পরিচালক তাকে বলেছিলেন যে, তার ভুরু ছাঁটতে হবে, কারণ এগুলো বেশি ছড়ানো, তখন তিনি খুবই আহত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সেটা মেনে নিয়েছিলেন।
১৯৪৯ সালে মহল চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার পর থেকে তিনি সবার নজরে চলে আসেন।
আন্তরিক শ্রদ্ধা
পরবর্তী চার দশক ধরে তিনি মনে রাখার মতো এবং জনপ্রিয় অনেক গান গেয়েছেন।
এসবের মধ্যে আছে অনেক বিখ্যাত চলচ্চিত্র – পাকিজা, মাজবর, আওয়ারা, মুঘল ই আজম, শ্রী ৪২০, আরাধনা এবং দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গের মতো সিনেমা, যেটি রেকর্ড ২০ বছর ধরে টানা চলেছে।
চীনের সঙ্গে ভারতের ১৯৬২ সালের যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের স্মরণে একটি জনসভায় গভীর আবেগে যখন তিনি ‘ইয়ে মেরে ওয়াতান কে লোগো’ (ও আমার দেশের মানুষ) গাইছিলেন, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর চোখ থেকেও পানি গড়িয়ে পড়ে।
বলিউডের সকল বিখ্যাত গায়কের সঙ্গে তিনি গান গেয়েছেন। তাদের মধ্যে আছেন মোহাম্মদ রফি, কিশোর কুমার।
সেই সঙ্গে বলিউডের শীর্ষ সকল পরিচালকের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন, যাদের মধ্যে আছেন রাজ কাপুর এবং গুরু দত্ত থেকে শুরু করে মনি রত্নম এবং করন জোহর।
মোহাম্মদ রফির মতো যে পুরুষ গায়করা অনেক গান গেয়েছেন বলে দাবি করতেন, তাদের চ্যালেঞ্জ করার মতো সাহস ছিল মঙ্গেশকরের। তিনি ছিলেন প্রথম গায়িকা যিনি গান গাওয়ার জন্য ভালো পারিশ্রমিক এবং লভ্যাংশ দাবি করেছিলেন।
‘আমি হচ্ছি একজন স্ব-প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। আমি জানি কীভাবে লড়াই করতে হয়। আমি কখনো কাউকে ভয় পাইনি। আমি খানিকটা ভয়হীন ধরণের মানুষ। কিন্তু আমি কখনো ভাবি যতটা পেয়েছি, এতটা আমি পাবো,’ তিনি বলেছিলেন।
গীতিকার এবং চিত্রনাট্যকার জাভেদ আখতার তার সুরেলা কণ্ঠ এবং আন্তরিক গান গাওয়াকে বর্ণনা করেছেন ‘এতোটাই বিশুদ্ধ এবং পরিষ্কার যেন স্ফটিকের সবচেয়ে সেরা মুক্তো।’
বলিউডে কোন গানগুলো সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়, জানতে চাওয়া হলে মঙ্গেশকর একবার বলেছিলেন, ‘প্রেমের গানগুলো সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। নায়িকা দৌড়াচ্ছে আর নায়ক তার পেছনে দৌড়াচ্ছে।’
চলচ্চিত্রের গানের বাইরে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে লতা মঙ্গেশকরের পছন্দ ছিল বেশ বিস্তৃত।
ক্রিকেট, গাড়ি, কুকুর, স্লট মেশিন ও অন্যান্য পছন্দ
তিনি মোজার্ট, বিথোভেন, চোপিন, নাট কিং কোল, বিটলস, বারব্রা স্ট্রেইস্যান্ড এবং হ্যারি বেলাফন্টের সংগীত শুনতে পছন্দ করতেন। মঞ্চে মার্লিন ডিয়েট্রিচের গান গাওয়া দেখতে গিয়েছিলেন তিনি এবং ইনগ্রিড বার্গম্যানের থিয়েটার দেখতে ভালোবাসতেন।
তিনি সিনেমা দেখতেও পছন্দ করতেন। তার পছন্দের হলিউডি চলচ্চিত্র ছিল ‘দি কিং এন্ড আই’, যা তিনি অন্তত ১৫ বার দেখেছেন বলে জানিয়েছেন। আরেকটি পছন্দের চলচ্চিত্র হচ্ছে ‘সিঙ্গিং ইন দ্যা রেইন’।
তিনি গাড়ি ভালোবাসতেন। জীবনের নানা পর্যায়ে তিনি ধূসর রঙের হিলম্যান এবং নীল শেভ্রোলেটের মালিক হয়েছেন, ক্রাইসেলার এবং মার্সিডিজও ছিল। বাড়িতে তার নয়টি কুকুর রয়েছে।
মঙ্গেশকর ক্রিকেটের একজন গোঁড়া সমর্থক। অনেক সময় রেকর্ডিংয়ে বিরতি দিয়ে টেস্ট ম্যাচ খেলা দেখতে গিয়েছেন। ডন ব্রাডম্যানের স্বাক্ষর করা একটি ছবি তার গর্বের একটি জিনিস।
মাঝে মাঝে রান্না করা এবং রোলেইফ্লেক্স ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা তার শখের অন্যতম।
যুক্তরাষ্ট্রে ছুটি কাটানোর সময় তিনি লাস ভেগাসে সারারাত ধরে স্লট মেশিনে খেলতে ভালোবাসতেন।
মঙ্গেশকরকে অনেক সময় তার বন্ধু সেতার মাস্টার রবি শঙ্করের স্টুডিওতে দেখা যেতো, যেখানে তিনি বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। ১৯৭৯ সালে তিনি ছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি রয়্যাল আলবার্ট হলে ওরেন অর্কেস্ট্রার সঙ্গে সঙ্গীতানুষ্ঠান করেছেন।
‘আমি সবসময়ে মনে করি, আনন্দ হলো বিশ্বের সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেয়ার জিনিস আর দুঃখ হলো নিজের ভেতরে চেপে রাখার,’ মঙ্গেশকর একবার বলেছিলেন।
তার কালজয়ী সঙ্গীত অবশ্যই ভারতের লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য আনন্দ বয়ে এনেছে এবং নাসরীন মুন্নী কবির যেভাবে বলেছেন, তাদের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে এসব সঙ্গীত।
সূত্র : বিবিসি